নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দাবি নোয়াবের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২:৫৬

নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি, বিজ্ঞাপন আয়ের উৎসে কর কমানোর দাবি জানিয়েছে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। সংবাদপত্র শিল্পের টিকে থাকার স্বার্থে সরকারের কাছে এ দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। একইসঙ্গে এ খাতের করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি।

রবিবার বিকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের জন্য অংশীজন সভায় এ দাবি জানান নোয়াব সভাপতি এ. কে. আজাদ। এটি ছিল আগামী অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের অংশীজন সভার প্রথম বৈঠক। এই বৈঠকের পর এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সংবাদপত্র শিল্পের করপোরেট কর কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। করের আওতা বাড়াতেও অবদান রাখছে। ফলে সংবাদপত্র শিল্পকে সহায়তা করতে অসুবিধা নেই। পাশাপাশি সংবাদপত্রকে শিল্প ঘোষণার পরেও সংবাদপত্রের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে আগাম আয়কর কেন রাখা হয়েছে তা পর্যালোচনা করা হবে। সেখানেও কোনো সুযোগ দেওয়া গেলে বিবেচনা করবে এনবিআর।’

আলোচনার শুরুতে বক্তব্য দেন নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ। তিনি বলেন, ‘মুদ্রণ পত্রিকা এখন ডিজিটালে রূপান্তর হচ্ছে। বিশ্বে প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা ভালো নয়। সার্কুলেশন, বিজ্ঞাপন আগে থেকেই কম ছিল। করোনা সেই পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ বিক্রি মূল্যের কয়েক গুন। বিজ্ঞাপন আয় দিয়ে উৎপাদন খরচের ঘাটতি পূরণ করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে বিজ্ঞাপন আয় ব্যাপকভাবে কমে গেছে।’

বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরে আজাদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নিউজপ্রিন্টের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেড় বছর আগে প্রতিটন কাগজ ৫৭০ ডলারে পাওয়া গেলেও বর্তমানে কিনতে হচ্ছে ৮৯০ ডলারে। এদিকে করোনার আগে গড়ে বার্ষিক ২০ শতাংশ হারে বিজ্ঞাপন বাজার সংকুচিত হচ্ছিল। করোনার পরে বিজ্ঞাপনের বাজার সংকুচিত হয়েছে ৫৫ শতাংশ।

এ কে আজাদ বলেন, ২০১৪ সালে সংবাদপত্রকে সেবা শিল্প হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল যুগে ছাপা সংবাদপত্র রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে। সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। করোনার এই সময়ে সরকারের কোনো প্রণোদনা পায়নি। সংবাদপত্র সেবা শিল্প হওয়া সত্ত্বেও প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, অনিবন্ধিত কোম্পানি ও নন-রেসিডেন্সিয়াল ক্যাটাগরিতে রেখে কর্পোরেট ট্যাক্স ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক মুনাফা অর্জনকারী শিল্পের কর্পোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। সংবাদপত্রের মত রুগ্ন শিল্পের কর্পোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত না।

নোয়াব সভাপতি বলেন, সংবাদপত্রের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট, যা মোট খরচের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ অনুযায়ী সংবাদপত্র ভ্যাট অব্যহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকাভুক্ত। কিন্তু নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। নোয়াব মনে করে এ ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া উচিত। যদি কোনো কারণে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট রাখতে হয়, তাহলে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ করা যেতে পারে।

আজাদ জানান, সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর ৪ শতাংশ উৎসে কর (ট্যাক্স ডিটাকটেড অ্যাট সোর্স-টিডিএস) রয়েছে। আবার উৎসে স্থলে কাঁচামালের উপরে ৫ শতাংশ আগাম আয়কর (এআইটি) দিতে হয়। সম্প্রতি বিজ্ঞাপন আয় কমেছে। কাঁচামাল আমদানি খরচ বেড়েছে।

এ অবস্থায় সংবাদপত্রকে টিকিয়ে রাখতে তিনি টিডিএস ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং এআইটি সম্পূর্ণভাবে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই সভাপতি আরও বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা আয়কর নিজে পরিশোধ করে। কিন্তু সংবাদপত্রের ওয়েজবোর্ড অনুসারে কর্মীর আয়ের ওপর যে আয়কর হয়, তা প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করতে হয়। তিনি ওয়েজ বোর্ডের ক্ষেত্রে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৫০ ধারা প্রয়োগের দাবি করেন। অর্থাৎ কর্মী তার নিজের আয় থেকে কর পরিশোধ করবেন।

আজাদ বলেন, সংবাদপত্রের ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী কর্মী মূল বেতনের ৭০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়। আর আয়কর আইন অনুযায়ী বাড়ি ভাড়ার ৫০ শতাংশ করমুক্ত। তিনি সংবাদপত্রের কর্মীদের বাড়ি ভাড়ার পুরোটাই কর মুক্ত করার প্রস্তাব করেন।

এ. কে. আজাদ বলেন, এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। নোয়াব যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে তিনি এনবিআরের সহযোগিতা কামনা করেন।

ডেইলি স্টার সম্পাদক ও নোয়াবের নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহফুজ আনাম বলেন, এনবিআর হয়ত বলবে তারা রাজস্ব সংগ্রহ করে। কিন্তু আমরা বলব, সংবাদপত্রকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা না হলে শিল্পটি বাঁচবে না। রুগ্ন হয়েও সর্বোচ্চ কর্পোরেট কর দিতে হচ্ছে। কর্মীদের বাড়ি ভাড়ায় কর দিতে হচ্ছে। কিন্তু করোনার মত সংকটকালীন সময়ে সরকারের প্রণোদনা পায়নি এ খাত।

মাহফুজ আনাম বলেন, দেশের অর্থনীতি অনেক এগোচ্ছে। বাজেট অনেক বড় হয়েছে। সংবাদপত্র থেকে সামান্য রাজস্ব পায় সরকার। ফলে সামাজিক সেবা বিবেচনায় এ খাতকে কর ছাড় দেওয়ার দাবি করেন তিনি।

এসময় এ. কে. আজাদ বলেন, নোয়াবের এক হিসাবে দেখা গেছে দেশের সংবাদপত্র থেকে মাত্র ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আসে। এটা মোট বাজেটের ক্ষেত্রে খুবই সামান্য। ফলে সরকার এ খাতকে সহযোগিতার জন্য করমুক্ত ঘোষণা করা যেতে পারে। এতে সংবাদপত্র আরও সহজলভ্য হবে। দেশের রাজস্ব সংগ্রহ অবশ্যই বেশি হওয়া উচিত। দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ কোটি লোক কর দেওয়ার উপযুক্ত হবে বলে ধারণা করা যায়। তবে এসব মানুষকে করের আওতায় আনতে ডিজিটাল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

এ. কে. আজাদ বলেন, করের হার কমাতে হবে। যখন কেউ দেখে একজন ব্যবসায়ী তার ডিভিডেন্ড আয় থেকে ৩৭ শতাংশ কর দিচ্ছেন, তখন সে আর করের আওতায় আসতে চায় না।

বণিক বার্তার সম্পাদক ও নোয়াবের নির্বাহী কমিটির সদস্য দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, রয়টার্স বা এ ধরনের বিদেশি এজেন্সি থেকে যেসব নিউজ কেনে বাংলাদেশের সংবাদপত্র, সেগুলোর মূল্য পরিশোধে ২০ শতাংশ উৎসে কর ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। তিনি এই উৎসে কর ও ভ্যাট প্রত্যাহার চান।

অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন(এটকো) পক্ষে বক্তব্য দেন সিনিয়র সহ-সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তিনি বলেন, এক সময় বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপনের ভ্যাট, ট্যাক্স কেটে রেখে বিল পরিশোধ করতো। ফলে টেলিভিশনগুলোর বিজ্ঞাপন বিলের ভ্যাট ও কর পরিশোধ করতে হত। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞাপনদাতাদের পরিবর্তে ভ্যাট, আয়কর বিলের সাথে যোগ করে পরিশোধ করছে, আর এগুলো পরিশোধ করতে হচ্ছে টেলিভিশনগুলোকে। তিনি আগের মতো বিজ্ঞাপনদাতাদের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের বিলের ভ্যাট, ট্যাক্স কাটার বিধান করার প্রস্তাব করেন।

পাশাপাশি বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার, দেশে যেসব আন্তর্জাতিক খেলা অনুষ্ঠিত হয়, তার বিজ্ঞাপনের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করেন। একইসঙ্গে সেট টপ বক্স ব্যবস্থার প্রচলন সহজ করতে কিছু দিনের জন্য এ পণ্য আমদানিতে কর অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান।

সভা শেষে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, সংবাদপত্রের মালিকদের দাবিগুলোর কিছু বিষয় ওয়েজবোর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেগুলো ওয়েজবোর্ডের মাধ্যমেই সমাধান হবে। আর যেসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার জন্য ন্যূনতম কর বা ভ্যাট রাখতে হয় সেগুলোই রাখা হচ্ছে। এরপরও কোনো সুযোগ থাকলে সংবাদপত্র শিল্পকে সে সহযোগিতা করা হবে।

দেশে আন্তর্জাতিক খেলার বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এনবিআর অনেক চাপে থাকে। দেশে আন্তর্জাতিক খেলার আয়োজক যারা থাকে অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, ক্রিকেট বোর্ড সবাই এসে ধরে। তাদের বক্তব্য এসবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করা হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রে পারা যায় না।

অনুষ্ঠানে এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি) মাসুদ সাদিক, সদস্য (ভ্যাট নীতি) জাকিয়া সুলতানা, সদস্য (আয়কর নীতি) সামস উদ্দিন আহমেদ বক্তব্য রাখেন। এছাড়া সদস্য আব্দুল মান্নান শিকদার, প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, শাহীন আক্তারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

(ঢাকাটাইমস/৬ফেব্রুয়ারি/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :