রাতপরী

সন্ধে উতরে রাত্রি নামতেই আঁধারটা যখন আরও একটু বেশি গাঢ় হয়ে এলো গরম গরম চাট্টি খেয়ে গায়ে ছেঁড়া ফাটা সুতির চাদরটা বেশ মতো করে জড়িয়ে নিয়ে বেরোলো নারান। নারান মানে নারান গাছি।
আশপাশের পাঁচ-সাতটা গাঁয়ে এ নামেই এক ডাকের পরিচিতি তার। বাপ সনাতন ছিল জাত গাছি। আজ বাপ নেই। কিন্তু তার সব গুণই দিয়ে গেছে নারানকে। অন্যেরা যেখানে গৃহস্থের দাওয়ায় গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে গাছ পায় সেখানে নারানের বেলায় ব্যাপারটা উল্টো। কার্তিক গেল কি না গেল দক্ষিণ পাড়ার সুবোধ বিশ্বাস লোক দিয়ে ডেকে পাঠান নারানকে।
নারান খানিক অবাক হয়েই চারপাশে উলুক ঝুলুক তাকায়। তারপরেও কিছু বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, ‘ক্যান বাবু, কী হইছে?’ কপট রাগের ভান করেন বিশ্বাস মশাই, ‘হতে আর কী বাকি আছে শুনি? বলি কার্তিক যেয়ে যে অঘ্রাণ আসি আসি তা তাতেও যে তোর দেখা নেই?’
এতক্ষণে যেন বুঝতে পারে নারান। গাদা গুচ্ছের এক গাল ভরা হাসি নিয়ে সে বলে, ‘বুঝিছি বাবু।’
বিশ্বাস মশাই বলেন, ‘তা বুঝেই যদি থাকিস তাহলে আর দেরি কেন? আজ থেকেই- ’
‘না বাবু, আজ না। কাল থিক্যেই-’তা পরদিন থেকেই শুরু করে দেয় নারান। কাজ তো কিছু কম নয়, গাছ ঝোড়ো, চাছো, নুলি বসাও। তারপরে হাঁড়ি পাতো। তবেই না রস। তা রস বেশ ভালোই নামে নারানের হাতে। কোনো কোনো দিন তো হাঁড়ি উপচে পড়ে রসে। রস যত বেশি নারানের খাটনিও তত বেশি। শুধু রস তো আর বেচা যায় না। তা জাল দিয়ে গুড় বানিয়ে তবেই বেচতে হয়। সারা সপ্তায় রোববার- একদিনই ছুটি নারানের। হাঁড়ি ভর্তি গুড় নিয়ে সেদিন সে যায় চাপাডাঙ্গার হাটে। খালপাড়ের গা ঘেঁষে হাট। হাটের পাশ দিয়ে পিচ রাস্তা। সে রাস্তায় মিনিবাস, ট্রেকার, অটো চলে। খানিক দূর-দূরান্ত থেকেই গুড়ের ব্যাপারি আসে হাটে। নগদ পয়সায় কিনে নেয় গুড়। গুড় বেচে যা পায় নারান তাই দিয়ে সে কিনে আনে সারা সপ্তার খোরাকির জিনিস- নুন, ঝাল, চাল, তেল, আটা। সময় সময় একখানা গামছা, সুতির লুঙ্গি, পুরোনো সোয়েটারও।
আজকাল একার হাতেই সব সামলাতে হয় নারানকে। সারাদিনে দম ফেলার একেবারেই ফুরসত পায় না নারান। অথচ মাস সাতেক আগেও এমনটা ছিল না। তখন মা ছিল। মা ছিল মানে সামনে চাট্টি ভাত এগিয়ে দেওয়ার একজন মানুষ ছিল। এখন মা নেই। মা নেই মানে- শেষ দিকে এসে মা প্রায়ই বলতো, ‘ইবার এট্টা বে কর নারান। কেউ একজন আসুক সোংসারে।’
একই কথা বারবার শুনে শুনে বিরক্ত হতো নারান। মায়ের দিকে তাকিয়ে সে বলতো, ‘তুমার খালি একই প্যাচাল। বে কর, বে কর। তা বে কর বললিই কী সাথে সাথে বে করা যায়? তাছাড়া বে’র জন্যি অত তাড়াই বা কীসির শুনি?’
মা বলতো, ‘বে না করলি সোংসার হয় না রে বাপ। আর সোংসার না হলি মানষের চলে ক্যামনে?’ ‘ক্যান, আমাগের কী চলছে না?’
‘তা চলছে। কিন্তুক বাপ, আমার যা বয়াস তাতে আজ আছি কাল নাই। আমি না থাকলি তোর কী হবে ভাব দেহি। তুই কী শ্যাষে হাত পুড়ায়ে খাবি?’
এবার যেন খানিক রাগ ই করতো নারান। বলতো, ‘তুমার মুহে খালি কু কথা। তুমি থাকপা না মানে? কী কও তুমি?’ ‘ঠিকই কই রে বাপ। আমি থাকতি থাকতি-’
মা যে এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবে তা মুহূর্তের জন্যেও ভাবেনি নারান। মা ছিল মানে মাথার ওপর একটা ছাতা ছিল। ভরসার একটা জায়গা ছিল। বেঁচে থাকায় একটা আনন্দ ছিল। এখন চারপাশের সবকিছুকে বড়ো বিবর্ণ মনে হয় নারানের। একটু রংয়ের খোঁজে হা-পিত্যেশ করে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। কিংবা মাঠের ওপাশে আকাশ যেখানে দিগন্তে মিশেছে ঠিক সেখানটায়। তখন দুপুর হতে পারে। কিংবা বিকেল। আর নয়তো সন্ধে নামছে। নারান চেয়ে থাকে। অস্পষ্ট হলেও যেন কোথায় একটা ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। তার সেই কপাল জোড়া বলিরেখার ভাঁজ।
মা বলে ‘দেকলি তো বাপ আমার কথাখান ক্যামুন সত্যি হইয়ে গেল।’
নারান তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতর আটকে থাকা একদলা কষ্ট দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে তখন।মা ফের বলে, ‘অহনও সমায় আছে বাপ। এট্টা বে কর। দেকপি নতুন বৌ এস্যে সোংসারডা ফের সাজায়ে গোছায়ে নেবে। আর হাত পুড়ায়ে খাতি হবে না তোর।’
নারান বলে, ‘নিজি নিজি কী বে করা যায় মা?’
মা বলে, ‘যার কেউ নাই তার নিজিই সপ।’
‘কিন্তুক নিজির মুহে বে' র কথা-’কখন যেন চোখ দুটো ভিজে আসে নারানের। সেই ভিজে আসা চোখে মায়ের মুখখানি আর খুঁজে পায় না সে। তখনই ভেতর থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, ‘ওঠ নারান, ওঠ। অহনও কতগুলোন গাছে ওঠা বাকি আছে ক দেহি?’
কোমরে ছ্যান, পিছনে মাটির হাঁড়ি, কাঁধে কাছি দড়ি নিয়ে ফের গাছে ওঠতে থাকে নারান। উত্তরের নরম হাওয়া এসে ছুঁয়ে যায় তাকে। ফের একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাছ বায় সে।
গাছ বাইতে বাইতে সন্ধে নামলে সেদিনের মতো গাছ বাওয়া শেষ করে বাড়িমুখো হয় সে। বাড়ি বলতে কাঠা পাঁচেক জায়গার ওপরে চৌচালা একখানি ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর। মাটির দাওয়ার ওপরে বাঁশের খুঁটি, পাটকাঠির বেড়া। তার ওপরে জং ধরা ঢেউ টিনের ছাউনি। সামনে ফালি উঠোন। গোটা দুই হিমসাগর আমের গাছ। তিনটে কলাঝাড়। আর আরও দু-চারটে গাছ-আগাছা। একপাশে রান্নার একটা একচালাও আছে। যদ্দিন মা ছিল লেপে পুছে পরিষ্কার রাখতো তা। এখন মা নেই। দেখে-শুনে রাখারও কেউ নেই। তবে রান্নাটা সেখানেই করে নারান। ঝটপট রান্না খাওয়া সেরে এক হাতে একটি ব্যাগ, তাতে জলের বোতল, বিড়ি-দেশলাই, ছোট্ট একটা চার্জার টর্চ আর গায়ে সুতির চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে সে বেরোয়। খালপাড়ের গা ঘেঁষে খেজুর পাতা আর কালো একখানি ত্রিপল ঢাকা ছোট্ট কুঁড়ে। রাতটা কুঁড়েতেই কাটে নারানের। সে গাছ পাহারা দেয়। গাছ পাহারা? নাকি রস পাহারা? চারদিকে রস চোরের বড়ো উপদ্রব। একটু অসাবধান হলেই- মাঝ রাত অব্দি জেগেই কাটায় নারান। এক মুখ খোলা কুঁড়ের ভেতর খড় বিছানো মেঝেয় শুয়ে শুয়ে বাইরের আঁধার দ্যাখে। আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ দ্যাখে। গাছের গায়ে লেগে থাকা কুয়াশা দ্যাখে। যত দ্যাখে ততই যেন কার কথা মনে পড়ে। কিন্তু কার যে কথা তা বুঝতে পারে না নারান। তখন কুঁড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আকাশ দ্যাখে। আকাশের তারা দ্যাখে। আর খেতের আলে দাঁড়িয়ে থাকা খেঁজুর গাছগুলোর কাছ থেকে ঘুরে আসে। ঘুম আসতে আসতে মাঝ রাত গড়িয়ে যায়। সে ঘুম আবার স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। আঁধার থাকতেই আশপাশে মোরগ ডাকে। গাছের ডালে পাখি ডাকে। যেন বুঝি নারানকেই ডাকে ওরা। ওদের ডাক কানে যেতেই আরেকবার ওঠে পড়ে নারান। ওঠে গাছে চড়ে। রস নামায়। শুরু হয় কাজ আর কাজ।
এই কাজ করতে করতেই দিন কাটে নারানের। বিয়ের কথাটা মুখ ফুটে আর বলতে পারে না। কাকেই বা বলবে? কারও কী শোনার সময় আছে?
নারান তাই বলে না কাউকে। তবে দখিন পাড়ার কালু মিস্তিরির বাপ মরা মেয়ে জবা মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করে, ‘ও নারান দা, তুমি বে করবা না?’
জবা সারাদিন এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে শাক পাতা কুড়োয়। মাঠে মাঠে ছাগল চরায়। খালপাড় দিয়ে নিত্য যাতায়াত তার। যেতে-আসতে নারানের গাছ বাওয়া দ্যাখে। সময় অসময় কথাও বলে।জবার কথায় ঘুরে তাকায় নারান, ‘ক্যান রে? আমি বে করলি তোর কি?’
জবা হাসে, ‘না, তাহলি তুমার বে খাতি পারতাম।’
নারান বলে, ‘বে খাওয়ার এতই যদি শখ তাহলি তুই বে কর না। নিজির বে নিজিই খাবি।’
‘ধুর, কী যে কও না তুমি।’বলে আর দাঁড়ায় না জবা। যেমনি করে এসেছিল তেমনি করে চলে যায়। যাওয়ার সময় কেবল কেমন একটা বাঁকা হাসি দিয়ে যায়। নারানের মনে হয় হাসি নয় যেন অন্য কিছু। যা আচমকাই এসে বিঁধে যায় নারানের বুকে। আলতো করে বুকে হাত দেয় নারান। তারপরে ফের গাছ বায়।
এখন এই সন্ধে উতরানো রাতে হাঁটতে হাঁটতে জবার মুখখানি কেন যেন মনে পড়ে গেল নারানের। বাপ মরা মেয়ে। মা কালীতারা কত কষ্ট করেই না ছোট থেকে বড় করেছে জবাকে। ক বছর আগেও কত ছোট ছিল জবা। আর আজ-
পৌষের রাত। এরই মধ্যে ঝাঁপিয়ে কুয়াশা পড়েছে। আকাশের তারারা সব ঢাকা পড়ে গেছে তার আড়ালে। চাঁদ যেন তাই ভয় পেয়ে ওঠেইনি। এদিকে উত্তরের হওয়াটা আজ যেন একটু বেশিই জোরালো। চাদরের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে মাংসে কাঁপন ধরানোর অবস্থা।দাঁড়িয়ে পড়ে বিড়ি ধরালো নারান। বড়ো বড়ো গোটা দুই টান দিতে শরীরটা ঈষৎ গরম হতে শুরু করলো। ভাবনাগুলো ফের সতেজ হতে শুরু করলো তাতে। তবে আর দাঁড়ালো না সে।
খালপাড়ের গা ঘেঁষে সারি সারি খেজুর গাছ। পাশে সর্ষের খেত। খেতের আলেও গাছ। জায়গাটা পুরোই সুবোধ বিশ্বাসের। বাপ কেলে জমি উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছিলেন বিশ্বাস মশাই নিজের সময়ে তা আড়ে বহরে অনেকটাই বাড়িয়েছেন। এখানে বিঘের পর বিঘে কেবল বিশ্বাসেরই জমি। এমন জমিরই এক কোনায় খালপাড়ের গা ঘেঁষে নারানের কুঁড়ে। নিজের হাতেই যা বানিয়েছে নারান। বাঁশের খুঁটির ওপর খেজুর পাতা আর ত্রিপলের ছাউনি। যার সবটাই বিশ্বাসের দেওয়া।
বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ পেরিয়ে নারান যখন কুঁড়েয় পৌঁছলো পৌষের রাত তখন দ্রুতই গভীর হতে শুরু করেছে। কুয়াশার কারণে আঁধার আজ অনেকটাই গাঢ়। গাছের পাতা থেকে টুপ টাপ শিশির ঝরছে। শুধু কি শিশির? গাছের পাতাও ঝরছে হয়তো বা। গাঁ গেরামে সন্ধে উতরানো মানেই রাত। আর এখন তো একপ্রকার নির্জনই হয়ে এসেছে চারপাশ। এই শীতে যে যার মতো আগেভাগে খেয়ে শুয়ে পড়েছে। শুতে তো ইচ্ছে করছে নারানেরও। কিন্তু সে কপাল কি আর তার আছে? একবার যদি দুটো চোখ বুঁজে আসে তো সেই সুযোগেই না আবার-
পরদিন বিশ্বাস মশাই হয়তো বলবেন, ‘এত ঘুম ভালো নয় রে নারান। দেখলি তো কি হয়ে গেল? ওরে, পাড়ার ছেলে ছোকরারা মোটেই সুবিধের নয়। তুই ওদের পাহারা দিবি কি ওরা তোকেই পাহারা দেয়।’
নারান হয়তো বলবে, ‘তাই তো দেকতিছি বাবু। কেডা জানতো ওরা এমনি কইরে-’
‘তুই সবকিছু যেমন সহজ করে ভাবিস কিছুই অত সহজ নয়। তা যা করেছিস করেছিস আজ থেকে আর-’কথাটা হয়তো পুরো করবেন না বিশ্বাস মশাই। এটুকুতেই বুঝে নিতে হবে নারানের। বুঝে নিতে হবে মানে রাতভর জেগেই কাটাতে হবে।
কুঁড়ের কাছে এসে একবার এ কথা ভেবেই দাঁড়িয়ে পড়লো নারান।
হাতের ব্যাগ নিচে নামিয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকালো। না, আকাশ বলে কিছুই আর দেখা গেল না আলাদা করে। চোখে-মুখে এসে কেবল ঝাপটা মারলো একরাশ কুয়াশা ভেজা হাওয়া। উত্তরের হাওয়াটা রাতের দিকে কতটা হিংস্র হয়ে ওঠে তা হাড়ে হাড়ে টের পেল নারান। কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। তারপর আলপথ দিয়ে হাঁটতে লাগলো আবার।
হাঁটতে হাঁটতেই বাপ সনাতন গাছির মুখটা মনে পড়ে গেল নারানের। এমনি করে কত রাত এই আলপথ ধরেই হেঁটে গেছে তার বাপ। তখনও এমনি করেই কুয়াশা নামতো। উত্তুরের হাওয়াটাও বইতো এমনি করেই। আর এমন করেই সেইসব আঁধার মাখা শীতের রাতে গাছ পাহারা দিতো বাপ।ছোটবেলায় বাপই তাকে দিয়েছিল গাছ কাটার হাতেখড়ি। শিখিয়ে দিয়েছিল কি করে গাছ ঝুড়তে হয়। চেছে নুলি বসাতে হয়। হাঁড়ি পাততে হয়। কোনভাবে কাটলে রস বেশি নামে। তা বাপের কাছে শেখা বিদ্যেটা এখন ভালোই কাজে লাগছে নারানের। গুড় বেচা টাকাতেই কতগুলো মাস খেয়ে পরে ভালোই চলে যায় তার। যতদিন মা ছিল পেট দুটো ছিল। আজ নারানের কেবল একটাই পেট। একটাই গা। না, খাওয়ার চিন্তা যেমন নারানের নেই তেমনি গা ঢাকার চিন্তাও।
বাপ সনাতন প্রায়ই বলতো, ‘বুঝলি বাপ, কাম কাজের কোনো ছোট বড়ো হয় না। সৎ পথে থিক্যে কিছু কত্তি পারলিই হলো।’
তা বাপের কথাটা পদে পদেই মেনে চলে নারান। রসের মরশুমে সে গাছ কাটে। গুড় বেচে পয়সা আনে। বছরের বাকি সময়টা সে জন খাটে। যখন যে ডাকে তার খেতেই চলে যায় সে। কোন কাজটা পারে না নারান। হ্যাঁ, একটা জিনিসই কেবল পারে না সে। বিয়ে। একটা বিয়েই কেবল করতে পারে না। বিয়েটা কি খুবই দরকার জীবনে? মা তো তেমন করেই বলতো। হ্যাঁ, একটা বিয়ে করলে একটা বৌ হতো তার। যে নারানের সবকিছু দেখে-শুনে রাখতো। তার এই বাড়িঘর, উঠোন, গাছগাছালি। সে রস জ্বাল দিত। ভাত তরকারি রাঁধতো। বিছানা পাততো। আর রাতের বেলায়-
শরীরটা হঠাৎ যেন গরম হতে শুরু করলো নারানের। নিশ্বাসটাও ঈষৎ ঘন হয়ে এলো বুঝি। ফের একবার দাঁড়িয়ে পড়লো নারান। ততক্ষণে পুবের আকাশটা ঈষৎ ফর্সা হতে শুরু করেছে। না, সূর্য নয় চাঁদ উঠবে। চাঁদের আলো বেশ ভালো লাগে নারানের। কোথায় যেন এক অন্য রকমের অনুভূতি নাড়া দেয়। ছোটবেলাটা মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের মুখে শোনা সেই রূপকথার জগৎ। সেই রাজা-রানী। সেই দত্যি-দানো। লালপরী নীলপরী। তেপান্তরের মাঠ।
আচমকা একরাশ উত্তুরের হাওয়া ঝাপটা মারতেই আর দাঁড়ালো না নারান। একটু পা চালিয়ে এসে কুঁড়ের ভেতর ঢুকে পড়লো। কুঁড়ের মেঝেয় বেশ পুরু করে পাতানো খেজুর পাতা। তার ওপরে তার চেয়েও পুরু খড়। খড়ের অভাব নেই বিশ্বাসের। বলেছেন, ‘যত লাগে নিয়ে যা না।’ তা এক বোঝাই মাত্র এনেছে নারান। আর তাতেই এক হাত পুরু গদি হয়ে গেছে। সেই গদির ওপরে আবার একখানা চট। একটা কাঁথা। ভেতরে ঢুকে কুঁড়ের মুখে প্লাস্টিকের তাঁবুটা নামিয়ে দিতেই রাজ্যের ওম এসে ঘিরে ধরে। কোথায় শীত। কোথায় উত্তুরে হাওয়া।
এখনও সেই ওমটাই জড়িয়ে ধরলো নারানকে। সারাদিন বড্ডো খাটুনি গেছে নারানের। আজ তাই বসে থাকতে মোটেই ইচ্ছে হলো না তার। একপাশে ভাঁজ করে রাখা বহু বছরের পুরোনো কম্বলটা গায়ের ওপর টেনে নিয়ে শুয়েই পড়লো সে।
আর শুতে না শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ঘুমিয়েই পড়েছিল নারান। কিন্তু সে ঘুম গাঢ় হওয়ার আগেই ভেঙে গেল আচমকা। বাইরে কোনো মেয়ে কণ্ঠের ডাক, ‘ঘুমায়ে পড়লে নেকি নারান দা?’
ধড়মড় করে উঠে বসলো নারান, ‘ক্কে- কেডা?’ ‘আমি গো, আমি।’
কণ্ঠটা চিনতে পেরে কুঁড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নারান, ‘এ কি জবা, তুই? এ্যাতো রাত্তিরি?’
হাত দুয়েক কাছে সরে এলো জবা, ‘বেপদে পইড়ে তুমার কাছে আইছি গো দাদা।’
পুবের আকাশে আধক্ষয়াটে চাঁদটা ওঠে আসায় চারদিকে এখন আর আগের মতো অতটা আঁধার নেই। যদিও ঝাঁপিয়ে পড়া কুয়াশার কারণে জ্যোৎস্নাটা বড়োই ম্যাড়মেড়ে। তবু তার মধ্যেই জবার মুখটা দেখতে পেল নারান। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হইচে জবা?’ আচমকাই কথাটা বলল জবা, ‘আমারে বে করবা নারান দা?’
চমকে উঠলো নারান। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো নির্বাক নিশ্চল মূর্তির মতো। মনে হলো মাথার ওপর থেকে নেমে এসে আকাশটা তার মাথায় চেপে বসেছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলো না সে।
জবা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হলো নারান দা? কিছু কও।’
স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো নারান, ‘কথাডা কালও তো বলতি পারতি জবা। অহন এই এ্যাতো রাত্তিরি-’
‘কাল সুমায় পাতাম না নারান দা।’
‘ক্যান?’
‘কাল যে আমার বে।’
‘বে? তা ভালো তো।’
‘না গো।’
‘ক্যান?’
‘এট্টা আধবুড়ো মানষেরে বে কইরে কেউ সুখ পায়?’
অবাক হলো নারান, ‘কস কী?’
‘ঠিকই কই নারান দা। মানুষডার বৌ মইরে গেছে। তিন তিনডে ছেল্যে মেইয়ে। বাড়িঘর সপই তো তাগের। ওই সোংসারে আমার কী থাকপে কও?’
‘কিন্তুক-’
‘কিন্তুক কী নারান দা?’
‘আমি যে তোরে বে কত্তি পারবো না রে জবা।’
‘ক্যান?’
‘কাল তোর বে। অহন আমি যদি-, মানষে যে নানান কথা ক’বে। আমার দোষ দেবে।’
‘দোষের তুমি এ্যাতো ভয় করো নারান দা?’
‘তাছাড়া আমারে বে কইরেই বা কী পাবি তুই? আমি হলাম গে এক ছন্নছাড়া মানুষ।’‘তুমারে বে কইরে আমি সপ পাবো নারান দা। সুখ পাবো। শান্তি পাবো। বাড়িঘর পাবো। উঠোন, তুলসিতলা, হিমসাগর আমের গাছ, কলাঝাড় পাবো। আর নিজির এট্টা মানুষও পাবো।’
‘তবু তোরে আমি বে কত্তি পারবো না জবা। তুই ফিইরে যা। তোর বে ঠিক হইয়ে গেছে। রাত পোহালি বে। আর বেশি দেরি নাই। ওই দ্যাক, পুবির আকাশে রং লাগতি শুরু করিছে।’
বলতে বলতে আকাশের দিকে তাকালো নারান। চাঁদের গা থেকে কখন যেন কুয়াশার আড়ালটা সরে গেছে। একরাশ জ্যোৎস্না ওমনি লাফিয়ে নামতে শুরু করেছে সেখান থেকে।
চোখ নামিয়ে নিল নারান। আর তখনই দেখতে পেলো খানিক তফাতে জ্যোৎস্নার আঁচল গায়ে জড়িয়ে কুয়াশা ভেজা আলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে জবা। না, জবা নয়। জবার মতো দেখতে যেন কোনো এক রাতপরী, এতদিন যাকে একপলক দেখার জন্য রাতের পর রাত জেগে অপেক্ষায় থেকেছে নারান।

মন্তব্য করুন