সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় চিন্তা প্রকাশে ডিজিটাল আইন কী বাধা?

হাসান শান্তনু
 | প্রকাশিত : ২১ জুলাই ২০২০, ১৮:১৯

‘স্যাটার্নিক ভার্সেস’ বইয়ে ‘ইসলাম অবমাননার’ অভিযোগে লেখক সালমান রুশদিকে কতল উন্মাদনা তুঙ্গে। কথিত ‘মুসলিম উম্মাহ’ ভয়ানক ক্রোধান্বিত। যুক্তরাজ্যেও এর ঢেউ। যুক্তরাজ্যের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার বলেন, ‘রুশদির বইটিতে যে ধরনের সমালোচনা আছে, শ্রেষ্ঠ ধর্মগুলোকে এর মোকাবেলায় টিকে থাকার মতো শক্তি থাকতে হবে’ (দ্য গার্ডিয়ান, ০৪.০৩.১৯৮৯ খ্রি.)।

'স্যাটানিক ভার্সেস' ভারতেও নিষিদ্ধ। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’র সম্পাদক অরুণ শৌরি তখন লেখেন-'ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়ার যুক্তিতে বইটি নিষিদ্ধ করা হলে কোরানও নিষিদ্ধ করা যায়। এতে এমন আয়াত আছে, যা অন্য ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়' (বাট হোয়াট অ্যাবাউট দ্য ভার্সেস দ্যামসেলভস, ১৯ অক্টোবর, ১৯৮৮ খ্রি.)।

মার্গারেট থেচারের বক্তব্য যে কোনো ধর্মের বেলায় সত্য। কোনো ধর্ম রক্ষা করতে আইন ও 'অনুভূতি রক্ষার রাজনীতির' দরকার নেই। মুক্ত সমাজে কোনো বইকে আইনি নিষেধাজ্ঞার জালে আটকানো সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি কোনো ধর্মের প্রধানতম বই নিষিদ্ধ থাকতে পারে না। অরুণ শৌরির মূল বক্তব্য ছিলো, ধর্মান্ধগোষ্ঠীর 'অনুভূতি নাশের' রাজনীতিকে প্রশ্রয় না দেয়ার।

এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাসের অমিল ধর্মগুলোর ইতিহাসের মতোই পুরনো। মুসলমানরা যা বিশ্বাস করেন, অন্যরা তা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করেন না। মুসলমানদের কাছে যিশু খ্রিষ্টের পিতার পরিচয় সম্পর্কে বিশ্বাস একরকম, খ্রিষ্টানদের কাছে আরেক রকম, ইহুদিদের কাছে ভিন্নরকম। একজন নবি সম্পর্কে তিনধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস তিনরকম। বিশ্বাসের বৈচিত্রেই তিনটি ধর্ম তিনরকম। যে কোনো ধর্মের বেলায়ই এটা সত্য। কার ধর্ম ঠিক, কারটা ঠিক নয়- তা বিচারের দায়িত্ব স্রষ্টার।

অন্য ধর্মের অনুসারীরা নিজের বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করলে মুসলমানদের ধর্মের 'অবমাননা' হয়, এটা খুব পুরনো ধর্মান্ধ কৌশল। এ দেশের এক শ্রেণির মওলানা হর-হামেশা সনাতন ধর্মের অনুসারীদের পূজা, দেব-দেবী নিয়ে বিষোদগার করছেন। তাদেরকে প্রশাসন কখনোই শাস্তি দেয়ার নজির নেই। এমনকি 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হওয়ার উদাহরণ নেই। অথচ আইনটি প্রণয়নের পর থেকে ফেসবুকে ইসলামকে 'কটাক্ষ' করায় অনেক সংখ্যালঘু গ্রেফতার, কারাভোগের শিকার হয়েছেন। গত সপ্তাহেও এক হিন্দু যুবক ফেসবুকে ইসলাম 'অবমাননার' অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন।

সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় আরেকটা পদ্ধতি গত কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে এ দেশে! ঘৃণ্য, বর্বরপন্থার জিহাদি মার্কা এ পদ্ধতির নাম ফেসবুকে রাষ্ট্রধর্মকে ‘অবমাননা’। রামু, রংপুর, নাসিরনগর, ভোলায় মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চলে ওই কায়দায়। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনের অধীনে গ্রেফতার হওয়া সংখ্যালঘুদের ফেসবুকের অভিযুক্ত স্ট্যাটাসে আসলে কী লেখা ছিলো, বা থাকে, সে সম্পর্কে দেশের বেশিরভাগ নাগরিকেরই কোনো ধারণা থাকে না।

প্রগতিশীল সমাজ ও নিরেট ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঙ্ক্ষী তরুণ প্রজন্ম প্রায়ই দেখে, লুঙ্গি পরিহিত রাষ্ট্রের কোমরে 'ধর্মের তাবিজ' লটকানো আছে। সংখ্যাগুরুদের বাহবা পেতে 'ধর্ম অবমাননার' অভিযোগে সংখ্যালঘুদের গ্রেফতারের ঘটনায় লুঙ্গির গেরোটা ঢিলে হয়ে নাভির নিচে নেমে গেলে রাষ্ট্রের কোমরে তাগা বা গুনশিতে লটকানো 'বিশেষ ধর্ম রক্ষার কবচ'টা স্পষ্ট দেখা যায়।

ধর্ম বিশ্বাস নিঃসন্দেহে নিষ্পাপ। যে কারো কাছে নিজ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হিমালয় সমান উঁচু। ধর্মের অবস্থান পৃথিবীর মাটি থেকে আকাশ বা সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত। ছোট্ট টুনটুনি পাখি ডানা ঝাপটে ভাঙতে চাইলে হিমালয়ের কিছুই হবে না। পাখিটাই আহত হবে। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীর বক্তব্যে কোনো ধর্মের অবমাননা, ক্ষতি হয় না। ধর্ম আগের মতো একই অবস্থানে থাকে। এটাই প্রকৃত বিশ্বাসীরা মনে করেন।

তবু এ দেশের ধর্মান্ধদের কথিত বিশ্বাস দুর্বল, যা নিতান্তই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। তাক করা চাপাতি, গ্রেফতার, মিছিল বা সমাবেশের রাজনীতি ধর্মান্ধগোষ্ঠীর স্বার্থে; ঈশ্বরের স্বার্থে নয়। কারো বিরোধিতায় ধর্মের নাশ হয় না, আবার চাপাতি, কতল, গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বিকাশও ঘটে না। মধ্যখানে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের প্রকাশ ঘটে, ফায়দা নেয় ধর্ম ব্যবসায়ীরা, সমাজকে কলুষিত করে আদিম বর্বরতা।

লেখক: সাংবাদিক

ঢাকাটাইমস/২১জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :