রহস্য বাড়ছে ভোটের মাঠে, কী হচ্ছে ভেতরে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই রহস্যময় হয়ে উঠছে রাজনীতি। দলগুলোর নিত্যনতুন সমীকরণ এখন রাজনীতির ময়দানে। আওয়ামী লীগ এককভাবে সব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেও শরিকদের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচনের ঘোষণা ও একক প্রার্থী দেওয়া জাতীয় পার্টির সঙ্গে বিশেষ বৈঠক নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে ভোটের মাঠে।
এছাড়া দলটির পক্ষ থেকে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে উদারতা দেখানো হলেও গণহারে জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল হওয়ার যে বিষয়টি রয়েছে তা রীতিমতো নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ইতোমধ্যেই। এখন আপিলেও যদি জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়ন ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত বাতিলই করা হয়- তবে গোটা নির্বাচনি প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সব মিলিয়ে এ নির্বাচন ঘিরে নানা অস্পষ্টতা থাকলেও জনসাধারণের কৌতূহল ব্যাপক। তবে তাদের একটাই প্রশ্ন, ‘ভেতরে আসলে কি হচ্ছে? বিএনপিকে ছাড়া শুরু হওয়া এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি কি ভেতরে ভেতরে সমঝোতা করে ফেলেছে? তাহলে কি নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে? ভোটের কি আর দরকার পড়বে না?’
যদিও এসব সন্দেহ-শঙ্কা উড়িয়ে ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। সব দলের সমান অধিকার থাকবে ভোটের মাঠে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া শেষ হয় ৩০ নভেম্বর। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৯টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা এবার নির্বাচনে আসছেন। অন্যদিকে বিএনপিসহ ১৫টি দলের কোনো প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না।
এদিকে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছিলেন যে, নানা চমক অপেক্ষা করছে। আর ঘটলোও তাই। বিএনপি ছেড়ে নতুন দল তৃণমূল বিএনপি গঠন করলেন শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকার। অংশ নিয়েছেন নির্বাচনে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ছেড়ে দিলেন বিএনপি। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন তিনি। আর সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েও শেষপর্যন্ত ভোটে এসেছে জাতীয় পার্টি। সবশেষ বুধবার রাতে গুলশানে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকের বাসায় বিশেষ বৈঠক হয় জাপা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। এ বৈঠক নিয়ে নানা নাটকীয়তা ঘটে। গণমাধ্যমকে বৈঠকের বিষয়ে আড়ালে রাখতে স্থান নিয়ে লুকোচুরি চলে দিনভর।
তবে দল দুটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনকে ত্বরান্বিত করতে বৈঠকে বসেছিলেন। তবে একাধিক সূত্র বলছে, বিএনটি না আসায় জাতীয় পার্টিকে জোটে রাখছে না আওয়ামী লীগ। জাপাকেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে যেতে হবে নির্বাচনের মাঠে। এ শর্তে জাপা রাজি হয়েছে, তবে আসন চেয়েছে ৩৫টি। দলটির নেতারা আওয়ামী লীগ নেতাদের বলেছেন যে, তাদের চাহিদা মতো ৩৫টি আসন থেকে নৌকার প্রার্থীকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তবে ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগ কোনো সুরাহা সিদ্ধান্ত দেয়নি। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে তারা জাপাকে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেছেন।
যদিও বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু আসন ভাগাভাগির কথা অস্বীকার করেছেন ঢাকা টাইমসের কাছে। তারা বলছেন, কৌশলগত আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও ভোটের মাঠে সব রাজনৈতিক দলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ভোট যাতে হয়- তা নিশ্চিত করতেই এই বৈঠক।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা চেয়েছেন ৩০৩ জন। পাঁচটি আসনে নৌকার বিপরীতে দুজন করে প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই। গত সোমবার যাচাই-বাছাই শেষে ২ হাজার ৭১২ জন প্রার্থীর মধ্যে ৭৩১ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে ১ হাজার ৯৮৫ জনের মনোনয়নপত্র।
এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে রেকর্ড সংখ্যক ৭৪৭ জন প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়েছে, এবার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোনো নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলে তাদের বাধা দেওয়া হবে না। যে কারণে দলটির মনোনয়নবঞ্চিত অনেক নেতাই এবার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গেই নৌকার প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তবে জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের যে হিড়িক দেখা গেছে তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রার্থিতা ফিরে পেতে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন। এই আপিলের শুনানি শুরু হবে ১০ ডিসেম্বর থেকে। তবে আপিলেও যদি কোনো প্রভাব খাটিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়- সেক্ষেত্রে মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে নির্বাচনের এই উৎসবমুখরতা। আর প্রশ্নের মুখে পড়বে গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থা। এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কয়েকটি আসনের চিত্র
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হওয়ায় গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এই তিনটি আসনকে বিবেচনা করা হয় আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে। এর মধ্যে কোটালিপাড়া-টুঙ্গিপাড়া থেকে বরাবরের মতো এবারও নৌকার প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এই আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী গণফ্রন্টের সৈয়দা লিমা হাসান, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির নিজামউদ্দিন লস্কর, এনপিপির শেখ আবুল কালাম এবং জাকের পার্টির মাহাবুব মোল্লা।
শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে কখনোই নির্বাচন করে হারেননি। আগের নির্বাচনগুলোতে যারা তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাদের একটি বড় অংশই সেই নির্বাচনগুলোতে জামানত হারিয়েছেন। গোপালগঞ্জের অন্য দুই আসনে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থী ফারুক খান ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম। এদের বিপক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের এলাকায় তেমন পরিচিতি নেই।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবারও নোয়াখালী-৫ আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপির সাবেক নেতা মওদুদ আহমেদের সঙ্গে এই আসনে বরাবরই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো কাদেরের। এবারের নির্বাচনে বিএনপি নেই। তারপরও এই আসনে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন পাঁচজন। স্থানীয় এক রাজনৈতিক কর্মী বলেন, ওবায়দুল কাদের জাতীয় নেতা এবং মালেক উকিলের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তফসিল অনুযায়ী ভোট হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ হবে ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচনের প্রচার শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে। চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত।
(ঢাকাটাইমস/০৮ডিসেম্বর)