নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক তো হলো, শান্তিপূর্ণ হবে কি?

আলী রেজা
| আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:৪৪ | প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:৩৯

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যাঁরা মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন তাঁদের মধ্য থেকে দুই হাজার সাত’শ ষোলোজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। যাচাই-বাছাই শেষে এক হাজার নয়’শ পঁচাশি জনের মনোনয়ন বৈধ বলে বিবেচিত হয় এবং বিভিন্ন অভিযোগে সাত’শ একত্রিশ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত মোট ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে ৩০টি রাজনৈতিক দল এবং প্রায় সাড়ে সাত’শ স্বতন্ত্র প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। সুতরাং এ নির্বাচনকে আইনগতভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না বলার কোনো সুযোগ নেই। এখন জনমনে একটাই প্রশ্নÑ আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে কি? নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য কমিশন ইতোমধ্যেই নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ১০ই ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে সমাবেশ করার অনুমতি চাইলেও নির্বাচন কমিশন অনুমতি দেয়নি। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকেও অনুমতি দিবে বলে মনে হচ্ছে না।

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য ৩৩৮টি থানার ওসি ও ১১০টি উপজেলার ইউএনওকে বদলির ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজন হলে মাঠ প্রশাসনের বাকি কর্মকর্তাদেরকেও বদলির আওতায় নিয়ে আসার কথা জানা গেছে। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সেনা মোতায়েনের ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা চলছে। এসব দেখে অনুমান করা চলে যে, নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে কমিশন যথেষ্ট আন্তরিক। যাঁরা নির্বাচন বর্জন করেছেন তাঁদের কাছে নির্বাচন কমিশনের এসব পদক্ষেপের কোনো গুরুত্ব নেই। তারা বিশ্বাস করে নির্বাচন হবে একতরফা এবং কমিশন ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করবে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আগের দুটি সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করার কারণে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। তবু আইনগতভাবে নির্বাচনটিকে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে দেখানো গেছে। সরকারও তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। আইনগতভাবে অংশগ্রহণমূলক হলেও ঐ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ছিল না।

নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ও পেট্রোল বোমা আতঙ্কে দেশের সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ হয়েছিল। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ব্যাপকভাবে। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেড় শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে সে নির্বাচন নিয়েও তৈরি হয়েছিল নানা প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ঐ সময় নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ভয়াবহরূপে দেখা যায়নি। আসন্ন নির্বাচনেও সহিংসতার সম্ভাবনা নেই বলা যায়। কারণ নির্বাচন পূর্ববর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো নয়। সাধারণ মানুষ এখন বিরোধীপক্ষকে বেশ দুর্বল মনে করছে। বিশেষ করে রাজপথের আন্দোলনে তারা তাদের সাংগঠনিক শক্তি দেখাতে পারছে না। এ অবস্থায় নির্বাচনকে বানচাল করার শক্তি বিরোধীপক্ষের নেই বলেই মনে করছে সাধারণ মানুষ। ফলে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ না হওয়ার দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। নির্বাচনে জনপ্রশাসন আইনত নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকলেও সরকার তাদের ওপর প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখতে পারে। এ বিষয়টিও নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিএনপি সমর্থক। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না বলে তাদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। অনেক নেতাকর্মী ক্ষুব্ধ হয়ে রাজনীতিতে নিক্রিয় হয়ে পড়েছে। অনেকে দল বদল করছেন। অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন। বিএনপির ১৫জন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৩০জন সাবেক এমপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। তাঁদের প্রায় সকলের মনোনয়নপত্রই বৈধতা পেয়েছে। মূলধারার একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির জন্য এ বিষয়গুলো বিব্রতকর।

আসন্ন নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ। অতীতেও নির্বাচন বর্জন করে কোনো লাভ হয়নি। নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে সত্য; কিন্তু বিএনপি তার সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থন দিয়ে এমন কোনো গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি যার ফলে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছে। বরং আইনগত বৈধতা পেয়ে সরকার পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছে। এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আওয়ামী লীগের অধীনে এ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণার ফলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে জনমনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট নমনীয় হতে দেখা গেছে। বিএনপি নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত নিলে তফসিল পরিবর্তন করতে চেয়েছে কমিশন। কিন্তু বিএনপি তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে মনোনয়নপত্র উত্তোলন ও জমাদানের সময় পার করে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো যেকোনো মূলে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে কিংবা অতর্কিত হামলা করে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করা ছাড়া বিএনপির সামনে আর কোনো কাজ নেই। কারণ যারা নির্বাচন বর্জন করবে তাদেরকে নির্বাচন বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টাও করতে হবে। ব্যাপক সহিংসতা ছাড়া আসন্ন নির্বাচনকে বানচাল করার আর কোনো পথ নেই। তবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে সবাইকে সহিংসতার পথ ছেড়ে দিতেই হবে।

বর্তমান তফসিলের রোডম্যাপ অনুযায়ী বিএনপি এই নির্বাচন থেকে বাদ পড়ে গেছে। এখন বিএনপিকে খুব সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করতে হবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার লাভ-ক্ষতি বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে দলের নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে যায়। দলের প্রতি আনুগত্য কমে যায়। বিএনপি যাদের নিয়ে জোট করেছিল তাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকটি দল ইতোমধ্যে জোট থেকে বেরিয়ে এসে নির্বাচন করছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে দলটির অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছে। তাদের ব্যাপারে কোনো কঠোর দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এখন বিএনপিকে সতর্কতার সঙ্গে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। সম্ভাব্য সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচন সহিংসতা হলে জনগণ যাতে বিএনপিকে দায়ী করতে না পারে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী অনির্বাচিত কোনো সরকারের ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই। কোনো কারণে নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হলে যা হয় সেটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়। তবে সে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে না বাংলাদেশ। কারণ এ সময়ের মধ্যে বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই নির্বাচনি সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়েই ভাবছে সাধারণ মানুষ।

নির্বাচন যতই শান্তিপূর্র্ণ, অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর হোক না কেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিএনপি ও বিএনপি সমর্থিত মিডিয়া নির্বাচনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবে এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের পক্ষে এ ধরনের চিন্তা সমীচীন নয়। নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপির দৃশ্যত কোনো লাভ নেই। কিন্তু ক্ষতি আছে নানা দিক দিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে আছে। মূলধারার একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলে সে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। নেতা-কর্মীদের তৎপরতা কমে যায়। নতুন প্রজন্মের কাছে দলটি তার ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে পারে না এবং নতুন প্রজন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রায় দেড় যুগ ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে আছে। দেড় যুগ পূর্বে জন্ম নেওয়া একটি শিশু এখন ভোটার হওয়ার বয়সে উপনীত হয়েছে। জন্মের পরে সে বিএনপির শাসন দেখেনি। এটা বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক ক্ষতি। সহিংসতার মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইলে সে ক্ষতি আরো বাড়বে। নির্বাচন বর্জন করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু নির্বাচন প্রতিহত করার অধিকার কি জনগণ কাউকে দিয়েছে?

আলী রেজা: পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :