আগুনে নিঃস্ব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিচ্ছে কারা?

তানিয়া আক্তার, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:৩১
অ- অ+

রাজধানীর কৃষি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরা জীবনের চাকা ঘোরানোর চেষ্টা করছেন। মার্কেটের সামনের ফুটপাতে অল্প মালামাল নিয়ে কম দামে পণ্য বিক্রিসহ ধুলোবালি আর রৌদ্রের তাপে নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় দিন পার করছেন তারা। ফুটপাতে বসার কারণে ক্রেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও হারাচ্ছেন। তবে খোলা আকাশের নিচেও দিতে হচ্ছে নির্দিষ্ট অংকের টাকা। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে এই টাকা জানেন না ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে জানেন না খোদ মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতিও। ব্যবসায়ীরা মার্কেটে কবে নাগাদ ফিরবেন সে বিষয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। এমন অনিশ্চিয়তা আর দুশ্চিন্তা দগ্ধ দিনগুলোর চেয়েও বেশি পোড়াচ্ছে তাদের।

সরজমিনে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ডিএনসিসির মালিকানাধীন মোহাম্মদপুর নতুন কাঁচাবাজারে (কৃষি মার্কেট) সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানদারদের সাথে আলাপকালে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

কৃষি মার্কেট সংলগ্ন পার্কিং এরিয়ায় পসরা সাজিয়ে বসেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কাপড় ব্যবসায়ীরা। একই অংশে ব্যাগ, গয়না, ঘড়িসহ নানা ধরণের পণ্য নিয়ে বসেছেন তারা। এই খোলা আকাশের নিচে বসেও ধরণভেদে দিনপ্রতি কারো গুণতে হচ্ছে ১৩০০ কেউবা গুণছেন ৮০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। মার্কেটের যে পাশটায় গরু এবং মুরগী বিক্রেতারা রয়েছেন সেই জায়গাটা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় তাদের দোকান ভাড়ার টাকাটাই দিতে হয়। তবে তাদের মুখোমুখি মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত মুদি ব্যবসায়ীরা বসেছেন ছাউনির নিচে। তাদের দিনপ্রতি গুণতে হচ্ছে ১৫০ টাকা। কারা এই টাকা নিচ্ছেন তা স্পষ্টভাবে না জানলেও স্থানীয় নেতাদের কর্মীরা এই টাকা উঠাচ্ছেন বলেও ধারণা করছেন কেউ কেউ।

গোটা কয়েক গহনার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন। মার্কেটের ভেতর যত্নে থাকা সোনালী রঙের গহনাগুলো এখন রাস্তার ধুলোবালিতে ধুসর হয়ে গেছে। ক্রেতা উপস্থিতি একেবারেই কম। স্থান সংকুলানের কারণে পরিচিত ক্রেতারাও আসে না এবং নতুন ক্রেতারাও ফুটপাতে গহনার উপর ভরসা করতে পারছে না। ফলে নিতান্ত দুঃখে দিন পার করছেন তিনি। এরইমধ্যে এখানে বসেও গুণতে হচ্ছে প্রতিদিন ২৫০ টাকা।

কৃষি মার্কেটে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ফুটপাতে কে গহনা কিনতে আসবে। পরিচিত কাস্টমারও হারাইলাম। কবে মার্কেটে ফিরতে পারবো জানি না। কিন্তু এই খোলা আকাশের নিচেও তো ২৫০ টাকা দিয়া বসতে হয়।’

প্রসাধনীর পাশাপাশি মার্কেটে ব্যাগের দোকানও ছিলো ব্যবসায়ী আবু বকর ছিদ্দিকের। হঠাৎ এক ভোরে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় ফুটপাতে ঠাঁই নিয়েছেন তিনি। প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকার পণ্য পুড়ে গেছে তার। ত্রাণ পেয়েছেন মাত্র ২৫ হাজার টাকা। এরপর আর কোনো ত্রাণ বা কোনো আর্থিক সহযোগীতা পাননি। এখন নিতান্ত জীবিকার দায়ে শুধুই কয়েক ধরণের ব্যাগ বিক্রি করতে বসেছেন। কারণ ফুটপাতে প্রসাধনী নিয়ে বসলে ক্রেতারা মান নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। এছাড়া ধুলোবালির আস্তর জমে প্রসাধনী নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। মার্কেটে কবে ফিরতে পারবেন সেটা নিয়েও রয়েছেন ধোঁয়াশায়।

ব্যবসায়ী আবু বকর ছিদ্দিক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ফুটপাতে কে কসমেটিক কিনতে আসবে? ভালো কসমেটিক বিক্রি করি কাস্টমাররা বিশ^াসই করতে চায় না। তাই ব্যাগ নিয়া বসছি। শীতের দিন রাস্তার সব ধুলা ব্যাগের উপর পড়ে। কয়েক মাস ধরে বসে আছি এখানে। রোজার মধ্যেই মার্কেটে ফিরতে পারবো শুনলাম। কিন্তু মার্কেটের কাজ কতদূর হলো তা জানি না। কবে ফিরতে পারবো তাও জানি না। ’

পোশাক নিয়ে ফুটপাতে বসা আরেক ব্যবসায়ী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ মার্কেটের দামে তো বিক্রি হয় না। ১২ লাখ টাকার কাপড় পুড়ছে। লাভের আশা তো দূরে; এখন পেটের দায়ে বিক্রি করি।’

মার্কেটে গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা থাকায় রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে ক্রেতা আসতেন। কিন্তু ফুটপাত মনে করে তারা এখন আসেন না। মার্কেট সংলগ্ন এলাকার পরিচিত ক্রেতারাই এখন ভরসা তাদের।

ব্যবসায়ী সুরুজ মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘খোলামেলা দোকানে মালপত্র রাখারই জায়গা নাই। চারটা মুদি আর চালের দোকানছাড়াও চালের গুদাম ছিল আমার। কোটি টাকার মাল একদিনে সব পুইড়া শ্যাষ (শেষ)। তাই আমরাই রাস্তার উপর বইসা রইছি। দামী কাস্টমার বসতে দিমু কই। গাড়ি রাখারও তো জায়গা নাই। এলাকার ছোট কাস্টমার মাঝেমধ্যে আসে। এটা দিয়াই পেট চালাই।’

ঘড়ির দোকান নিয়ে বসে আছে জয় নামের এক দোকানি। জয় ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আগে সব এলাকা থেকে মানুষ আসতো। এখন এলাকার মানুষজনই আসে। অর্ধেক দামে বিক্রি কইরা দিতে হয়।’

ধুলোবালি মাখা চাল নিয়ে ফুটপাতের সামনে বসে আছেন রফিকুল ইসলাম। তার দোকানের সামনেই সড়কে দাঁড়ানো গাড়ি দেখিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এইটা চাউল নিয়া বসার জায়গা? গাড়ি দাঁড়ায়া থাকে। কাস্টমারও আসতে পারে না। মালামাল চুরি হয়ে যায়। একমাসের মধ্যে মার্কেট ঠিক কইরা দিবো কইছে, এখন চারমাস চলতাছে। এর উপর আবার টাকা দিয়াও বসতে হয়।’

মার্কেটের সংলগ্ন ফুটপাতের একটা অংশ ছাউনি দেয়া। এর নিচে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মুদির দোকানের নানা পণ্যসহ মুরগী, গরুর মাংস নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। মার্কেটের চারদেয়ালে সাজানো সব পণ্য এখন সংকুচিত স্থানে জড়োসড়ো হয়ে ক্রেতার অপেক্ষা করছেন। এই কষ্টের মধ্যে প্রতিদিন নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিতে হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায় এই টাকা কে নিচ্ছে তারা জানেন না। প্রতিদিনের টাকা নেওয়ার কোনো রশিদও পাননি তারা। কিন্তু মার্কেটের এক অংশে ১৫০ টাকা এবং আরেক অংশ থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে থাকেন বলে জানান তারা।

মুদির পণ্যে পসরা সাজিয়ে বসা কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এতগুলা টাকার জিনিস পুড়ে এখন ফুটপাতে বসলাম। এইখানেও টাকা দেওন লাগে। আমরা দিনে দেড়শ টাকা দিই আর বাইরের ওইপাশের ফুটপাতের ওরা দেয় আড়াই’শর মতো। কার কাছে এই টাকা যাচ্ছে তা জানি না। টাকা দেওয়ার কোনো পেপারও পাইলাম না। ‘লোকাল নেতা আর কাউন্সিলের লোকজন ছাড়া এই টাকা উঠানোর জোড় আছে কার? ’ প্রশ্ন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আরও জানা যায় এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা ছিল। তাই এখানে বসার কারণে গাড়ি পার্কিংয়ের ভাড়া তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। এছাড়া লাইট, ঝাড়ু, নাইটগার্ডসহ বিভিন্ন সুবিধার কথা বলে টাকাগুলো দৈনিক নিচ্ছে। কিন্তু দৈনিক এই ভাড়ার টাকাই উঠে না। এটা অনেকটা মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের সমান বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা।

তবে ফুটপাতে বসা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিনের টাকা নেয়ার বিষয়টি জানেন না কৃষি মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু।

কৃষি মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মার্কেট পুড়ে যাওয়ার পর গরীব মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে এখানে তাদের বসার ব্যবস্থা করে দিলাম। তাদের তো টাকা দেওয়ার কথা না। কার কাছে তারা কত টাকা দিচ্ছে তা আমার জানা নেই।’

গতবছরের ১৪ নভেম্বর কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ৬০ দিনের মধ্যে পুননির্মানের কাজ শুরু হয়। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবার কথা থাকলেও আদতে কবে শেষ হবে তা জানেন না কৃষি মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু নিজেই। তবে ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যে শেষ হবার প্রত্যাশা রয়েছে তার। এবিষয়ে সলিমুল্লাহ সলু বলেন, ‘মার্কেট আগের মতোই তৈরি করা হচ্ছে। যার দোকান যেখানে ছিল তিনি সেখানেই ততটুকুই পাবেন। অনেক ধরণের কাজ করতে হচ্ছে। আশা করছি সাত থেকে আট মাসের মধ্যে শেষ হবে।’

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছে মার্কেটের ডিজাইন চূড়ান্ত হয়ে পাইলিংয়ের কাজ চলছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যেই মার্কেটে কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন অঞ্চল -৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মোতাকাব্বীর আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মার্কেটের ডিজাইন সাবমিট হয়েছে। পাইলিংয়ের কাজও চলছে। আমরা মনিটরিং করছি। সর্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

কৃষি মার্কেটের ভেতরের ফাঁকা জায়গাতে ইট, গাছের কাটা ডালসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। খোঁড়াখুঁড়িও চলছে। তবে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। কর্মীরা কাজ করে চলেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন শুধু একবেলা কাজ করছেন তাই দেরী হচ্ছে। দ্রুত কাজ শেষ করতে দুই শিফটে কাজ করার অনুরোধ ব্যবসায়ীদের।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, রোজার আগে মার্কেটের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও যে ধীর গতিতে কাজ চলছে তাতে একবছরেও শেষ হবে কি না বলতে পারছি না। তবে দুই শিফটে কাজ করলে কিছুটা আগে শেষ হতো। আমরাও আগেভাগে মার্কেটে উঠতে পারতাম। এখানে আয়- রোজগার একেবারে কম।

(ঢাকাটাইমস/১০ জানুয়ারি/টিএ/এসআইএস)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এপ্রিলের ২৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার
নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই সব দেনা পরিশোধ করল পেট্রোবাংলা
ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব: অর্থ উপদেষ্টা
উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময়, বিভিন্ন প্রস্তাব বাস্তবায়নের আশ্বাস
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা