অর্থনীতিতে পোশাকশিল্প ও বিশ্ববাজার

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
  প্রকাশিত : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:৫৫
অ- অ+

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখলে বুকটা কত ফুলে ওঠে, তা যেকোনো প্রবাসীই অনুমান করতে পারেন। হ্যাঁ, বিদেশে এখন একটি বড়ো অর্থনৈতিক উৎসের নাম বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি। শ্রমে-ঘামে বেড়ে ওঠা একটি শক্তি। যা বাংলাদেশকে একটি বড়ো আয়ের উৎস হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে পোশাক শিল্পের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি রপ্তানিমুখী খাতের মধ্যে পোশাক শিল্পই অন্যতম। যেকোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে সে দেশের শিল্পের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিল্পনির্ভর। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এখানে শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। গোটা বিশ্বে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে।

এ দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিবাণিজ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ শিল্পের অবদান উৎসাহজনক। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এই শিল্পের হাত ধরে বিশ্ববাজারে একটি ব্র্যান্ড সৃষ্টি করেছে। যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমাদের দেশ বিশ্বদরবারে নতুন পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করছে। বাংলাদেশের নারীদের হাতের তৈরি পোশাক গত বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলোয়াড়দের পরনে ছিল। যা আমাদের গর্বের বিষয়। দেশের উন্নয়নে এই গার্মেন্টস শিল্পের এত অবদান থাকা সত্ত্বেও বিগত সরকারের আমলে যথেষ্ট সদিচ্ছার অভাব ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে এই শিল্প এগিয়ে চলছে ত্বরিত গতিতে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত এবং চক্রান্ত পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প।

এই শিল্পের ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬০ সালে। দেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয় ঢাকার উর্দুরোডে যার নাম রিয়াজ গার্মেন্টস। প্রাথমিকভাবে রিয়াজ গার্মেন্টস-এর উৎপাদিত পোশাক স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা হতো। ১৯৬৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস-এর উৎপাদিত ১০,০০০ পিস শার্ট বাংলাদেশ হতে সর্বপ্রথম বিদেশে (ইংল্যান্ডে) রপ্তানি করা হয়। মূলত ১৯৭০ সালের পরই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ ঘটে বলে বিভিন্ন স্থানে তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে।

মাত্র ৭ হাজার মার্কিন ডলার রপ্তানি হয়েছিল সে বছর। সাহসী উদ্যোক্তা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পরবর্তী দেড় দশকে খাতটির তেমন অগ্রগতি হয়নি। গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে ১৯৮১-৮২ সালে ০.১ বিলিয়ন ডলার রেডিমেইড গার্মেন্টস রপ্তানি করে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পদচারণা আরম্ভ হয়। মাত্র ১০ বৎসরের ব্যবধানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ১৯৯২-৯৩ সালে ১৪৪৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারে উন্নীত হয়।

ক্রমশ পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে আয় হয়েছে মাত্র ৬২ কোটি ডলার। প্রথমে একদল নবীন উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে পরবর্তী ৫ বছরে রপ্তানি আয় কয়েক গুণ বাড়ে। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় ২২৩ কোটিতে উন্নীত হয়। ২০০৮ সালে মন্দা দেখা দেওয়ার পর তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যাবে এমনটাও অনেকে আশঙ্কা করেছিল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৯৪ শতাংশ হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত দেশগুলোতে।

২০১১-১২ অর্থবছরে সর্বমোট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৯,০৮৯.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে তা ২০১২-১৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১,৫১৫.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ৯,৬৫৩.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রপ্তানি আয় বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০০০-এর উপর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে। যেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে পোশাক উৎপন্ন করা হচ্ছে। ’৯০ দশকের পর নারীদের অন্তর্ভুক্তি এই শিল্পকে আরো গতিশীল করে তোলে।

এর মাঝে ঘটেছে না না শোকাবহ ঘটনা। শ্রমিক অসন্তোষ, মালিক-শ্রমিকের বিরূপ সম্পর্ক, বৈদেশিক বাধা, অগ্নিকাণ্ডসহ নানা দুর্ঘটনা ছিল গার্মেন্টস শিল্পের নিত্য সঙ্গী। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে নিভে যায় প্রায় ৩ হাজার তাজা প্রাণ। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে আরো দুই হাজার চারশ’ পোশাক শ্রমিক।

রানা প্লাজা ধস কেবল বাংলাদেশকেই নয়, বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। দেশের ইতিহাসে মানবসৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় এটা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ এই তৈরি পোশাক শিল্প খাতে এমন মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলা সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় এই খাত। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে স্বজনহারা মানুষ।

এর পরে আসা যাক আন্দোলনের বিষয়ে। শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছে দেশের গার্মেন্ট শিল্প। সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে গোটা গার্মেন্ট শিল্পকে হুমকির মধ্যে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিকে সামনে রেখে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির নামে গার্মেন্টসে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য গার্মেন্ট শ্রমিকদের উসকে দেওয়া হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্পে অশান্ত, উত্তপ্ত ও অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে কাজ করে কয়েকটি গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠন। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় গার্মেন্ট শিল্পের সংঘর্ষ, সংঘাত, অবরোধ, ভাংচুর ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চলে। নিকট অতীতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গার্মেন্ট শিল্পে সহিংসতা ও সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম নিহত হওয়ার আগে যে শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই শ্রমিক সংগঠনটি। আরো অভিযোগ আছে, গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের বেশ কিছু নেতার সঙ্গে বিদেশি প্রভাবশালী মহলেরও যোগাযোগ আছে।

এই বিষয়টি আমরা আবারও দেখেছি, গার্মেন্টস বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ এন্টনি ব্লিঙ্কেন-এর কথায়। গত ১৬ই নভেম্বর ২০২৩ একটি স্মারকে সই করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউজ বিষয়টিকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে। সেই নীতি সব দেশের জন্য প্রযোজ্য হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যখন এর বিস্তারিত তুলে ধরেন সেখানে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।

তিনি বলেছিলেন, ‘যারা হুমকি দেয়, ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী বা শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে তাদেরকে আমরা জবাবদিহি করবো। নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তি, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো যতো বিষয় রয়েছে তার সবই ব্যবহার করা হবে। আমরা কল্পনা আক্তারের মতো মানুষদের সাথে থাকতে চাই। কল্পনা আক্তার একজন বাংলাদেশি গার্মেন্টস কর্মী এবং গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার কর্মী। তিনি বলেছেন যে, তিনি জীবিত রয়েছেন কারণ মার্কিন দূতাবাস তার পক্ষে কাজ করেছে।’

এটা খুবই স্বীকৃত বিষয়, আমেরিকার মেসি’স, জে সি পেনি, সিয়ারস, ওয়ালমার্টসহ অনেক বড়ো বড়ো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এখন বাংলাদেশের পোশাকে সয়লাব। যা গোটা জাতির জন্য গর্বের বিষয়। জাতিগতভাবে আমরা কি এ গৌরব ধরে রাখতে পারব না? এই যে এত আহ্বান, তার কি কোনো সুরাহা হয়েছে? না হয়নি। কেন হয়নি? নিশ্চিন্তপুর ট্র্যাজেডি নিয়ে জাতীয় শোক পালিত হয়েছে। কিন্তু এই যে অশনি সংকেত, তার যদি স্থায়ী সমাধান হয়েছে কি ? না হলে এতে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারে, তা কেন আমরা ভুলে যাচ্ছি। আসল কথা হচ্ছে, যে কোনো অপশক্তিই এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে জড়িত থাক না কেন, ওদের চিহ্নিত করা হোক; বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।

গার্মেন্টস শিল্প রক্ষায় ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, তাদের এই গোয়েন্দারা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। উদ্যোগটি খুবই ভালো ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা তৈরির একটি প্রবণতা প্রায়ই লক্ষ করা যায়। এটা কারা করছে, কেন করছে- তা ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ হয়ত জানেন। হয়ত জানে রাষ্ট্রের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। তা জানারই কথা। কারণ রাষ্ট্রে এমন কোনো অশুভ তৎপরতা চলতে পারে না, যা রাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানিকে ব্যাহত করে।

অধুনা বিশ্বে গার্মেন্টস শিল্প একটি লাভজনক ব্যবসা। বিশেষ করে শ্রমের মূল্য যেসব দেশে তুলনামূলক কম সেসব দেশে পাশ্চাত্যের দেশগুলো তাদের প্রস্তুতকারক এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরোবাজার দখল করে নিয়েছে চীন। ‘মেড ইন চায়না’ এখন একটি কমন দ্রষ্টব্য বিষয়। তা ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও মেক্সিকো প্রভৃতি দেশেও ম্যানুফ্যাক্সারিং ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বিক্রেতারা। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- মূল্যের সাশ্রয়। বিশেষ করে কম শ্রমমূল্যে ভালো কোয়ালিটির তৈরি পোশাক বাজারজাত করা।

যারা গার্মেন্টসে কাজ করেন তারা গেল আড়াই দশক আগে অন্য পেশায় ছিলেন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই এই পেশায় যোগ দেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই শিল্পের বিকাশের তুলনায় গার্মেন্টস কর্মীদের ভাগ্য ফিরেছে কি? না, ফিরেনি। বরং তুলনামূলক চাকরির বাজারে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তাদের জীবন ধারণের চাহিদার তুলনায় প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিতান্তই অপ্রতুল। এটা খুবই দুঃখের কথা বাংলাদেশে শ্রমক্ষেত্রে ‘ওভারটাইম’ পদ্ধতি এখনো শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। অতিরিক্ত ঘণ্টা কাজ করিয়েও ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হয় না। এই ব্যবস্থার অবসান দরকার।

বাংলাদেশে শ্রমক্ষেত্রে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। শ্রমিকদের ইউনিয়ন বিদেশেও আছে। কিন্তু সেসব ইউনিয়ন এতই শক্তিশালী এবং সুসংহত যে, তারা সব সময় শ্রমিকের অধিকারকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। অথচ বাংলাদেশের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সব সময়ই আপসকামী। তারা সরকার কিংবা বিরোধীদলের সঙ্গে আঁতাত করে সব সময়ই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে ব্যস্ত থকে। সরকারি শ্রমিক ইউনিয়ন বনাম বিরোধীদলীয় শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিযোগিতায় পিষ্ট হয় সব সময় সাধারণ শ্রমিক। আর নেতারা ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয় রাতারাতি।

একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সব সময়ই অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিকভাবে শান্তি না থাকলে সমাজও এগুতে পারে না। বিশেষ করে গেল দুই দশকের এই রাজনৈতিক অস্থিরতাই বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হয়েছে। সেই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দুষ্ট দুর্নীতিবাজ চক্র। তারা সরকার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কায়েম করেছে নিজ নিজ রাজত্ব। এই রাজত্বের দীর্ঘসূত্রিতা এবং সঞ্চিত অপশক্তিই আজ দেশে সব উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে। যা একটি দেশের জন্য চরম বিপজ্জনক সংকেত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়ানো খুবই দরকারি কাজ। গার্মেন্টস শিল্প এবং শ্রমিকের মূল্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী এক্সপোর্ট জোন গড়ে তোলা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে আরো লাভজনক করতে হলে তুলনামূলক মূল্য নির্ণয়ের মাধ্যমে বিশ্বে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। ক্রেতাদের বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের গুণগত মানের বিশেষত্ব দেখাতে হবে। বাইরের শক্তির সব ষড়যন্ত্র রুখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে এই শিল্পের ক্ষতি হলে গোটা দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনৈতিকভাবে। শিল্পের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ভ্যালু বাড়াতে হবে। এই তদারকির কোনোভাবেই যেন গাফিলতি না হয়। শ্রমিককে যথার্থ পারিশ্রমিক দিতে হবে। শিশুশ্রম বিষয়টিকে কোনোভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত নয়। ন্যায্য ওভারটাইম মানি যাতে সবাই পায় সেদিকে ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। গার্মেন্টস শিল্পে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সব প্রবণতাকে রুখতে হবে। মালিকদের মনে রাখতে হবে, ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিলে সুনাম পুনরুদ্ধার বেশ কঠিন কাজ। তাই রাজনৈতিক মারমুখী নীতি কোনোভাবেই যেন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।

গোয়েন্দা সংস্থা পুষে ভেতরের আগুন নেভানো যাবে না যদি শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা না পায়। এ ছাড়া আমরা দেখছি অত্যন্ত অপরিসর, অস্বাস্থ্যকর ছোটো চিলেকোঠায়ও গড়ে উঠছে অনেক গার্মেন্টস কারখানা। এর অবসান হওয়া দরকার। কারণ এমন ছোটো পরিসর স্থানে আগুন লেগে বেশ কিছু গার্মেন্টসে কর্মী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তা ছাপাও হয়েছে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায়, যা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বিদেশে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান প্রয়োজন। প্রতিটি গার্মেন্টস স্থাপনায় কর্মীদের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। ফায়ার এলার্ম, ফায়ার এক্সিট, নিয়মিত চেক করা হোক। সরু কিংবা গলির মাঝে যারা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হোক অথবা অন্য বড়ো স্থানে স্থানান্তরের তাগিদ দেয়া হোক।

কেউ ব্যাংকের লোন, বায়ারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ আত্মসাতের মতলবে ব্যবসা ফাঁদছে কি না তা নিয়মিত মনিটর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং রপ্তানি ব্যুরোর সমন্বয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তার ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণখেলাপিদের ব্যবসা সরকারি হেফাজতে নিয়ে নিলাম অথবা জব্দ করতে হবে- এরা যতই শক্তিশালী হোক।

দেশি-বিদেশি যেকোনো চক্রই এই সেক্টরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করুক না কেন, তা দমন করতে হবে কঠোর হাতে। শুধু শিল্প পুলিশই নয়, প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি নিয়োগ করতে হবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, শ্রমিকরা যদি তাদের ন্যায্য পাওনা পায় তবে অনেকাংশেই কমে যাবে সকল প্রকার অনিশ্চয়তা। কেউ বিলিয়ন ডলার কামাবে, আর কেউ তার ন্যায্য কানাকড়িও পাবে না- তা হতে পারে না। যে শোক বহন করেছে জাতি, তার অবসান দরকার। রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনের মর্মান্তিক ঘটনা কিন্তু বাংলাদেশ ভুলে যায়নি। জাতির অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই। নাশকতা যারা করতে চাইবে এরা জাতির শত্রু। আর যদি কোনো রাজনৈতিক দল এদের পৃষ্ঠপোষক হয় তবে এরা জাতীয় শত্রু। অন্যদিকে যারা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে দুর্নীতিবাজদের সহচর হবে, নজর রাখতে হবে তাদের প্রতিও।

ফকির ইলিয়াস: কবি, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা