আপনার এত জ্বলে কেন… জনাব...
সরকারি চাকুরি করি তাও আবার পুলিশে, সংগত কারণেই চামড়া একটু মোটা হতে হয়। সহজে কিছুতে প্রতিক্রিয়া জানাই না, চুপ থাকার চেষ্টা করি। তার ওপর আবার রোজার মাস, সংযমের মাস, চাই না কারণে বা অকারণে কাউকে কষ্ট দিতে। কিন্তু সবসময় চুপ থাকাটা মনে হয় ঠিকও না। সে জন্যই এই অসময়ে ফেসবুকে লিখতে বসলাম।
প্রফেসর ড. বদরুজ্জামান ভুঁইয়া (নামের বানান ভুল হলে দুঃখিত), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত ভিসি মহোদয়ের একটি সাম্প্রতিক ছবি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। সেটি নিয়েই দুয়েকটি কথা বলতে চাই। মাত্র একবারের দেখায় উনাকে যৎসামান্য জানি তাতে তাকে একজন বিনয়ী ও সদালাপী মানুষ বলেই মনে হয়েছে। বাস্তবে উনি কেমন মানুষ, কতটুকু যোগ্য বা অযোগ্য আমি তা জানি না, জানাটা দরকারও নয় আমার। সেটা আমার লেখার বিষয়ও না।
আমি মোটামুটি একজন মনোযোগী পাঠক। কেউ কিছু লিখলে বিশেষ করে সেটি যদি আমার মনঃপূত না হয় তবে তা খুঁটিয়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করি আমার ভুলটা কোথায়।
ভিসি মহোদয়ের ছবি নিয়ে যারা ট্রল করছেন তাদের বক্তব্যের মূল সুরটা বোধহয় এমন যে, ভিসির মতো উচ্চ সামাজিক মর্যাদার একজন সম্মানীয় ব্যক্তি কেন তার ব্যক্তিগত সুখস্মৃতিকে এভাবে উদযাপন করবেন? কেউ কেউ বলেছেন তৈলমর্দন করে ভিসি হওয়া ব্যক্তি এর চেয়ে বেশি আর কি সদাচারী হবেন? কোনো কোনো বিদগ্ধ পণ্ডিত মন্তব্য করেছেন যে, শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতি অনিয়মে ছেয়ে গিয়েছে, কাজেই সেখানকার ভিসিরা তো এমনই হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে আমি বুঝি যে, যিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছেন তিনি তার জীবনের কোর স্মৃতিগুলো সামাজিক মাধ্যমে সাধারণত শেয়ার করেন। করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, কিন্তু করলে দোষের কি এটা বোঝার মতো ঘিলু আমার মস্তিষ্কে রাব্বুল আলামিন দেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের জন্য ভিসি হওয়াটা নিঃসন্দেহে একটি স্মরণীয় ঘটনা। একজন সরলচিন্তার স্বাভাবিক মানুষ তার লক্ষ্যে পৌঁছলে তাকে তার স্বজন-শুভানুধ্যায়ীরা ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিনন্দিত করেন এটা মোটামুটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। সেটির ছবি তোলা হয় এবং সে ছবি যদি কেউ তার টাইমলাইনে দেন তো সেটা দোষের কি এবং এর মাধ্যমে কি রসাতলে গেল আমি বুঝলাম না।
মানুষ স্বভাবগতভাবেই স্মৃতিকাতর, মানুষ তার জীবনের কোর স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে চায়, এটা স্বাভাবিক। সেটা যদি কারো কষ্টের কারণ না হয়, সেটা যদি দুর্বিনীত না হয়, সেটার মধ্যে যদি কোনো দৃষ্টিকটু লোক দেখানো ভাব না থাকে তাতে কারো কারো এত জ্বলে কেন!! যাদের জ্বলে তাদেরকে কি কেউ কখনো শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানান না, নাকি তারা কাউকে শুভেচ্ছা জানান না, নাকি তাদের জীবনে শুভেচ্ছা পাবার বা জানানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটে না? নাকি কারো জীবনের কোনো উদযাপনের উপলক্ষ দেখলে তাদের মনে হয়, আরে আমি তো এর চেয়ে অনেক যোগ্য, আমি পারলাম না, আর সে কেন পারছে!!
আমি আসলে ঠিক বুঝলাম না। আমাদের চারপাশে একশ্রেণির অতি সুশীল ব্যক্তি আছেন এরা কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিষ্ঠিত মানুষকে নিয়ে আড়ালে-আবডালে ট্রল করে এক ধরনের বিকৃত মজা পান। আমার আপত্তি থাকতো না যদি এরা সেইসব প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদেরকে সবসময় এড়িয়ে চলতেন। তখন অন্তত বুঝতাম যে তার মানসিকতা ঠিক বা ভুল যাই হোক অন্তত সে এথিক্যালি কোরাপ্ট না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এসব ক্ষমতাসীনদের (তাদের ভাষায়) সাথে ওয়েল কানেক্টেড থাকতে পছন্দ করে এবং থাকার জন্য অনেক মেহনত করে। নিজের প্রয়োজনে তাদের কানেক্টিভিটি ব্যবহারে এদের বেশিরভাগেরই জুড়ি মেলা ভার।
বাংলা ভাষায় ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে একটা শব্দ আছে। অনেক ভাষাতেই সরাসরি এমন সেন্সের শব্দ নেই। ভাষার আর দোষ কি!! ভাষা তো আসলে কোনো একটি জনপদের-জনগোষ্ঠীর চরিত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে!!
আমাদের ছোটবেলায় ঈদে পার্বণে উপহার হিসাবে ভিউকার্ড নেওয়া-দেওয়ার প্রচলন ছিল। নায়ক-নায়িকা, শিল্পী সেলিব্রেটি, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী থেকে শুরু করে কবি-সাহিত্যিকদের ছবি ভিউকার্ড হিসাবে বেশি জনপ্রিয় ছিল। ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি জনপ্রিয় ভিউকার্ড ছিল, যাতে লেখা থাকতো ‘ফুলেরও জলসায় নীরব কেন হে কবি!!’
ভিউকার্ডটিতে চারদিকে ফুলের মাঝে কবি চুপচাপ বসে আছেন।
ভাগ্যিস সে আমলে এত সুশীল ছিল না, ফেসবুক ছিল না, থাকলে হয়তো বলতো, গেলো রে গেল, জাত গেল, একজন কবি কেন ফুলের মধ্যে বসে লোকদেখানো ছবি তুলবে!! একজন কবি কেন এত সাধারণ হবে!!
সংযমের মাসে কাউকে আঘাত করতে চাই না। খুব বিনয়ের সাথে বলি মানুষকে তার স্বাভাবিক জীবনটা যাপন করতে দেন। সাধ-আহলাদ সবারই থাকে, যেকোনো মানুষ তার অর্জনকে তার প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখতে বা ধরে রাখতে চায়। এতে দোষের কি?
তারপরও যদি আপনার কাছে দোষের মনে হয় তো বলি, আপনাকে দেশোদ্ধার করার দায়িত্ব কে দিয়েছে, কে বানিয়েছে আপনাকে জাতির বিবেক, প্রিয় জনাব/জনাবারা????
মানুষের আনন্দে আপনার এত জ্বলে কেন? আর যদি জ্বলেই তো নিজে জ্বলুন, অন্যকে জ্বালাতে আসেন কেন?
অন্যের নির্দোষ আনন্দে হিংসা করলে তাতে তার কোনো ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হতে পারে আপনার, কারণ যাকে হিংসা করা হয় সে নয় হিংসুকই পুড়ে মরে হিংসার অনলে।
আসুন হিংসা নয় ভালোবাসা ছড়াই। আর যদি একান্তই কারো আচরণে দৃশ্যমান কোনো অসংগতি থাকে তো সম্ভব হলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে নক করে শুধরে দেন। যদি সে আপনার বলয়ের বাইরের হয় তো তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না প্লিজ।
যে সভ্যতার দোহাই দিয়ে আপনারা এভাবে ট্রল করছেন সেসব সভ্যদেশে যাবার, থাকার এবং কিঞ্চিৎ কাজ করবার সুযোগ আমার হয়েছে। সভ্যদেশের আইনে কাউকে এভাবে অবমাননা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। নিজের আগ্রহের কারণেই বুড়া বয়সে এসে গাঁটের পয়সা খরচ করে ব্রিটিশ ল তে ইউকে থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি। খুব বিনয়ের সাথে মোটামুটি ভালোভাবে পাস করা আইনের ছাত্র হিসাবেই বলছি কারো ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে তাকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করা `ল অব ডিফেমেশন ‘-এর সরাসরি ভায়োলেশন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনাদের সৌভাগ্য যে আপনারা আপনাদের ভাষায় তেমন সভ্যদেশে বাস করেন না।
মানুষকে অসম্মান নয় সম্মান করতে শিখুন, রাব্বুল আলামিন আপনাকেও সম্মানিত করবেন, যাকে ঈর্ষা করেন হয়তো তার চেয়েও বেশি সম্মান দিবেন। আমি আনপড়াহ মানুষ, নিজের জ্ঞানবুদ্ধি কম। তাই দেয়ালের লিখন থেকে একটা বাণী বলি!!
"মানুষকে অপমান করতে কোনো শিক্ষা বা যোগ্যতা লাগে না, কিন্তু সম্মান করতে গেলে লাগে"। আপনারা যারা কথায় কথায় বুলি কপচান তারা তো শিক্ষিত মানুষ, যোগ্য মানুষ, তো আপনারা একজন সম্মানীয় মানুষকে কেন অসম্মান করেন!!
আপনাদের এত জ্বলে কেন?
আমার খুউব জানতে ইচ্ছে করে, খু উ ব....
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা