প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ কমে যাচ্ছে
দেশে মৎস উৎপাদনে বিপ্লব ঘটছে। মৎস উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে প্রাণীজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মাছ থেকে। বাংলাদেশের প্রকৃতি, জলাশয়ের বিস্তৃত অঞ্চলের আধিক্য ও নদী মাতৃকতা মাছ চাষের জন্য একটি অনুকুল জায়গা বলে বিবেচিত হয়ে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। আট শত প্রজাতির মাছের মধ্যে দেশীয় জাতের মাছ ২৫০ এর অধিক এবং সামুদ্রিক মাছ ৪৫০ প্রজাতির বলে ধারণা করা হয় ।
এর মধ্যে দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় ৬৪ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে বা কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। চাষ যোগ্য দেশীয় মাছের হার বৃদ্ধির কারণে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরকারের মহা পরিকল্পনার কারণে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ উৎপাদনে বড় সফলতা এসেছে এবং এর ফলে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে প্রথম স্থানেই রয়েছে ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী।
এবার মৎস সপ্তাহ পালন হলো ‘বেশি বেশি মাছ চাষ করি, বেকারত্ব দূর করি’ এই স্লোগানে। দারুন একটি স্লোগান হলেও মাছ শুধুমাত্র চাষের ক্ষেত্রে যতটা আগ্রহ বাড়ানো হচ্ছে এবং চাষকৃত মাছের বিপণন সম্পর্কে যতটা এগিয়ে আসছে মৎস অধিদপ্তর ততটা কি প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ নিয়ে ভাবছে?
প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ কমে যাচ্ছে, শিল্পাঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ খাল, নদী ও শাখা নদীগুলোতে এখন একটি জলজ প্রাণীও জন্ম নেয়না সেখানে মাছতো অনেক দূরের চিন্তা! আর যদিও কোনো জায়গায় মাছ পাওয়া যায় তার দেহে অবশ্যই ভারি ধাতুর কন্টামিনেশন পাওয়া যাবে ।
এ অবস্থায় প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর মাছ কমে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে জলবায়ুর পরিবর্তন, পানির স্পেশিফিকেশনাল পরিবর্তন, মাটি দূষণ, পানি দূষণ, নদী ও জলাশয়ের গতিপথ পরিবর্তন, জমিতে কীটনাশক ব্যবহার, মাছের প্রজননে বাধাগ্রস্থ মূল কারণ হিসেবে উপস্থাপিত হবে।
এই কারণগুলোর সমন্বিত রুপের যে ভয়াবহ দিকটি তা হলো প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের বিলুপ্তি ! ঢাকার অদূরে গাজীপুর। গাজীপুরের তুরাগ এবংশীতলক্ষ্যা ধুকে যাচ্ছে অনেকদিন থেকে। বাস্তু সংস্থানের সবগুলো ধাপই ভেঙ্গে পড়েছে এই দুই নদীর। শীতকালে পানি বিহীন নদীতে যখন ফ্যাক্টরীগুলোর বিষের নহর বয়ে চলে তখন মাছগুলো মরে মরে ভেসে ওঠে। আমরা ধারণা করি যে পানিতে ডিসলভ অক্সিজেন কমে যাচ্ছে কোনো কেমিক্যালের কারণে হয়ত এজন্যই মাছগুলো মরে যাচ্ছে! কিন্তু এ নিয়ে আরও বেশি ও বিস্তর এনালাইসিস প্রয়োজন।
পানিতে যে কারণে মাছ কমে যাচ্ছে তা কি শুধুই দূষণ নাকি দূষণের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব। একবার মাছ মরে যাবার পর পরের বর্ষাকালেও আর আশানুরুপ মাছ পাওয়া যায় না। কারণ মাছ হয়ত বংশ বিস্তারের ক্ষমতা হারায় এবং জীবন যুদ্ধে টিকতে না পেরে তাদের আবাস স্থল ত্যাগ করে । ২০১৬-১৭ সালে হালদাতেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। সেখান থেকে হালদার অবস্থা কিছুটা ফিরছে কয়েকটি সংগঠনের একসাথে কাজ করার ফলে। কিন্তু হালদার মতো অন্য কোনো নদীর ক্ষেত্রে তা ঘটছে না।
নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের দেশী মাছ বাঁচাতে ইলিশের মতই পদক্ষেপ নিতে হবে।
নদী দূষণতো রুখতে হবেই সাথে সাথে শিল্পায়নের পরিকল্পনায় আনতে হবে বড় ধরণের পরিবর্তন। আমরা ইচ্ছে করলেও একটি সময়ে গিয়ে পরিকল্পিত শিল্প নগরী ছাড়া শিল্পায়ন করতে পারব না। সুতরাং এখন থেকেই এ কাজগুলো শুরু করা প্রয়োজন।
এ বিষয়গুলোর সবকিছুই আইনে আছে, নীতিমালায় আছে কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো মন্ত্রনালয় হয়ে কাজ এগুতে গিয়ে থমকে যায় সব। আগে পরিকল্পনা করে শিল্পায়ন না করলেও গাজীপুর, সাভার, নারায়নগঞ্জের সব শিল্পকে একটি নির্দিষ্ট শিল্পায়ন অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে আস্তে আস্তে জোন ভাগ করে দেওয়া হোক। প্রতিটি জোনের মুখে সেন্ট্রাল ইটি, এসটিপি ও ওয়েস্ট ডাম্পিং এড়িয়া নির্মাণ করা হোক। এতে করে নদী দূষণ কমে যাবে অনেকটাই।
কৃষকরা সার বিষ ব্যবহারে কিভাবে জৈবিক পরিবর্তন আনবে তা আরও গবেষনার আওতায় আনা প্রয়োজন। এ ব্যপারে সচেতনতা সৃষ্টিও বড় বিষয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক যে বিষয়গুলো সামনে আসবে তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনের কারণ গ্রীণ হাউজ গ্যাস ও কার্বণ নিঃস্বরণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা ভূমি। নদীর তলদেশে তাপমাত্রার কি পরিবর্তণ হচ্ছে এবং এটি কি সরাসরি ডিও এর উপরে প্রভাব ফেলছে কিনা এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
দেশীয় মাছকেও রক্ষা টেকসই পরিবেশ উন্নয়নের প্রধান ভাবনার মধ্যে একটি হওয়া উচিৎ। শুধু কারণ বিশ্লেষণ নয় এর সাথে প্রয়োজন পরিকল্পনার সঠিক প্রণয়ন। মৎস উৎপাদনে আমাদের সাফল্যকে উৎসাহ হিসেবে নিয়ে দেশি মাছ উৎপাদনের চ্যালেঞ্জটিকে উৎসাহ হিসেবে নিতে হবে। মাছে ভাতে বাঙালি কথাটি শুধু মাছ খাওয়া ও বিপণন নয় এর সাথে রয়েছে অনেক মানুষের জীবিকার ব্যপার। এই জীবিকাকে কাজে লাগাতে হলে নদী পাড়ের মানুষদের নদী রক্ষায় উদ্যোগী করে তুলতে হবে। দূষিত অঞ্চলের দূষণ কমাতে নির্দিষ্ট প্রকল্প নিয়ে নিয়ে এগুতে হবে।
আশা করি এ বিষয়গুলো নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, মৎস অধিদপ্তর একসাথে কাজ করবে।
লেখক: রসায়নবিদ ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক
ঢাকাটাইমস/৯সেপ্টেম্বর/এসকেএস