চামড়ার দরপতন

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব, ফুলেফেঁপে আড়তদার

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ২০ টাকা বর্গফুটে বেচতে না পারলেও আড়তদাররা পাচ্ছেন ৫০

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৯ আগস্ট ২০১৯, ১১:৩৯

কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতনের ‘মুনাফা’ শেষ পর্যন্ত গেল আড়তদারদের পকেটে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অস্বাভাবিক কম দামে চামড়া কিনলেও নানা ঘটনার পর তারা ঠিকই সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া দিচ্ছেন ট্যানারিতে।

এবার সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়া বর্গফুটপ্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা আর ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছিল।

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোরবানির পর যে চামড়া সংগ্রহ করেন, তাতে লবণ দেওয়া থাকে না। এই কাজটা আড়তেই হয়ে থাকে। ফলে এই বাবদ তাদের খরচ হয়ে থাকে।

তবে এবার আড়তে সর্বনি¤œ ২০০ থেকে ৮০০ টাকা করে চামড়া কেনা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের তথ্যই বলছে, ঢাকার পাইকারি বাজার পোস্তার আড়তে গড়ে একেকটি চামড়ার দাম পড়েছে ৫৫০ টাকা। বর্গফুট হিসাব করলে এটি ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে ছিল।

অথচ এখন পোস্তা থেকে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনছেন সরকার নির্ধারিত ৪৫ থেকে ৫০ টাকা করেই। অর্থাৎ ২০ বর্গফুটের যে চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আড়তে ২০০ বা আশপাশে বিক্রি করেছেন, সেটি এখন ৯০০ বা এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আর ৫০ বর্গফুটের যে চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৮০০ বা এর আশপাশে বিক্রি করেছেন, সেখানে এখন বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ২২৫ টাকা থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়।

চামড়া সংগ্রহ আর এই সময়টায় আড়তদারদের শ্রমিক ও গুদাম খরচ এবং লবণের পেছনে খরচ হয়েছে। একেকটি চামড়ার পেছনে এই সময়ে ব্যয় হয়েছে আট কেজির মতো লবণ। প্রতি কেজি ১০ থেকে ১১ টাকা হিসেবে একেকটি চামড়ায় এই বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮৫ থেকে ১০৫ টাকা।

এবার কোরবানির ঈদের পর চামড়ার অস্বাভাবিক দরপতন নিয়ে তুমুল আলোচনা এখনো থামেনি। এই চামড়া বিক্রির অর্থ নি¤œআয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এবার ৩০০ থেকে ৮০০ টাকার ভেতরে গরুর চামড়া কিনেছেন। আর খাসি বা ছোট পশুর চামড়া কিনতেই চাননি।

তবে কম দামে কিনেও লাভ হয়নি। আড়তে গিয়ে অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু বেশি টাকা দাম শুনে মেজাজ ঠিক রাখতে পারেননি বহুজন। চামড়া এখানে সেখানে ফেলে দিয়ে ক্ষোভ মিটিয়েছেন। আর একাধিক মাদ্রাসায় জমা পড়া চামড়া পুঁতে ফেলার ঘটনা ঘটেছে।

এর মধ্যে সরকার বিদেশে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেয়। যদিও কোনো রপ্তানি এখানো করা যায়নি। আর এই সিদ্ধান্ত তখন আসে যখন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কম দামে চামড়া বেচে বা ফেলে দিয়েছেন।

এর মধ্যে প্রকাশ পায়, ট্যানারি মালিকরা আড়তদারদের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করছেন না। আর সে টাকা না পেলে তাদের কাছে চামড়া বিক্রি হবে না বলেও জানিয়ে দেন আড়তদাররা। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে ট্যানারি মালিকরা সব স্বীকার করেন। বকেয়া পরিশোধের অঙ্গীকার ও সময়ক্রমও জানান ট্যানারি মালিকরা।

অর্থাৎ এবার চামড়া সংগ্রহে ঠকেছে তিন পক্ষ। এক. চামড়ার অর্থ যাদের কাছে যায়, সেই গরিব মানুষ। দুই. কিছু চামড়া দান হিসেবে পাওয়া কওমি মাদ্রাসা। তিন. মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে আড়তদারদের লাভ হলো দুই দিকে। তারা কাঁচা চামড়া কিনে ব্যাপক মুনাফা করেছেন, আবার ৩০ বছরের বকেয়া আদায়েও প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন।

ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা এখন সরকার নির্ধারিত দামেই লবণ দেওয়া চামড়া কিনছি। যারা কাঁচা চামড়ার সঠিক দাম পায়নি তাদের ব্যাপারে আমরা তো বলতে পারব না। এখন তারা আমাদের কাছে বিক্রি করলে সরকার নির্ধারিত দামই পেত।’

কাঁচা চামড়া আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি দেলোয়ার হোসেন অবশ্য বেশ ভালো মুনাফার কথা স্বীকার করতে চান না। তিনি বলেন, ‘একটি চামড়ায় গড়ে ৮ থেকে ১২ কেজি লবণ দিতে হয়। চামড়া বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করতে হয়। যেসব চামড়া কেটে গেছে বা কোনো কারণে নষ্ট হয়েছে গেছে সেগুলোকে আলাদা করতে হয়। কাটাছেঁড়া চামড়া ট্যানারি মালিক কিনলেও এর দাম কম দেয়। এর উপর প্রতি বছরই আমাদের কেনা চামড়া থেকে নষ্ট হয় কিছু। তাই কাঁচা চামড়া আড়তদাররা বিপুল লাভ করছে এ কথা ঠিক না।’

এবার মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছে- এমন মন্তব্যের জবাবে দেলোয়ার বলেন, ‘আসলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কম দামে চামড়া কিনে বেশি লাভ করতে চেয়েছিল। এবার সেটা হয়নি।’

এই ব্যবসায়ী নেতার দাবি, এবার পোস্তায় গড়ে চামড়া কেনা হয়েছে ৭০০ টাকা করে। যদিও সমিতির সহসভাপতি জানিয়েছেন, তারা চামড়া কিনেছেন গড়ে ৫৫০ টাকা করে।

গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘এবার কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা কার্যকর করা হয়নি।’

তবে এবারের পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছি, যাতে আগামীতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ নিয়ে বড় ধরনের সংকট না হয়।’

বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় যে নীতিমালা হয়েছে সেই আলোকে কাজ করা হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ে যাতে ব্যবসায়ীরা মূল্য পায় সেজন্য কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হবে।

ঢাকাটাইমস/২৯আগস্ট/জেআর/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :