যে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি...

মেহেদী হাসান হাসিফ
| আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২২, ১৫:৩৯ | প্রকাশিত : ২৮ আগস্ট ২০২২, ১৫:১৮

আব্বার হঠাৎ অসুস্থতায় দিক দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছিলাম। কি করব, না করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরপর আরিফুর রহমান দোলন ভাইয়ের সার্বিক পরামর্শে আব্বাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা করলাম। প্রথম যেদিন আব্বাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম সেদিন থেকে আব্বার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমাদের পাশে থেকে যা যা করেছেন দোলন ভাই তার জন্য আমরা তার কাছে আজীবন চির কৃতজ্ঞ থাকব।

ঈদুল আজহার ১০ দিন আগে আব্বা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমত মেনে নিতে পারিনি আব্বা এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কিন্তু বাস্তবতা সর্বদাই অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভয়ংকর। ফোন করলাম দোলন ভাইকে। বললাম ভাই আব্বা খুব অসুস্থ, কি করব বুঝতেছি না। আব্বার চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন সাথে সাথেই ভাই বললেন ঢাকায় নিয়ে আয়। এখন গ্রামে রাখার সময় নেই। দ্রুত নিয়ে আয় ঢাকায়।

আমার বড়ভাই জাহিদুল ইসলাম বাপ্পি (কাতার প্রবাসী) ও দাদা পরামর্শ করে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে আব্বাকে ভর্তি করাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। দোলন ভাইও সম্মতি জানায় এবং দুপুর ২টার দিকে আব্বাকে নিয়ে অ্যাম্বুলন্সে করে রওনা করি। আমাদের পৌঁছানোর কথা রাত ৮টার দিকে থাকলেও ঈদের সময়কার রাস্তায় জ্যামের কারণে রাত ১০টায় গিয়ে পৌঁছাই। পৌঁছে দেখি দোলন ভাইয়ের পায়ের যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও তিনি বিগত ২ ঘণ্টা যাবৎ হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষা করছেন।

আব্বাকে হাসপাতালে প্রবেশ করিয়ে দোলন ভাই নিজে থেকে আমার সাথে হাসপাতালের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিকিৎসক আব্বার বুকের সিটি স্ক্যান করে ফুসফুসে কোভিডের নমুনা পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, সেখানে চিকিৎসা হবে না, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এই বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। এর উপযুক্ত প্রতিবাদ করারও চেষ্টা করেন দোলন ভাই।

তারপর আরেকটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে আমরা আব্বাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। আমাদের সহযোগিতার জন্য সাথে দেওয়া হয় ঢাকা টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক আশিকুর রহমান ভাইকে। দোলন ভাইয়ের নির্দেশে তিনি তাৎক্ষণিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আব্বার ভর্তি ও সিটের ব্যবস্থা করে দেন।

আব্বাকে প্রথমে জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, আব্বার কোভিডের কোনো উপসর্গ নেই। তারপর চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুইদিন রাখা হয়। ঈদের মধ্যে তেমন চিকিৎসকরাও নেই। বিরক্ত হয়ে আব্বাকে নিয়ে গেলাম রামপুরা ডেলটা হাসপাতালে। কারণ, আব্বার জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।

সেখানে এসে সেই রাতেই চিহ্নিত হলো আব্বা ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং ডেঙ্গুর ভয়ানক অবস্থায় আছে। প্লাটিলেট ৭,০০০ এ নেমে এসেছে। যেখানে স্বাভাবিক সর্বনিম্ন ১,৫০,০০০ থাকা প্রয়োজন। এই হাসপাতালে থাকা অবস্থায় দোলন ভাই প্রায় প্রতিদিনই আব্বাকে দেখতে গিয়েছেন এবং ডাক্তারদের সাথে প্রতিদিনের শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। তখন দোলন ভাই আর আমাদের দাদা প্রয়াত মিজানুর রহমান অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন।

রাত ৩টায় ডাক্তার জানান, জরুরি রক্তের প্রয়োজন। সময় চাইলাম সকাল পর্যন্ত। রাতে দোলন ভাইকে মেসেজ দিয়ে রাখি যে, ভাই জরুরি রক্তের প্রয়োজন। ঈদের সকালে নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পাঠিয়ে রক্তের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন তিনি। কোরবানির ঈদের দিন বাসা থেকে দোলন ভাই নিজে ঈদের রান্না করা মাংস নিয়ে হাসপাতালে এসে সবাইকে খাইয়েছেন। সময়ের হিসাব না করে আব্বার সাথে বসে গল্প করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দোলন ভাই আব্বার খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন।

এখান থেকে একটু ভালো দেখে ১৮ ব্যাগ প্লাটিলেট প্লাজমা দেওয়ার পর ৬০,০০০ এ এসে দাঁড়ায়। তারপর সব মিলিয়ে প্রায় ২০ দিন পর ডাক্তারের পরামর্শে বাড়িতে নিয়ে যাই। এরপর প্রায় দশদিন বাড়িতে থাকার পর আমার বড় ভাইয়া বাপ্পি কাতার থেকে দেশে আসেন। এরপর আবারও আব্বার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎক কিন্তু আব্বার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, তাতে এখানে দায়িত্বরত চিকিৎকরা আব্বাকে রাখতে চাইলেন না। রাখতে না চাওয়ায় নিয়ে গেলাম ধানমন্ডি ইবনেসিনা হাসপাতালে। সাথে ছিলাম আমি, ভাইয়া এবং মা। সার্বক্ষণিক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরামর্শ দিয়ে দোলন ভাইও ছিলেন পাশে।

সেখানে আব্বাকে ভর্তি করানোর সময় হঠাৎ টাকার প্রয়োজনে দোলন ভাইকে ফোন দেই। শুধু বলি, ভাই টাকা দরকার। ভাই শুধু একবার জিজ্ঞেস করেন, কতো লাগবে? আমি বলি, জানি না, তবে এখনই লাগবে। কারণ, তখনও ভাইয়ার কাতার থেকে ছেড়ে আসা টাকা একাউন্টে যুক্ত হয়নি।

দোলন ভাই ১০ মিনিট সময় চাইলেন এবং তার গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে কার্ড পাঠিয়ে দিলেন আর পিন আমাকে মেসেজ করে দিলেন। নিশ্চিন্ত হলাম। ভর্তি করানো হলো আব্বাকে।

তারপর ৬ দিন আব্বা ইবনেসিনা হাসপাতালে ভর্তি থাকেন। দিন দিন আব্বার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। দোলন ভাই সব সময় আমাকে, ভাইয়াকে ও মাকে সাহস দিতেন। এবং এখানেও যাতে চিকিৎসা ভালো হয় সে জন্য হাসপাতালের ম্যানেজারের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন।

২১ আগস্ট শনিবার বেলা ১০টার দিকে চিকিৎসারত অবস্থায় আব্বা একদম আমার চোখের সামনে ঘুমিয়ে গেলেন। কিচ্ছু বুঝতেও দিলেন না।

খবর পাওয়ার সাথে সাথেই দোলন ভাই ছুটে এলেন। তখন আব্বাকে গোসল করানোর জন্য মোহাম্মদপুর মার্কাজে নেওয়া হয়েছে। অনেক আত্মীয়স্বজনও এসেছেন। কিন্তু দায়িত্ব তো আর সবাই নিতে পারেন না। দোলন ভাই এবং দাদা অ্যাম্বুলেন্স এবং একটা গাড়ি ঠিক করে দিলেন গ্রামে যাওয়ার জন্য। ফেরিতে যেন অপেক্ষা না করতে হয় সেই ব্যবস্থাও করে দিলেন।

সবসময় যে মানুষটা আমাদের দুঃসময়ে পাশে ছিলেন আল্লাহ যেন তার মঙ্গল করেন। দোলন ভাই আপনি যা করেছেন তার হয়তো সবকিছু লিখতে পারিনি। তবে আপনি আমাদের পরিবারের মোনাজাতে থাকবেন আজীবন।

আপনি যখন আমাদের বিপদের সময় পাশে ছিলেন তখন আপনিও অনেক শত্রুতা, ঈর্ষা মোকাবিলা করে চলছিলেন। কিন্তু কখনো আমাদের বুঝতেও দেননি। আব্বার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে দিন-রাত অসংখ্যবার ফোনযোগে খবর রেখেছেন। ইনশাআল্লাহ আমার পরিবার এবং আমি আপনাকে সব সময় মনে রাখব। চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকব আজীবন।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :