ট্রানজিট এবং বিএনপি’র ভারত বিরোধী কৌশল

ট্রানজিট নিয়ে বিএনপি কেন ভারত বিরোধী প্রচারণার কৌশলে অবতীর্ণ হলো? কৌশল যাই থাক, ট্রানজিট বিষয়টির আদ্যোপান্ত না জেনেই অথবা অভ্যাসবশত যে এই বিরোধিতা করা হচ্ছে সেটা বেশ পরিষ্কার। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সংযুক্ততার (কানেক্টিভিটি) নাভিগোলক বা কেন্দ্রবিন্দু (হাব) হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ২১ থেকে ২২শে জুন পর্যন্ত তাঁর দিল্লি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাথে ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। এই ১০টি সমঝোতা স্মারকের অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট ও রেল ট্রানজিট। আর এই সমঝোতা স্মারককে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে ব্যাপক তরজা। বিএনপি এটিকে ‘গোলামীর চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার সাথে সাথে এর দ্বারা বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব’ ক্ষুণ্ন হবার কথা উল্লেখ করে এর বিরোধিতা করেছে। এটি বিএনপি-র ভারত বিরোধী কৌশলেরই বহিঃপ্রকাশ। এক্ষেত্রে আর একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার বিষয়টি জড়িত সেখানে বিএনপি কেন এরূপ ‘দেশের স্বার্থের’ বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে? এই উত্তরে বলা যায়, অতীতের ঘটনাপ্রবাহ সাক্ষ্য দেয় যে বিএনপি-র পক্ষে এমন বিরোধিতা অস্বাভাবিক নয়, অনেকটা পুরাতন অভ্যাসের মতো। যেমন, ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার বিনামূল্যে বাংলাদেশে সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ স্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তির জগতে বাংলাদেশ ২০০৬ পর্যন্ত ১৪ বছর পেছনে পড়েছিল। অপর দিকে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান রেলপথ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল ট্রানজিট সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সাথে সাথে এর বিরুদ্ধে হইচই শুরু হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এইসব বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের রেল ট্রানজিট সমঝোতার বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত জাতীয় শক্তি:
জাতীয় শক্তির অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে ‘ভৌগোলিক অবস্থান’। বাংলাদেশের ‘ভূরাজনৈতিক অবস্থান’ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নে তথা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম একটি উৎস হতে পারে, যদি এটি বিচক্ষণতার সাথে কাজে লাগানো হয়। ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। যা ভৌগোলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উত্তর সীমানা থেকে কিছু দূরে হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্য এবং মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকা। অসংখ্য নদ-নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ মূলত সমতল ভূমির দেশ। বাংলাদেশের স্থল সীমানা রেখার দৈর্ঘ্য ৪২২৬ কিলোমিটার, যার ৯৪ শতাংশ ভারতের সাথে এবং বাকি ৬ শতাংশ মিয়ানমারের সাথে। বাংলাদেশের তটরেখার দৈর্ঘ্য ৫৮০ কিলোমিটার। দেশটির দক্ষিণ পূর্বাংশে কক্সবাজারের অবস্থান। যেখানে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে ভারত উপমহাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নদীপথ গুরুত্ব পেয়ে থাকলেও কালক্রমে রেলপথের আবির্ভাব সমগ্র উপমহাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে স্থাপিত ৮টিরেলরুটসহ নতুন রেলরুট চালু প্রসঙ্গে:
বাংলাদেশে রেলপথের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। বলা হয়, ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিকতার পথে প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই রেল সংযোগ। ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে নামে রেলওয়ে কোম্পানি ১৮৬২ সালের ১৫ই নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত প্রথম বাংলাদেশ রেলপথ স্থাপন করে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশে ১৬০৬.৫৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই থেকে বাংলাদেশের রেলপথের যাত্রা ১৬২ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বর্তমানে ৫০টি জেলাতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু আছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে দেশের সব ক’টি জেলাতে রেল সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের আছে। রেলওয়ের তথ্য বলছে, ব্রিটিশ আমলে বর্তমানের ভারত-বাংলাদেশের আটটি রুটে রেলওয়ে ইন্টারচেঞ্জ ব্যবস্থা চালু ছিল। যে ৮টি পয়েন্টে রেলরুটের ইন্টারচেঞ্জ চালু ছিল সেই পয়েন্টগুলো হলো দর্শনা-গেদে, বেনাপোল-পেট্রাপোল, রোহনপুর-সিংহাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর, শাহবাজপুর-মহিষাসন, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী, বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা ও মোগলহাট-গিতালদহ। এসব ইন্টারচেঞ্জ দিয়ে চলত ১০টি ট্রেন। ট্রেনগুলো হলো দার্জিলিং মেইল, সুরমা মেইল, আসাম মেইল, নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস, বরিশাল এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম এক্সপ্রেস, ঢাকা মেইল (ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস), কাটিহার প্যাসেঞ্জার, আমনুরা প্যাসেঞ্জার ও জয়ন্তী প্যাসেঞ্জার। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও ট্রেনগুলোর চলাচল ছিল স্বাভাবিক। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানে পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালুর পর ট্রেনগুলোর চলাচল ক্রমেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান আটটি পয়েন্টেই রেলরুট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে ১৯৫২ সালের পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৫২ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ভারত-বাংলাদেশের সবক’টি রেলওয়ে ইন্টারচেঞ্জ।
২০০৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পুনরায় চালু হয় দর্শনা-গেদে ইন্টারচেঞ্জ। যাত্রা শুরু করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম আন্তঃদেশীয় ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস। এ রুটে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে মালবাহী ট্রেনও পরিচালিত হচ্ছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া আরো চারটি ইন্টারচেঞ্জ চালু হয়। এর মধ্যে বেনাপোল-পেট্রাপোল ইন্টারচেঞ্জ দিয়ে বর্তমানে খুলনা-কলকাতায় চলাচল করছে বন্ধন এক্সপ্রেস। ট্রেন চলাচল করছে রোহনপুর-সিংহাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর ও চিলাহাটি-হলদিবাড়ী ইন্টারচেঞ্জ দিয়েও। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট ইন্টারচেঞ্জগুলো চালুর জন্য দুই দেশই এখন চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী। পাশাপাশি নতুন নতুন রেলরুটও স্থাপিত হবে।নেপালের সঙ্গে ১৯৭৬ বাংলাদেশের ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর:
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১৬ই জানুয়ারি নেপাল বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে তখন পাকিস্তান সরকার নেপালের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল। অনেক আগে থেকেই নেপাল সরকার বঙ্গোপসাগরের বন্দর ব্যবহার করার প্রয়োজনের কথা জানিয়ে আসছিল। কিন্তু বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল, তখন তারা খুব বেশি সুবিধা আদায় করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে তাদের জন্য ভালো একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে অবৈধভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান (উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার পর জিয়া বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন)। জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের সাথে নেপালের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরো উন্নতি হবার প্রেক্ষাপটে ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ও নেপাল পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্য, ট্রানজিট এবং বেসামরিক বিমান চলাচলের উন্নয়নের জন্য একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে। ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে রুটের সমস্ত যানবহন বিভিন্ন দায়িত্ব ও মূল্য প্রদান করা থেকে অব্যাহতি পায়। নেপালি যানবাহন প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য ৬টি স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে এসে নেপালি পণ্য ট্রাক থেকে নামানো হয়, কারণ সরাসরি নেপালি ট্রাক বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার কথা চুক্তিতে ছিলো না।
ভুটানের সঙ্গে ১৯৮৪ বাংলাদেশের ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর:
ভুটানের সাথে বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে বাণিজ্য ও ট্রানজিট প্রোটোকল এবং একটি প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেং। বর্তমানে, বাংলাদেশ এবং ভুটান বাণিজ্য ও ট্রানজিট প্রটোকলের নির্দেশিকা এবং ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষরিত প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চুক্তির অধীনে পরামর্শের মাধ্যমে তাদের ট্রানজিট চুক্তি পুনর্নবীকরণ করে থাকে। পরবর্তীকালে, বাংলাদেশ ও ভুটান সরকার ২০২৩ সালের ২২শে মার্চ ভুটানের থিম্পুতে 'ট্রাফিক-ইন-ট্রানজিট অ্যান্ড প্রোটোকল সংক্রান্ত চুক্তি' স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি স্থলবেষ্টিত ভুটানকে তাদের আমদানি ও রফতানিমুখী পণ্য চলাচলের জন্য মংলা, পায়রা এবং চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। বাংলাদেশ ভুটানকে তার সড়ক, জলপথ, রেলপথ এবং আকাশপথের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহণের অনুমতি দিয়েছে।
ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে সংযুক্ত হতে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের চুক্তি স্বাক্ষর:
ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হতে ২০০৭ সালে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এ নেটওয়ার্কের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর মধ্যে সহজেই পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। রেল নেটওয়ার্কটিতে যোগ দিতে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশের বিদ্যমান রেল অবকাঠামোও শক্তিশালী করার। যদিও মিয়ানমারের সঙ্গে নিকট ভবিষ্যতে কোনো রেল সংযোগ তৈরির সম্ভাবনা না থাকায় উদ্যোগটি এখন শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়েছে।
ট্রান্সশিপমেন্ট ও রেল ট্রানিজিট বিষয়ে সমঝোতা স্মারক:
২০২৪ সালের ২১ ও ২২শে জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে স্বাক্ষরিত হয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ। এটি আসলে দু’দেশের মধ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট এবং ট্রানজিটের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ নেপালের মধ্যে রেল যোগাযোগ; পাশাপাশি ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে। একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘এটি একটি প্রাথমিক সূচনা। এই সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে বিষয়টির সঙ্গে যতগুলো মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট আছে তাদের প্রতিনিধি থাকবেন এবং ভারতেরও প্রতিনিধি থাকবেন। তারা একটি কমিটির মাধ্যমে ঠিক করবেন কী ধরনের ব্যবস্থাপনায় রেল পরিচালিত হবে এবং মালগাড়ি ট্রেন বা যাত্রীবাহী ট্রেন যেটাই হোক এবং সেটির ট্যারিফ কীভাবে নির্ধারিত হবে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো এই কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে এবং সেইগুলির সূচনা হয়েছে মূলত এই সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে। এটি একটি সমঝোতা স্মারক মাত্র, এটি চূড়ান্ত চুক্তি নয়। ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে নেপাল ও ভুটানকে সংযুক্ত করে একটি সমন্বিতভাবে একটি আঞ্চলিক পারস্পরিক একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির সূচনা।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ট্রানজিট বিষয়ক সমঝোতা স্মারকের সমালোচনা করে যেসব বক্তৃতা বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে সে প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, ‘বিভিন্ন মত ও পথের যারা আছেন তারা তাদের বক্তব্য রাখছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলতে পারি, ‘এটি একটি ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের সরকার ও রেলওয়ের যে স্বার্থ সেইগুলো বজায় রেখে কীভাবে আমরা এটা আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আগামীতে এটা দেশের ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ব্যবস্থায় কীভাবে উন্নীত করা যায় সেভাবে আমরা আগাবো। এখানে (বাংলাদেশ) সরকারের স্বার্থ এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের স্বার্থ সর্বাগ্রে বিবেচ্য।’ বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘বিষয়টা হচ্ছে এটা কেবল সূচনা,...এটার ভিত্তিতে কমিটি গঠিত হবে, সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে, ভারতের রেলওয়ে বোর্ড এবং ভারতের অন্যান্য যারা জড়িত আছেন তাদের সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে মডালিটি নির্ধারণ করা হবে, ভাড়া নির্ধারণ হবে, ট্যারিফ নির্ধারণ হবে। আমরা কীভাবে সুবিধা নেবো অথবা আমাদের মোংলা পোর্ট থেকে আগামীতে আমদানীকৃত মালামাল আমরা কীভাবে বাংলাদেশ থেকে নেপালে পাঠাবো, ভুটানে পাঠাবো। আমাদের সামগ্রিকভাবে এটার কর্মকাণ্ড ব্যাপ্তি হবে, রাজস্ব আয় হবে, সরকারের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি আছে। তারপরও যেহেতু এর সূচনা আগামীতে নির্ধারণ করার পর যখন চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এবং কার্যকর হয়ে যাবে তারপরই কেবল এটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলতে পারে।’
এই সমঝোতা স্মারকের ৩ নম্বর পয়েন্টে ‘আর্মস, এমুনিশন এবং এক্সপ্লোসিভ’ প্রভৃতি না নেওয়ার কথা জোরালোভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, ভারত চীন যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের অস্ত্র-শস্ত্র, গোলাবারুদ এই ট্রানজিট সমঝোতার দ্বারা নেওয়া যাবে না। আবার ৪ নম্বর পয়েন্টে বলা হচ্ছে, ‘দি মুভমেন্ট অব দ্যা গুডস এন্ড পিপল উইদইন বাংলাদেশ এন্ড ইন্ডিয়া শ্যাল বি সাবজেক্ট টু দ্যা রিলিভ্যান্ট ন্যাশনাল লজ, রেগুলেশন্স এন্ড এডমিনিসট্রেটিভ প্রোভিশনস’ অর্থাৎ এই সমঝোতার আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরে পণ্য ও জনগণের চলাচল সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় আইন, বিধিবিধান এবং প্রশাসনিক বিধান সাপেক্ষে হবে। অতএব, বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে এই রেল ট্রানজিটের অধীনে ভারতের পণ্য ও মানুষ পরিবহণের খরচ ধরা হবে বাংলাদেশের আইন, বিধি-বিধান ও প্রশাসনিক বিধান অনুযায়ী। এটি স্পষ্ট। অপর দিকে চীনের দিক থেকে আপত্তির কথা কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের বক্তব্যে উঠে আসছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় এই রেল ট্রানজিটটি ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারত, মিয়ানমার, চীন, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ সহজ হবে। ভারতের সাথে এই রেল ট্রানজিটের কারণে সহজ হবে ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথের বাস্তবায়ন। এই রেলপথের কারণে উন্মোচিত হবে দেশের আরও এক সম্ভাবনার দ্বার। ব্যবসায় বাণিজ্য ও পর্যটন বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক। আগামীতে এই নেটওয়ার্ক চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারত হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। অন্য দিকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর এই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত হবে। আগামীতে বাংলাদেশের মানুষ ও পণ্য যাতে ট্রেনে করে এসব দেশে যাতায়াত করতে পারে তার ব্যবস্থা দ্রুত বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করছে এদেশের মানুষ।ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: কলামিস্ট ও প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা

মন্তব্য করুন