নগর কৃষি ও বনায়ন: বদলে দেবে ঢাকার চেহারা!

মো. শাহিন রেজা
| আপডেট : ০৫ মে ২০২০, ১০:১৯ | প্রকাশিত : ০৪ মে ২০২০, ১৯:৩৪

ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর প্রাচীন একটি শহর ঢাকা। চারশত বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বানিজ্যের নগরী। কিন্তু পরিকল্পনার অভাব ও অব্যবস্থাপনা্র জন্য এ শহর হারিয়েছে তার জৌলুস। ১৩৪ বর্গ মাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লক্ষ মানুষ (আদমশুমারী,২০১১)।

বর্তমানে জনসংখ্যা আরো অনেক বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ২ কোটির কাঁছাকাছি। প্রতি বর্গ মাইলে ১ লক্ষ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস ( উইকিপিডিয়া),বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লক্ষ হবে। কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার নগরী ঢাকাকে নিয়ে নেই সুষ্ঠু পরিকল্পনা। যানজট, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাবদ্ধতা, গাছ-পালার অভাব ইত্যাদি শহরকে দিনে দিনে হুমকির মুখে ফেলছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল কলেজ সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে ফলে পরিবেশের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ। জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৮ শতাংশ এবং বর্তমানে ৬-৭ শতাংশেরবেশি না (প্রথম আলো,২০১৯)।

ঢাকাতে যত পরিমাণে গাছ কাঁটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। ৮০ দশকের পর থেকে বৃক্ষ নিধন শুরু হয়েছে ফলে ঢাকার চেহারাও বদলাতে শুরু হয়। গাছ পালা আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। গাছ কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এ ছাড়াও বৃষ্টিপাত ঘটাতেও সহায়ক ভূমিকা রাখে।

গাছের ডাল, বাকল, পাতা অনেকে ঔষধ হিসাবেও ব্যবহার করে। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রীষ্মে ঢাকায় গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি থাকে। এছাড়াও অতি/অনা বৃষ্টি, ঝড়, বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। অপরিকল্পিত ভাবে বৃক্ষ নিধনের জন্য খরা ও বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় এবং এটিকেই অন্যতম কারন হিসাবে ধরা হয় পাঁচ হাজার বছর পূর্বের উন্নত সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের। ফলে বৃক্ষের প্রয়োজনীতা সহজেই অনুমেয়। বৃক্ষ ঢাকাকে ছায়া শীতল রাখতে সহায়তা করবে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরিতেও গাছ পালার অবদান রয়েছে।

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদার পরিমাণ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে ১৬ কোটি ৫৭ (বিবিএস,২০১৯) লক্ষ মানুষ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা জনবহুর শহরের তালিকায় ১১ তম স্থানে আছে। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর গ্লোবাল সিটিস ইনস্টিটিউশনের পরিচালিত একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বর তৃতীয় জনবহুল শহর(বাংলাদেশ প্রতিদিন)। বাংলাদেশের মোট জন গোষ্ঠীর ২১.৪ শতাংশ শহরে বাস করে ( বিবিএস, ২০১৯) যার সিংহভাগই ঢাকাতে।

ঢাকার মানুষ সাধারণত চাকরি, ব্যবসা, দিন মজুর, পরিবহন শ্রমিক, গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদনে তাদের প্রত্যক্ষ অবদান নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ৭৮.৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে ( বিবিএস,২০১৯) যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। এদিকে ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে ফলে ফসল উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিতে হবে বিভিন্ন পদক্ষেপ।

ঢাকা শহরের মানুষ কৃষিজাত পণ্যের জন্য সাধারণত গ্রামের উপর নির্ভরশীল। একটি গবেষনায় দেখা গেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে ১০০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে ( কৃষি তথ্য সার্ভিস) তাই নগরের জনসাধারণের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে নগর কৃষির উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকা শহরে কয়েক লক্ষ ছাদ রয়েছে যেখানে আম, আমড়া, জাম, লিচু, লেবু, কমলা, শসা ইত্যাদি চাষ করা যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নগর কৃষির মাধ্যমে তাদের শহর গুলোতে খাদ্যের যোগান দেয়। ঢাকা শহরের আশেপাশে যেমন সাভার, কেরানীগঞ্জ, উত্তর খান, দক্ষিন খান, টঙ্গী, ধামরাই, আশুলিয়া ইত্যাদি স্থানে পরিকল্পিত ভাবে কৃষি ফসল উৎপাদন, ডেইরী ফার্ম, হাঁস- মুরগী পালন, গরু ছাগলের ফার্ম, মৎস চাষ করে নগরের মানুষের খাদ্যশস্য, মসলা, সবজী, মাংস, দুধ, মাছ ইত্যাদির চাহিদার অনেক অংশে মেটানো সম্ভব। এর মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে। আবার সতেজ খবারও পাবে নগরবাসী। পরিবহন, বিপণনেও কোন সমস্যা দেখা দিবেনা।

আমাদের ইচ্ছা শক্তি ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে ঢাকা হবে সবুজের শহর। প্রতি বছর গাছ লাগানো কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং অকারণে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। রাস্তার পাশে, খোলা মাঠে, বাড়ির আশে পাশে পর্যাপ্ত বৃক্ষ রোপন করতে হবে। দিন দিন শহরের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে ২৫ শতাংশ বনায়ণ নিশ্চত করেই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

নগর কৃষি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে গবেষণা করে সহায়তা করতে পারে। সরকারকে উদ্যোক্তাদের ঋণ এর ব্যবস্থা করতে হবে ফলে অনেক তরুণ উদ্যোক্তাও তৈরি হবে। এছাড়া যানজট, জলাবদ্ধতা, বায়ু দূষণ রোধে ব্যাবস্থা নিতে হবে, প্রতিটি কাজ করতে হবে পরিকল্পিত ভাবে। ফলে একদিকে ঢাকা যেমন হবে সবুজে ঘেরা অন্যদিকে এ শহর নিজেই নিজের খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে, যা এই শহরের চেহারায় বদলে দিবে। বসবাস যোগ্য ও স্বাস্থ্য সম্মত শহরের তালিকায় স্থান করে নিবে ঢাকা শহর।

লেখক: মো. শাহিন রেজা, শিক্ষক ও নাগরিক সাংবাদিক

ঢাকাটাইমস/৪মে/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :