কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তিতে জোর বিএনপির

দীর্ঘ ১৭ বছরে কারাবন্দি হয়েছেন বিএনপির কয়েক লক্ষাধিক নেতাকর্মী। আসামি হয়েছেন অর্ধকোটিরও বেশি। বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকে। দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা শুধু নয়, খোদ বিএনপি চেয়ারপার্সন থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারাও জেলে যাওয়া থেকে রক্ষা পাননি। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তার হয়েছেন নয়বার। এখনও আছেন কারাগারে।
দলটির হাইকমান্ড নেতাদের ভাষ্য- কারান্তরীণ নেতাদেরকে মুক্ত করাই দলের জন্য এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এক দফার আন্দোলন জোরদার ও সাংগঠনিকভাবে দাঁড়াতে নেতাকর্মীদের মুক্তি এখন সবচেয়ে জরুরি। তবে কোন পথে মিলবে মুক্তি? সে পথ খুঁজে বের করতে মরিয়া বিএনপি।
এদিকে গত তিন মাসে সাজা দেওয়া হয়েছে দলটির প্রায় ১৭শ নেতাকর্মীকে। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে বিএনপির প্রথম সারির কয়েকজন নেতাও রয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যানবাহনে আগুন দেওয়া, ভাংচুর, পুলিশের ওপর হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
দলটির একটি সূত্র জানায়, দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়ে করা হয়েছে একটি সমন্বয় কমিটি। এতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনকে। বিভিন্ন জেলায় নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে আইনজীবী। বিভিন্ন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সমন্বয় করছেন জেলা নেতাদের সঙ্গে। নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীরা আটককৃত নেতাকর্মীর নথি সংগ্রহ করছেন।
এসব মামলার বড় অংশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাদী পুলিশের সদস্য, সাক্ষীরাও পুলিশের সদস্য। আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশ নিজেই এসব মামলায় একটি পক্ষ। আবার দেখা যাচ্ছে সাক্ষ্যও দিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। কোনো স্বাধীন সাক্ষী নেই। এগুলো নজিরবিহীন ঘটনা বলছে বিএনপি। বিচার ব্যবস্থায় নতুন সংযোজন।
গত তিন মাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের দুইজন উপদেষ্টা, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন যুগ্ম মহাসচিব, চারজন সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক, তিনজন নির্বাহী কমিটির সদস্য, ঢাকা মহানগরের তিন শীর্ষ নেতা, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং জেলা পর্যায়ের কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
বিএনপির সমস্ত আন্দোলন, প্রতিরোধ, বর্জন উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা পূর্ণতা পেয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য যে সরকার গঠিত হয়েছে- তারা দায়িত্ব পালন করবেন। বিএনপির কোনো প্রতিরোধই এক্ষেত্রে কাজে আসেনি।
দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচন প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের এখন লক্ষ্য কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্ত করা, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সাংগঠনিক শক্তি ও শৃঙ্খলা ধরে রাখা।
এ বিষয়ে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, শুধুমাত্র নেতাদের কারামুক্তই মূল লক্ষ্য কথাটি সঠিক নয়। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। বর্তমানে ২২ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আছেন। যারা আটক আছেন তাদের বিরুদ্ধে ফেইক মামলা দেওয়া হয়েছে। তাদের মুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, এখানে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাজনৈতিক। যাতে করে বিএনপির বিভিন্ন পদের দায়িত্বশীল যারা নেতাকর্মী আছে, তারা যেন রাজনৈতিক হয়রানি, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়।
বিএনপির অভিযোগ, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে একদফা আন্দোলন জোরদার করলে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-গণহারে গ্রেপ্তার শুরু হয়। একপর্যায়ে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রেপ্তার শুরু হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে এখন পর্যন্ত বিএনপির প্রায় ২৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে দলটির অভিযোগ। কয়েকজন কারাগারেও মারাও গেছেন।
কয়েকজন নেতা কারামুক্ত হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এখনো কারাবন্দি রয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, জহির উদ্দিন স্বপন, বিলকিস জাহান শিরিন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, মো. আমিনুল হক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন, যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম মুন্না, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিন, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি আলী আকবর চুন্নুসহ অনেকেই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে ১৪ হাজার ১১ জনের বেশি অধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মোট ৫০৪টি মামলায় আসামি ৫২ হাজার ৬৯৩ জনের বেশি। হামলায় আহত ২ হাজার ৭৭ জন। আর নিহত হয়েছেন ১৫ জন। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের আগে থেকে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার ৫০৪ জনের বেশি গ্রেপ্তার, ৭৭৫টির বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ২৮ ও ২৯ জুলাইয়ের পর থেকে ১ হাজার ১৭৫টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৮৫ জনকে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রসঙ্গে ঢাকা টাইমসকে বলেন, শুধু নেতাকর্মীদের মুক্তি নয়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়েই বিএনপি এগুচ্ছে। তাছাড়া আমাদের এক দফাতেও নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ আছে। বিএনপি প্রতিটি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/২০জানুয়ারি/জেবি/বিবি/জেডএম)

মন্তব্য করুন