কোটায় সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের বঞ্চিত করার কূটতর্ক

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
  প্রকাশিত : ১৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০৬
অ- অ+

দেশে আবারও কোটা ব্যবস্থা বাতিল বা সংস্কারের দাবি নিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের একটি বড়ো অংশ আন্দোলনে নেমেছে। যদিও কোনো সচেতন মহলই মনে করে না যে- কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য আন্দোলনের এখন আর প্রয়োজন রয়েছে। এটি এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আগামী ৭ই আগস্ট হাই কোর্টের দেওয়া রায় নিস্পত্তির জন্য দিন ধার্য করেছেন। কোটা বিরোধী একটি আন্দোলন শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিলে সরকার তখন ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর সমগ্র কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তটি শিক্ষার্থীদের কোটা নিয়ে আন্দোলনের উৎসৃঙ্খলতাসহ নানা ধরনের অরাজকতায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হিসেবেই পরিপত্রটি জারি করা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ২০২১ সালে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। রিটের উপর শুনানি এতদিন চলার পর গত ৫ই জুন হাই কোর্ট একটি রায় প্রদান করেন। এতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট রায় দেন। এর কারণ হচ্ছে ওই পরিপত্রটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালত, হাই কোর্টের রায়টি স্থগিত রেখে ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে নির্দেশনা জারি করেন। সুপ্রিম কোর্ট আন্দোলনকারীদের যৌক্তিক দাবি আইনজীবীর মাধ্যমে ৭ই আগস্ট আদালতে উপস্থাপন করারও আহ্বান জানান। কিন্তু আন্দোলনকারীরা হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের কোনো আদেশই মানতে রাজি নন। তারা সরকারি নির্বাহী আদেশের দাবি জানিয়ে মাঠ উত্তপ্ত করছেন। বিশেষত ঢাকার শাহবাগ একালায় প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার শিক্ষার্থী মাইক লাগিয়ে বক্তৃতা, স্লোগান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে নানা ধরনের সমালোচনা, ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপাত্মক অনুষ্ঠান করে থাকে। অথচ সেখানে দেশের দুটি সর্ববৃহৎ হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে অসুস্থ অসংখ্য রোগী আছেন। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে হাসপাতালের পাশে এ ধরনের চিৎকার, চেঁচামেচি ও উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজানো একেবারেই কল্পনা করা যায় না। আন্দোলনকারীরা কিছুতেই নির্বাহী আদেশ ছাড়া রাস্তা ছাড়বে না এমনটিও জনে জনে বলছে। সেখানে অবস্থানকারীরা পুলিশ ব্যারিকেট ভাঙা, সাংবাদিকদের উপর হামলা করা, নানা ধরনের কদর্য স্লোগান দিতেও দেখা যায়। বারবারই তারা বলছে যে কোটা ব্যবস্থায় মেধাবীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ধরনের কোটা ব্যবস্থাই চালু নেই। আবার তারাই বলছে মাত্র ৫ শতাংশ কোটার বেশি তারা মানবে না। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে সংগতি প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশ, বিএনপি, ছাত্র শিবির, ছাত্রদল, গণতন্ত্র মঞ্চ ইত্যাদি সংগঠন। ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের বক্তব্যে উল্লেখ্য করেছে- কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল অযৌক্তিক ও মেধাবীদের সঙ্গে প্রহসন। ছাত্রদল দাবি করেছে- বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী ছাড়া কোনো অন্যক্ষেত্রে কোটার প্রয়োজন নেই। বিএনপি মহাসচিব আন্দোলনের শুরুর দিকে বলেছিলেন যে ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি কোটা থাকার প্রয়োজন নেই। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কোটা আন্দোলনকারীদের ভোটাধিকারের লড়াইতেও যুক্ত হতে আহ্বান জানান। কোটা ব্যবস্থার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন- বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে মেধাহীনদের রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এভাবেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে নানা কূটতর্ক, আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে যেমন করছেন তাদের সমর্থনদানকারীরাও করে যাচ্ছেন।

কোটা ব্যবস্থাটি পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বহাল থাকতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও এটি রয়েছে। আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরিতে সুযোগ রাখার ব্যবস্থা করলেও তিনি এর কার্যকারিতা সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। তবে সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সমানাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বাংলাদেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামরিক সরকার, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা কিংবা সুযোগ সুবিধা অঘোষিতভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল, সেই স্থলে স্বাধীনতাবিরোধী এবং তাদের সন্তানদের সরকারি চাকরি, বিভিন্ন বাহিনী এবং বিদেশি দূতাবাসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করার সুবিধা দিয়েছিল। জামায়াত শিবির এবং বিএনপি নেতাদের কথা শুনে মনে হয় তারাই বাংলাদেশে কেবল মেধাবীদের সরকারি চাকরিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থান করে দিয়েছেন। এর চেয়ে ডাহা মিথ্যা, প্রতারণা এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ করেছে বলে উদাহরণ দেওয়া যাবে না। এখন তারা কোটার সঙ্গে মেধার একটি বিতর্ক জুড়ে দিয়েছে।

সরকারি চাকরি ও বিসিএস পরীক্ষায় কোটায় অংশ নেওয়া পরীক্ষার্থীদের প্রিলিমিনারি এবং মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। কেবল মাত্র নির্বাচনি চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যেই কোটার ভিত্তিতে চাকরি নির্ধারিত হয়। তাহলে কোটা ব্যবস্থাকে মেধাহীনদের বলার সুযোগ থাকে কোথায়? কিন্তু জামায়াত-বিএনপিসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকলেই কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করতে গিয়ে মেধা এবং মেধাহীনদের যেই কূটতর্ক মানুষের সম্মুখে নিয়ে এসেছে তার আড়ালে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধিতার রাজনীতিকে উপরে তুলে ধরার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত কোটা ব্যবস্থা, সংবিধান ইত্যাদিকে বিতর্কিত করা এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি তাদের যে অশ্রদ্ধার মনোভাব সেটিকে কূটকৌশলের মাধ্যমে এড়িয়ে চলা। স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির রাজনীতি এখন দুইপায়ে হাঁটছে। একপায়ে গণতন্ত্রের জোড়া লাগানো হাতল অন্য পায়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার কূটকৌশল। এইসব রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তারা নিজেদেরকে খুব মেধাবী ভাবেন। কিন্তু মেধার প্রকৃত সংজ্ঞায় তারা যে পড়েন না সেটি তারা জানেন না এবং মানেনও না। ইতিহাসে তাই এর পশ্চাৎগামী প্রতিক্রিয়াশীল এমনকি চরম অমানবিক বলেও পরিচিত হন। সে কারণেই তাদের দ্বারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের হত্যাকাণ্ডের সহযোগী হওয়া সম্ভব হয়েছে, ৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী হতে মোটেও বিবেক কাঁপে না, কাঁদেও না। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তারা কেউ কেউ ভালো ফলাফল করতেও পারেন, দেখাতেও পারেন কিন্তু দেশ জাতি এবং মানবতার বিরুদ্ধে যে ‘মেধা’র প্রয়োগ ঘটে সেটিকে মেধার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না।

মেধা নিয়ে যে কূটতর্কটি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম, রাজনীতিসহ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি একেবারেই যে হীন উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে সেটি অনেকেই বুঝতে পারছেন না। মেধা একটি আপেক্ষিক ধারণা। প্রতিটি শিশুই মেধার অনুসঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু খাদ্য, পরিবেশ, পরিচর্যা, শিক্ষাসহ নানা আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যে শিশু পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্র থেকে লাভ করার সুযোগ পেয়ে থাকে তা তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ পরিগঠনের মাধ্যমে মেধার প্রকাশ ঘটাতে থাকে। সেক্ষেত্রে কারোই মেধার অবস্থান সমান সমান থাকে না। কিন্তু কখনো কিছুটা পিছিয়ে যাওয়া শিশু-কিশোর, তরুণ বয়স এবং শিক্ষা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়ার ধারায় নিজেকে অন্যের চাইতে ছাড়িয়ে যেতে পারে- এটি মেধার একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। কেবল মস্তিষ্কের বিশেষ কোনো ব্যাধি ব্যতীত, অন্য প্রতিটি শিশুর-ই মেধার স্বাভাবিক এবং তার চাইতেও অগ্রসর বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠা সম্ভব, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াও সম্ভব। দৈহিক অন্য কোনো অঙ্গহানি বা বিকলাঙ্গ অবস্থা নিয়েও মেধার যে সবোর্চ্চ স্ফূরণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব তাও ইতিহাসে কিংবা আমাদের চারপাশে অজস্র নজির রয়েছে। তবে মেধাবিকাশের জন্য অবশ্যই শিক্ষা, বুদ্ধির চর্চা এবং চিন্তার যৌক্তিক বিকাশ ঘটানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। মেধা একটি সংবেদনশীল বিষয়। মস্তিষ্কে বড়ো ধরনের কোনো আঘাত, রোগ, ব্যাধি ঘটলে এর যথাযথ প্রকাশ ঘটানো সম্ভব, ব্যক্তিপর্যায়ে না ঘটার যথার্থ কারণ উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু প্রকৃত মেধাবী হতে হলে অবশ্যই শিশুকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে জানা, বোঝা, শিক্ষা, চিন্তা এবং কোনো না কোনো বিষয়ের প্রতি নিরন্তর গভীরে যাওয়ার ও প্রবেশ করার কর্মযজ্ঞ ও প্রচেষ্টা থাকতেই হবে। জন্ম থেকে স্বাভাবিক মৃত্যু অবধি মেধাবী মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির প্রধান উপায় হচ্ছে সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ রাখা। ছাত্রজীবনের ভালো ফলাফল দেখে অনেকে চমক সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যদি তার কর্মজীবনে কোনো সৃজনশীলতা না থাকে তাহলে তার মস্তিষ্কের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা লোপ পেতে পারে। সে ধরনের ব্যক্তির জীবন থেকে সৃষ্টি হারিয়ে যায়। আর তেমন ব্যক্তিরা যেহেতু বুদ্ধির একটি স্তরে উন্নীত হতে পারে মাত্র, তাই তিনি স্তর ভেঙে উচ্চস্তরে যাওয়ার চেষ্টা নাও করতে পারেন কিংবা তাদের বুদ্ধির অপব্যবহারও সমাজ, রাষ্ট্রসহ সর্বত্র করতে পারেন। সেই মেধার মৃত্যু ঘটিয়ে ব্যক্তি তার জীবন ও জীবিকাকে খুব বেশি সম্বৃদ্ধ করতে পারেন না। সুতরাং মেধা নিয়ে কথা বলতে যাওয়ার মধ্যে যদি জ্ঞানহীনতা, যুক্তিহীনতা কাজ করে তাহলে প্রগাঢ় কোনো পরিচয় পাওয়া যাবে না। মেধা বিকাশের জন্য শিক্ষা, গবেষণা, চর্চার ধারাবাহিক অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। একজন শিক্ষক যদি তার অধীত বিষয়ে যুগোপযুগী ধারণালাভের উপায় হিসেবে মৌলিক বইপুস্তক পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন, একই সঙ্গে গবেষণা, কর্ম, লেখালিখি চালিয়ে যান তাহলে তার কাজ থেকে শিক্ষার্থীরা কিংবা পাঠকরা যে জ্ঞানতত্ত্ব পাবেন সেটি অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে। জ্ঞানের নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি করতেও কাউকে না কাউকে প্রভাবিত করতে পারেন।

একজন সাহিত্যিকও নিরন্তর সাহিত্যচর্চার মধ্যদিয়ে মানুষকে আপন সমাজ এবং মানবচরিত্রের নানা দিক সম্পর্কে সচেতন করতে পারেন। একজন বিজ্ঞানী তার গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তি, তত্ত্ব ও প্রয়োগের ধারণায় মানুষকে উদ্ভাসিত করতে পারেন। এসব মেধার কার্যকারিতা। প্রকৃত মেধার জায়গাই হচ্ছে চর্চার মধ্যে। সেটি কালে কালে দেশে দেশে মানুষ ঐতিহাসিকতার মধ্য দিয়ে পড়েছে বলেই আজকের পৃথিবীতে আমরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন-বিচার, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, কৃষি শিল্প, আকাশ, মহাকাশসহ সর্বত্র বিচরণ করতে পারছে। মেধাবীরা এই পথগুলো ছেড়ে যদি কেবলই প্রশাসনের লাল ফিতায় নিজেদেরকে বন্দি রাখে তাহলে সৃজনশীলতার খুব বেশিকিছু থাকে না। কৃতি শিক্ষার্থীদের জীবনে যত আমলাতন্ত্রের ফাইল উঠেছে তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই পেরেছেন তাদের মেধাকে স্বাভাবিক নিয়মে বিকশিত করতে। আমাদের অনেক মেধাবী তরুণ ব্রিটিশ যুগ থেকে সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের দায়িত্ব নিতে গিয়ে তাদের মেধার চর্চার জায়গা ক্ষুদ্র হয়ে যেতে থাকে। ব্যতিক্রম থাকার জন্য যারা লেখালিখি করেছেন, প্রতীকুলতাকে ভেঙে নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করেছেন, তাদের অল্প কয়েকজনই কেবল পেরেছেন সাহিত্য, ইতিহাস ও অর্থনীতি বিষয়ে নিজেদের কিছু গবেষণাকর্ম রেখে যেতে। পাকিস্তান কালেও আমাদের বেশকিছু মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ তরুণ পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি যারা অনুগত থেকেছেন তাদের ব্যক্তিজীবন হয়তো সচ্ছল ছিল কিন্তু জাতি তাদের দ্বারা খুব বেশি উপকৃত হয়নি। আবার কেউ কেউ যখন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে এই পাকিস্তান পূর্ব বাংলার জন্য অভিশাপ তখন তাদেরকে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়েছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে। রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় স্বাধীনতার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন নেতা কর্মীর চিন্তা চেতনার সঙ্গে একমত, দ্বিমত হওয়ার মাধ্যমে তিনি স্বাতন্ত্রিকভাবে বেড়ে উঠেছিলেন। এই বেড়ে উঠাটি তার দেশপ্রেম, মেধা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। এটি তার স্বভাবজাত অর্জন ছিল। সে কারণেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি অন্যসব নেতাকে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায় অতিক্রম করে ৬০-এর দশকে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক চরিত্রে আবির্ভূত হতে পেরেছিলেন। এখানেও মেধা এবং দেশপ্রেম, রাষ্ট্রচিন্তা তার মধ্যে অবিভাজ্যভাবে ছিল। সে কারণেই তিনি পেরেছিলেন প্রকৃত মেধাবী, দেশ, জাতি ও মানুষের প্রতি যাদের ভালোবাসা ছিল তাদের বোধ, চেতনার স্ফূরণ নতুন উচ্চতায় ঘটিয়ে তার সহযাত্রী হিসেবে সমবেত করতে। রাজনীতিবিদ হওয়ার মেধা, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের অনুসঙ্গগুলো এই সময়ে মুজিবকেন্দ্রিক একত্রিত হতে থাকে। এখানে সমবেত হন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামরুজ্জামানসহ অসংখ্য নেতাকর্মী। কিন্তু তাদের বিপরীতে যারা ছিলেন তারা ছিলেন পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ অনুরক্ত। ওইসব নেতারা ইতিহাসে বিপরীত স্রোতে শুধু অবস্থানই করেননি বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকেও বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিল। সুতরাং রাজনীতির ওই সব ডান-বামরা নিজেদেরকে যত মেধাবীই ভাবুক না কেনো তারা রাষ্ট্র সমাজের জন্য প্রতিক্রিয়াশীলই ছিলেন। তাদের বুদ্ধি মেধা সৃজনশীল ছিল না। সেটি আবৃত ছিল উগ্রহঠকারিতা, পরচর্চা, পরনিন্দা এবং দেশপ্রেমে বিযুক্ত। তাহলে এদের আমরা কী বলব? আমির খসরু সাহেবরা মেধার কী সংজ্ঞা আমাদেরকে শোনাবেন। আমরা একেবারেই অজ্ঞমূর্খ নই।

এখন বাংলাদেশে মেধার যে ঢেউ তোলা হচ্ছে সেই মেধার প্রয়োগ ঘটাতে হলে আমাদেরকে শুধুমাত্র সরকারি কর্ম কমিশন বা চাকরিমুখী হলে হবে না। সেখানেও অবশ্যই দেশপ্রেমিক, সৃজনশীল, মেধাবী শিক্ষার্থীদের যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজনীতি, আইন, বিচার, শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য ইত্যাদিতেও নীতি নৈতিকতা দেশপ্রেম এবং আধুনিক বিশ্ব বাস্তবতার জ্ঞানের চর্চা থাকতেই হবে। আমরা ১৮ কোটি মানুষের দেশ। এখনো আমরা খুব বেশি সংখ্যক উদ্ভাবনসক্ষম জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, চিন্তাশীল লেখক, শিক্ষক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী তৈরি করতে পারিনি। অথচ ইউরোপে অনেক দেশ আছে যেখানে ১ কোটি মানুষও নেই। কিন্তু সেখানে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্ঞানী, গুণী, স্বীকৃত গবেষক, বিজ্ঞানী সর্ব পেশায় বিশেষজ্ঞ যথেষ্ট রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কারও তারা লাভ করছেন। তাদের দিকেই আমরা তাকিয়ে থাকি জ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের কথা জানতে। চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ ভীষণ এক প্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা চিকিৎসক তৈরি করলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানী হওয়ার মতো খুব বেশি গবেষক, ডাক্তার তৈরি করতে পারিনি, এরকম অবস্থা সর্ব ক্ষেত্রেই। কারণ আমলাতন্ত্রের পেছনে স্বভাবজাত মেধাবীরা যদি ছোটাছুটি করে তাহলে মেধার বিকাশ না ঘটে সর্বনাশই বেশি ঘটে। আমাদের অনেক মেধাবী তরুণ সে কারণে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার অনেকে দেশে নীরবে, নিবৃতে কিছু কিছু সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের রাজনীতি ও আমলতন্ত্র এসবকে খুব একটা মূল্য দিতে জানে না। সুতরাং কোটা নিয়ে যে কূটতর্ক, মেধা নিয়ে যেসব বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, ‘তরুণ’দের রাস্তায় নামিয়ে শক্তি প্রদর্শনের যে মহড়া দেওয়া হচ্ছে- তা আসলেই প্রকৃত মেধাহীনদের শক্তিক্ষয় করার হীন উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছু নয়।

মমতাউউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কার্যালয়ের সামনে দুই ককটেল বিস্ফোরণ
৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১৬৯০ জন
এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও যোদ্ধাদের স্মরণে ‘বিআরপি’র মশাল মিছিল
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা