ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় কৃত্রিম চিনি, বাঁচার উপায়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২৪

বেঁচে থাকার নির্ভেজাল আশ্বাসবাক্য লুকিয়ে রয়েছে ‘চিনি কম। চিনির পরিমাণে লাগাম রাখতে পারলেই রোগে ভোগান্তির আশঙ্কা কম। কিন্তু মিষ্টি ছাড়া চা যাদের মুখে একেবারেই রোচে না, তাদের জন্য বিকল্প উপায় হল আর্টিফিশিয়াল সুইটনার বা কৃত্রিম চিনি। আবার অনেকে চোখবন্ধ করে ভরসা করেন কৃত্রিম চিনিকেই। কৃত্রিম চিনির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। অথচ এই ধরনের কৃত্রিম চিনির অতিরিক্ত ব্যবহার যে শরীরের জন্য বিপজ্জনক, তেমনটাই বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।

বর্তমানে সফট ড্রিংকস, বেইক করা খাবার, ফ্রিজে রাখা ডেজার্ট, লজেন্স, দই, চুইং গাম সবকিছুতেই দেখা মেলে কৃত্রিম চিনির। চা, কফি ইত্যাদি পানীয়তে মেশানোর জন্য প্যাকেটজাত তো আছেই, রান্নায় কিংবা বেইক করতে ব্যবহারযোগ্য কৃত্রিম চিনিও মেলে বাজারে। তবে কৃত্রিম কিংবা প্রাকৃতিক যে কোনো চিনিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্যতালিকা থেকে চিনি বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন প্রায় সব চিকিৎসক।

শুধু ক্যালোরি বেড়ে যাওয়াই নয়, ভুঁড়ি হওয়া, ত্বকের জেল্লা হারিয়ে ফেলা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া কিংবা চুল পড়ার মতো নানা রকম সমস্যাও দেখা দেয় সাধারণ চিনি বা কৃত্রিম চিনি থেকেই। তাই সাম্প্রতিক সময় বিজ্ঞানের ভাষায় চিনিকে ‘স্লো পয়জন’ও বলা হয়।

ডায়াবেটিস রোগীসহ অনেক স্বাস্থ্য সচেতনরাই বর্তমানে চিনির বিকল্প হিসেবে আর্টিফিসিয়াল সুইটনার বা কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করেন। বিশেষ করে চায়ের সঙ্গেই বেশি মেশানো হয় এই কৃত্রিম চিনি। তবে এটি কতটা স্বাস্থ্যকর, তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।

অনেকেই ভেবে বসেন, চিনি বারণ কিন্তু কৃত্রিম চিনি খাওয়া যাবে। কিন্তু জানেন কি, এই কৃত্রিম চিনি শরীরের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। এতে থাকা অ্যাসপার্টেম শরীরে চিনির চেয়েও বেশি ক্ষতি করে। মেদ বৃদ্ধি থেকে শুরু করে শরীরের অন্যান্য সমস্যাকেও উস্কে দেয়।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, সাধারণ চিনির চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি মিষ্টি অ্যাসপার্টেম কৃত্রিম চিনির অন্যতম উপাদান। কৃত্রিম চিনিতে ওজন কমে না, উল্টে এতে ব্যবহৃত উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রাও খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

রান্নাবান্না থেকে চা-কফি, ডায়াবিটিকদের সবেতেই ভরসা কৃত্রিম চিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কৃত্রিম চিনি খেলে ওজন তো কমেই না, উল্টে এতে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান শরীরের ক্ষতি করে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও এই চিনির খুব একটা ভূমিকা যে নেই, তারও প্রমাণ মিলেছে। এ বিষয়ে গত বছর একটি নির্দেশিকাও প্রকাশ করেছিল ‘হু। সংস্থার ‘নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সেফটি বিভাগের ডিরেক্টর ফ্র্যান্সেস্কো ব্রাঙ্কার মত, কৃত্রিম চিনি শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে ইচ্ছা করলে কৃত্রিম চিনি দেওয়া খাবারের বদলে তাই ফল খাওয়া ভাল। তাঁর কথায়, ‘‘কৃত্রিম চিনিতে কোনও পুষ্টিকর উপাদান থাকে না। সুস্থ ভাবে বাঁচতে গেলে মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছাকে দমন করাই শ্রেয়।’’

কৃত্রিম চিনির মূল উপাদানগুলো হল অ্যাসপার্টেম, সুক্রোজ়, সুক্রালোজ়, স্যাকারিন, নিওটেম এবং স্টিভিয়া। যে কোনও প্রক্রিয়াজাত খাবার, জাঙ্ক ফুড, ডায়েট পানীয়ের মধ্যে এই রাসায়নিকগুলি থাকে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সাধারণ চিনির তুলনায় কৃত্রিম চিনির মিষ্টত্ব অন্তত পক্ষে তিনশো গুণ বেশি। ব্যবসায়িক কারণে মধ্যবিত্তের সাধ্যের নাগালে আনতে তাই অনেক সময়েই এতে সিলিকা-সহ নানা ধরনের ক্ষতিকর পণ্য মেশানো হয়। পুষ্টিবিদেরা বলছেন, শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যাসপার্টম প্রবেশ করলে ক্যানসারের মতো মারণরোগের আশঙ্কা বাড়ে। মাইগ্রেন, উদ্বেগ এবং স্নায়ুজনিত সমস্যাও বাড়তে পারে। তবে কৃত্রিম শর্করা খেলে মেদের পরিমাণ কমে। কিন্তু তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি নয়। তা ছাড়া, কৃত্রিম চিনিতে থাকা স্যাকারিন শরীরে ইনসুলিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে তোলে। এই হরমোনের কলকাঠিতেই ওজনে যত বিপত্তি ঘটে।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন রিপোর্টেও দেখা গিয়েছে, কৃত্রিম সুইটনার টাইপ-টু ডায়াবিটিস, কার্ডিয়োভাসকুলার রোগ, হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা, কিডনির সমস্যা এবং মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। কৃত্রিম চিনিতে যে সুক্রালোজ় থাকে, তা চিনির তুলনায় অনেক গুণ বেশি মিষ্টি হয়।

‘নেচার মেডিসিন’-এ প্রকাশিত গবেষণা বলছে, কৃত্রিম চিনিতে থাকা ‘এরিথ্রিটল’ নামক একটি যৌগ রক্ত জমাট বাঁধা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, বিগত ৩ বছরে হৃদ্‌রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে এই ‘এরিথ্রিটল’-এর যোগ রয়েছে। যদিও এই যৌগটিকে নিশ্চিত ভাবে দায়ী করার আগে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা।

২০১১ সালে ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন’ (এনসিবিআই)-এর সমীক্ষা বলছে, স্বাদে চিনির মতো হলেও চিনির মতো ক্যালোরি নেই এই যৌগটিতে। ‘সর্বিটল’ বা ‘জ়াইলিটল’এর মতো ‘এরিথ্রিটল’ও এক প্রকার অ্যালকোহল, যা প্রাকৃতিকভাবে থাকে ফল এবং সব্জির মধ্যে। কিন্তু পুষ্টিবিদদের মতে, অতিরিক্ত ক্যালোরি ছাড়াই চিনির মতো মিষ্টত্ব দিতে পারে এই যৌগটি। কিন্তু সমস্যা হল, এই ‘এরিথ্রিটল’ কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে গেলেই এর ফল হয় উল্টো।

প্রাকৃতিকভাবে ফল বা সব্জিতে থাকা ‘এরিথ্রিটল’ ভাল হলেও, কৃত্রিমভাবে তৈরি এই যৌগটি শরীরের বিপাকহারের গতি কমিয়ে দিতে পারে। রক্তের বদলে প্রস্রাবের মধ্যে মিশতে থাকে যৌগটি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সুগার ফ্রি, স্টিভিয়া’সহ বাজারে যে সব কৃত্রিম চিনি পাওয়া যায়, তাতে অ্যাসপারটেম ও সুক্রালোজ নামক যৌগ থাকে। এর কারণেই মিষ্টি ভাব আসে। যা শরীরের জন্য একেবারেই ভালো নয়।

সুক্রালোজের তুলনায় অ্যাসপারটেম আরও বেশি ক্ষতিকর। এই দুই যৌগ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হৃদ্যন্ত্র, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। শরীরে নেগেটিভ ইলেকট্রন তৈরি হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

‘দ্য বিএমজে’ দ্বারা প্রকাশিত ফরাসি প্রাপ্তবয়স্কদের একটি বড় গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চতর কৃত্রিম সুইটনার সেবন হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকসহ কার্ডিওভাসকুলার বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

কৃত্রিম সুইটেইনার বানানোই হয়েছে কম ক্যালোরিযুক্ত মিষ্টি খাওয়ার সুযোগ করে দিতে। কিন্তু বহু গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, এই খাদ্যপণ্যটি উল্টো ওজন বাড়ায়। যারা এসব মিষ্টি খায় তাদের ওজন বাড়ার ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ বেড়ে যায়।

স্যাকারিন, সুকরালোজ এবং অ্যাসপারটেমে অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। এতে হজমের প্রক্রিয়া প্রভাবিত হওয়ায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আর এ সমস্যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

কৃত্রিম চিনির বিকল্প হিসেবে যেসব খাবার খাবেন

মধু

প্রাকৃতিক এনার্জি বুস্টার হিসেবে মধু আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। চিকিৎসকদের মতে, চিনির বদলে খাঁটি মধু মেশান রান্নায়। স্বাদেও মন ভোলাবে, চিনির চেয়ে উপকারও বেশি। চিনির বিকল্প হিসেবে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর ন্যাচারাল সুইটেনার মধু। ১ টেবল চামচ মধুতে ক্যালোরির পরিমাণ থাকে ৬৪।

নারিকেল

নারকেলের চিনি স্বাস্থ্যকর ও একেবারেই ডায়াবেটিক নয়। এই কারণে এর চাহিদা তুঙ্গে। নারকেল থেকে বানানো এই চিনিও ব্যবহার করতে পারেন রান্নায়। কোকোনাট সুগারে ক্যালোরি অনেক কম থাকে। ১ টেবল চামচ কোকোনাট সুগারে ক্যালোরির পরিমাণ ৪৫।

খাঁটি গুড়

গুড় চিনির চেয়ে বেশি মিষ্টি। তবু এর ক্যালোরি অনেক কম। হলেও গুড়ে ক্যালোরির পরিমাণ অনেক কম। ১ টেবল চামচ গুড়ে থাকে মাত্র ৪৭ ক্যালোরি। গুড়ের বদলে গুড়ের বাতাসাও ব্যবহার করতে পারেন রান্নায়।

তাজা ফল

বেদানা, আপেল, আঙুর, কলার মতো ফলগুলো এমনিতেই মিষ্টি৷ খুব মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে করলে ফল খেতে পারেন৷ ফলের রস নয়, গোটা ফল চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করুন৷ এর ফলে প্রয়োজনীয় ফাইবারটাও আপনার শরীরে ঢুকবে৷

বাদাম

আমন্ড, কাজু, আখরোটের মতো বাদামের পাশাপাশি কুমড়ো, তিসি ইত্যাদির বীজ রাখুন প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়৷ এগুলোর প্রভাবে আপনার পেট বেশিক্ষণ ভরে থাকবে৷ বাড়তি চিনির প্রয়োজন হবে না

স্টেভিয়া

স্টেভিয়া এক ধরনের ভেষজ পাতা। গবেষণায় দেখা গেছে, এর অনেকগুলো পাতা একসঙ্গে নিলে এটি খেতে চিনির চাইতেও মিষ্টি লাগে। এটি দাঁতের ক্ষয়রোগ রোধ করে। স্কিন কেয়ার হিসেবে কাজ করে, তাই ত্বকের কোমলতা এবং লাবণ্য বৃদ্ধি করে। স্বাদ বৃদ্ধিকারক হিসেবেও স্টেভিয়ার অনেক চাহিদা রয়েছে। চা, কফি, মিষ্টি, দই, বেকারি ফুড, আইসক্রিম, কোমল পানীয়সহ এ জাতীয় নানা খাদ্যপণ্য তৈরিতে স্টেভিয়া ব্যবহার করা যায়। এর ভেষজ উপাদান মানুষের দেহে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।

ডিটক্স ওয়াটার

অনেকে মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসেন এবং সারা দিনের যখন-তখন মিষ্টি কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয়, তাদের জন্য আদর্শ ডিটক্স ওয়াটার বা ফ্লেভারড ওয়াটার৷ এক বোতল পানিতে মিশিয়ে নিন আপনার পছন্দের ফল৷ স্ট্রবেরি, আঙুর, আপেল, তরমুজ, পুদিনা, লেবু যা খুশি মেশাতে পারেন৷ এক রাত ফ্রিজে রাখুন৷ পরদিন পানিটা ছেঁকে পান করুন৷ সারাদিনে অল্প অল্প করে চুমুক দিয়ে খেলে আপনার মিষ্টি খাওয়ার তীব্র ইচ্ছে নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে ৷

(ঢাকাটাইমস/১০ ফেব্রুয়ারি/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :