যান্ত্রিকতার ভিড়ে আজও লাঙল-জোয়াল কাঁধে কৃষক
বিশ্বায়নের যুগে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দেশেও চলছে যান্ত্রিক বিপ্লব। শিল্পসহ সব ক্ষেত্রেই এখন মেশিনারিজের দাপট। এ দৌড়ে পিছিয়ে নেই কৃষিখাতও। এখানেও যুক্ত হয়েছে নানা যন্ত্রপাতির। জমি তৈরিসহ বীজবপন, ফসল কাটা মাড়াই, প্রক্রিয়াজতকরণ সব পর্যায়ে আজ বিভিন্ন যন্ত্রের সমাহার। ফলে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী কৃষি সরঞ্জামগুলো। সেচযন্ত্র থেকে শুরু করে চাষের হাল সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন ঘটেছে বাংলার কৃষি কারবারে। তারপরও মাঝে মাঝে দৃষ্টি গোচর হয় অতীতের সেইসব কৃষিযন্ত্রের যা ছিল গ্রামবাংলার আবহমান কালের সাক্ষী। এমনই একটি কৃষিযন্ত্র হলো গরু দিয়ে জমি চাষের লাঙল-জোয়াল।
শনিবার সকালে সাংবাদিকতার পেশাগত কাজে বের হলে চোখে পড়ে লাঙল জোয়াল কাঁধে গরু নিয়ে হেটে চলা এক কৃষকের। মূল পাকা সড়ক থেকে নেমে তিনি চলে যাচ্ছেন সংলগ্ন পাড়া মহল্লার ভেতরে। ফলে হন্তদন্ত হয়ে থেমে যেতে হয় তৎক্ষণাৎ। মোটর সাইকেল থেকে নেমেই মুঠোফোনে চিত্র ধারণ। কথা বলে জানা যায়, তার নাম শ্রী রঞ্জিত চন্দ্র দাস। তিনি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের আইসঢাল হিন্দুপাড়ার শ্রী বলাই চন্দ্র দাসের ছেলে। তিনি বলেন, যদিও আজকাল আর লাঙল জোয়ালের প্রচলন নেই। সবাই জ্বালানী তেল চালিত চাষযন্ত্র ট্রাক্টর দিয়েই এখন চাষাবাদ করেন। তারপরও কিছু কিছু জমিতে চাষের জন্য এই এনালগ লাঙ্গলেরই প্রয়োজন পড়ে। তাছাড়া খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক চাষী এখনও এই গরুর লাঙ্গল দিয়েই জমি তৈরি করেন। বিশেষ করে জমিতে মই দিয়ে সমান করার ক্ষেত্রে গরুর দ্বারা করলেই ভালো হয়।
তিনি বলেন, দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর যাবত এই গরুর লাঙ্গল জোয়াল দিয়ে জমি চাষ করেই সংসার নির্বাহ করছি। যদিও এখন চাহিদা কমেছে তবে আগের চেয়ে মজুরি বাড়ায় পুষিয়ে যায়। তাই এই একজোড়া গরু আর লাঙ্গল জোয়াল ধরে রেখেছি। আগে গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গৃহস্ত বাড়িতে এই কৃষিযন্ত্র থাকতো। কিন্তু এখন কয়েক গ্রাম ঘুরেও এর দেখা মেলেনা। শহরের অনেকেই এই লাঙ্গল জোয়াল সম্পর্কে হয়তো জানেই না। নতুন প্রজন্মের কাছে তো এটি বিলুপ্তপ্রায় একটি জিনিস। দেখলেও এর নাম বলতে পারবেনা। তবে এই হালচাষে বেশ সময় ও পরিশ্রম লাগে। এখন মানুষ অনেক আরামপ্রিয় এবং অল্প সময়ে কাজ সম্পাদনে আগ্রহী। সে কারণে ছোট বড় সব চাষিই যন্ত্রচালিত লাঙ্গল ব্যবহার করে। কাটা মাড়াইয়ের ক্ষেত্রেও আধুনিক মেশিন দিয়েই কাজ করে। এতে খরচ একটু বেশি হলেও দ্রæততার সাথে কাজ সারা যায়।
এসময় উপস্থিত ওই গ্রামের কয়েকজন চাষি জানান, বর্তমানে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারও অনেকে সাশ্রয়ী গরুর লাঙ্গল জোয়ালের প্রতি ঝুকছে। এতে সময় বেশি লাগলেও খরচ কম হয়। চলতি আমন আবাদে তাই ঐতিহ্যবাহী এই যন্ত্রের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আগের মত ঘরে ঘরে লাঙ্গল জোয়াল না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছেনা। এতে যার ঘরে এটি আছে তার পোয়াবারো। কাজ করে শেষ করতে পারছেন না। কৃষি যেমন গ্রামবাংলার জাত পেশা, তেমনি এই গরুর লাঙ্গল জোয়ালও জাত কৃষকের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও প্রিয় যন্ত্র। যা আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময় হয়তো আর কোথাও এর দেখা মিলবেনা। যেমন এখন ধান ভাঙ্গা ঢেকি যাদুঘরের সামগ্রী হয়ে পড়েছে।
সৈয়দপুর উপজেলা জামায়াতের আমীর ও ওই ইউনিয়নের কৃতি সন্তান হাফেজ মাওলানা আব্দুল মুনতাকিম এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, আধুনিক এই যুগেও যে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রেখে তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছেন এটা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। তাদের মতো কিছু কৃষিশিল্পির জন্যই শিল্প যন্ত্রপাতির দাপটে এখনও হারিয়ে যায়নি এই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রটি। একসময় যা ছিল কৃষক মাত্রই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের এমন কৃষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই এবং তাঁর এই কর্মযজ্ঞ আরও দীর্ঘদিন বজায় থাকুক সেটাই প্রত্যাশা করছি। সেইসঙ্গে তার প্রতি কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় জনপ্রতিানিধিদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
(ঢাকাটাইমস/৫আগস্ট/এআর)