নির্বাচনে প্রতীকের গুরুত্ব ও জনকল্যাণের পথরেখা

ফকির ইলিয়াস
| আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:৩৯ | প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:২৯

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই শুরু হয়েছে। বড়ো দলগুলো তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করা শুরু করেছে। এতে পরিবর্তন সংযোজন হতে পারে! আওয়ামী লীগ এখন একক শক্তির অধিকারী মনে করছে নিজেদের! অথবা এটাও হতে পারে এটা তাদের কৌশল! তা যাই হোক, সময় যে খুব অনুকূল- তা বলার অবকাশ নেই। কারণ ২০১৪, ২০১৮-এর পরে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া বিএনপি-জামাত মোর্চা। তারা এবারে নির্বাচনে আসছে না। তবে কেউ কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন। একটা কথা বলা দরকার, বিএনপি একজনের (তারেক জিয়া) নিজের দল নয়। তিনি লন্ডনে থেকে নিজের খেয়াল খুশিমতো আদেশ দেবেন- আর তা পালিত হবে, সেই দিন বোধহয় বাংলাদেশে আর নেই। তারপরেও তিনি জ্বালাও-পোড়াওয়ের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মাঝে, ৩০টি দল নির্বাচন করবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তা মধ্য-ডিসেম্বরেই খোলাসা হয়ে যাবে। তবে আওয়ামী লীগ নিজের কৌশলেই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। প্রথমত ১৪ দলীয় জোটকে কিছু আসন দিয়ে দিতে হতে পারে। অন্যদিকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, কেউ চাইলে স্বতন্ত্র ইলেকশন করতে পারবে। পুরো বাংলাদেশের চিত্র বদলে গেছে ওই একটি ঘোষণায়!

আপাতত যা বলা যায়, তা হলো- নির্বাচন তার আপন গতিতেই এগোচ্ছে। দলীয় ব্যানারে বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে না এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হোক, এটা চান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। সেই লক্ষ্যে তিনি কিছু দরকারি কথা বলেছেন। বলেছেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে হবে। প্রতিযোগিতা করে পাশ করে আসতে হবে। আমরা দেখছি, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। এটা বেশ বড়ো। অন্যদিকে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, যুক্তফ্রন্টসহ আরও কিছু নিবন্ধিত দল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। এরপরেও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা আসন্ন সংসদ নির্বাচন স্বতন্ত্রদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।

আমার মতে, কাজটি মন্দ হয়নি! কারণ এতে তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন! এখানে একটি কথা স্পষ্ট বলা দরকার মনে করি। যারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে, কমিশনভোগী হয়ে, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে ও দুর্নীতি করে সুবিধা নিয়েছেন- তাদের কেউ কেউ নৌকা প্রতীক পাননি। তাদের নির্বাচন থেকে দূরে থাকাই দরকার। আরেকটি মহল মনে করেছিলেন- নৌকা পেলেই তারা পাশ করে আসবেন! এদের কেউ কেউ নৌকা প্রতীক পাননি। তাদেরও ইলেকশন থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী তাদেরই হওয়া দরকার, যারা নিস্বার্থভাবে এলাকায় কাজ করেছেন। উন্নয়নের সাথী ছিলেন। শেখ হাসিনা মূলত চেয়েছেন, এরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করুন। পাশ করে এলে লীগেই নিয়ে নেয়া হবে- এটাও প্রায় স্পষ্ট! দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষজন মনে করছেন, কোথাও কোথাও নৌকা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। লীগও চাইছে, সেখানেই ভোটবিপ্লব হোক! ভোটারের জয় হোক। আমার মনে হয় এই সুযোগ বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ভেবেচিন্তেই দিয়েছেন। এটা বিজ্ঞ রাজনীতিকদের কাজে লাগানো উচিত। দেশজুড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইলেকশন হোক। ত্যাগী ও নীতিবানরা পাশ করে আসুন। একটা বিষয় আমাদের মনে আছে, আওয়ামী লীগ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা বরাদ্দ করেছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই সময় দলীয় প্রতীকের বেশ ভরাডুবিই হয়েছিল। এতে প্রমাণিত হয়েছিল প্রতীক সবসময়ই কাজে আসে না! শেখ হাসিনা কি শেষ পর্যন্ত তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন? তিনি কি দলীয় 'স্বতন্ত্র'দের সামাল দিতে পারবেন? নাকি শেষে আবার শিকল টেনে ধরবেন- তা এই মুহুর্তে বলা মুশকিল! কারণ আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর ভোট ভাগাভাগির কারণে অন্য দলের প্রার্থী পাশ করে চলে আসতে পারেন! তাহলে কি মেজরিটি পাবে বর্তমান সরকারি দল? এমন অনেক সমীকরণ নিয়ে এগোতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বাংলাদেশে অনেক আসনের এমপিদের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ। কোনো কোনো মন্ত্রীও এলাকায় বড়ো উন্নয়ন কিছুই করেননি। এলাকার মানুষের সাথে তাদের গণসংযোগ নেই। এমন তাড়না থেকেই, হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। মিডিয়াকে প্রার্থী নিজেই বলেন- 'প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ পাস করে আসতে পারবেন না। প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখতে হবে। তাই আমি দলীয় মনোনয়ন না পেলেও হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো।'

এই আসনে নৌকার প্রার্থী বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তার বিপক্ষে লড়বেন সুমন। চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিদ্ধার্থ ভৌমিকের কাছ থেকে সুমনের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহাগ রহমান। দিনব্যাপী চুনারুঘাট উপজেলার সাটিয়াজুড়ি বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ করেছেন সুমন। এমন চিত্র বাংলাদেশে এখন অনেক। যেসব ক্ষমতাসীন এমপি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি, তারাও স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন! ফলে একটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। কিন্তু এই যে উন্মুক্ত মাঠ, তাতে কী ভূমিকা রাখতে পারে একাত্তরের পরাজিত দল জামায়াতে ইসলামী! তারা কি স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে? এ বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে তাদের অতীত একটি ঘেঁটে দেখা যাক। মাহমুদ আলী নামে একজন পাকিস্তানি দালালের কথা আপনাদের মনে আছে? লোকটি মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এই লোকটি বাংলার মাটিকে চিরতরে পরিত্যাগ করেছিল। এই তমদ্দুনের অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। এর পরের ঘটনাবলীর দিকে তাকালে আমরা দেখব- একাত্তরের অন্যতম ঘাতক নেতা গোলাম আযমের উদ্যোগে পাকিস্তানে পালিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ’। এরপর লন্ডন গিয়ে সেখানে ‘পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার কমিটি’ নামে একটা কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি বাংলাদেশকে উদ্ধার করে আবার পূর্ব পাকিস্তান করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। ওই বছর ডিসেম্বরে সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে অংশ নিয়ে সব মুসলিম রাষ্ট্রকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের সহায়তায় কোনো প্রকার আর্থিক সাহায্য না দিতে আহ্বান জানান গোলাম আযম।

১৯৭৩ সালে সরকারি এক আদেশে ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এর একজন গোলাম আযম। গোলাম আযম মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো সফর শুরু করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে এবং পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধারে সহায়তা চান। ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটির সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধারের বিষয়ে বক্তৃতা দেন।

১৯৭৪ সালে মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার কমিটির বৈঠক হয়। মক্কায় অনুষ্ঠিত রাবেতায়ে ইসলামির সম্মেলনে বাংলাদেশ উদ্ধার নিয়ে বক্তৃতা দেন গোলাম আযম। এই গোলাম আযম কিন্তু পাকিস্তানে থাকেননি। তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। এই দেশে তাকে ফিরিয়ে আনতে কারা সাহায্য করেছিল- তাও আমাদের অজানা নয়। এর পরবর্তী বছরগুলোর ধারাবাহিকতা আমাদের কাছে খুবই স্পষ্ট।

একাত্তরের ঘাতক ও রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড়ো ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও এই দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন বিলাতে। পরে ফিরে এসেছিলেন। সময় সুযোগমতো নেমেছিলেন রাজনীতিতেও। সাকা চৌধুরীর ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম নায়ক আলী আহসান মুজাহিদেরও। এই ফাঁসির আগে ও পরে পাকিস্তান কী বলেছে- তা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছেন, শুনেছেন। ফাঁসির রায় ঠেকাতে পাকিস্তানকে সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন পাকিস্তান জামায়াত-ই-ইসলামের আমির সিরাজুল হক। জামায়াতের আমির বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনে’ পাকিস্তান সরকারকে নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকা পালন করলে হবে না। মুসলিম বিশ্বসহ সারা বিশ্বকে সো”চার করতে উদ্যোগী হতে হবে পাকিস্তানকে। পাক জামাতের আমির সিরাজুল হক আরো দাবি করেন, জামায়াত নেতা মুজাহিদ কোনো অপরাধী নন। ‘সেই সময়ে আলী আহসান মুজাহিদ একজন পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে ভারতীয়দের প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ কিছু যুদ্ধ-আগ্রাসীর হাত থেকে দেশকে রক্ষার চেষ্টা করেছিল। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে তো মুজাহিদ অপরাধীই নয়।’

জামায়াত কিন্তু তাদের সেই বক্তব্য থেকে সরে আসেনি। আসার ঘোষণাও দেয়নি। কিন্তু তারা ঢাকায় বেশ শক্তভাবেই সমাবেশ করতে পেরেছে! তবে তারা কি বিশেষ কোনো শক্তিবলে ২০১৪-এর নির্বাচনে কিছু আসন বাগাতে চাইছে? তা দেখার জন্যেও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আওয়ামী লীগের সমান্তরালে আরেকটি দলও দাঁড়াতে পারেনি। পারলে এই দেশ অনেক শান্তিময় হয়ে উঠতো। যারা রাজনীতি করতে চেয়েছেন, তারা প্রথমেই আওয়ামী লীগ ও জাতির পিতার চেতনায় কুঠারাঘাত করতে চেয়েছেন। রাজনীতিতে নিজেদের মরণকাল ডেকে এনেছেন তারা এভাবেই।

প্রতিটি রাষ্ট্রে জনকল্যাণের একটি পথরেখা থাকে। এর প্রধান পূর্বশর্ত হলো, ভোগবিহীন রাজনীতি। দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি। শেখ হাসিনার দল, যদিও বিভিন্ন মেরুকরণে কাউকে নমিনেশন দিয়েছে, কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি ওপেন করে দিয়েছেন। দিতে চেয়েছেন। সৎ রাজনীতিকরা এই সুযোগ নিতে পারেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ত্যাগী টিমের দরকার। আমার মনে হয়, এবার সেই টিমে একটি বড়ো অংশ পাশ করে আসতে পারবেন। এলাকায় এলাকায় সুর উঠেছে, প্রতীক নয়- আদর্শবানদের জয় হোক। তাই 'নৌকা যার আমি তার'- এই নীতি কিছুটা হলেও খেই হারিয়ে ফেলেছে। সন্দেহ নেই, একেকটি আসনে কয়েকজন শক্তিশালী প্রার্থী হলে প্রতিদ্বন্ধিতা করেই পাশ করে আসতে হবে। ভোটের মাঠও থাকবে সরগরম। বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা তেমনটাই চেয়েছেন। বাকিটা নির্ভর করছে বাংলাদেশের গণমানুষের উপর। তবে যেভাবেই হোক, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারীরাই পাশ করে আসবেন- সেটাই হোক প্রজন্মের চাওয়া।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট। 'আমেরিকান ইমেজ প্রেস'-এর সদস্য।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :