আবু সাঈদ তুলুর ‘নাট্য সমালোচনার কথকতা’: বাংলা নাট্যের তৃণমূল অন্বেষণ

লিটন মাহমুদ
 | প্রকাশিত : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:১৯

সমকালীন বাংলা থিয়েটারে নিয়মিত নাট্যমঞ্চায়নের ক্ষেত্রে লেখক ও গবেষক আবু সাঈদ তুলু রচিত 'নাট্য সমালোচনার কথকতা' গ্রন্থটি একটি অনন্য ভূমিকা সৃষ্টি করেছে। অনন্য ভূমিকা এইজন্য যে- বাংলাদেশে সাহিত্য বিষয়ক প্রচুরসংখ্যক গ্রন্থ থাকলেও সরাসরি বাংলা নাট্যসমালোচনা বিষয়ক একটি সমৃদ্ধ প্রবন্ধ সংকলন একান্ত ও দুর্লভই বলা যায় বটে। এখানে গবেষক ও লেখক আবু সাঈদ তুলু সুপ্রাচীনকাল থেকে বর্তমান অবধি বাংলা নাট্যবিষয়ের তাত্ত্বিক দিকগুলো নিয়ে এক চুলচেরা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন।

'নাট্য সমালোচনার কথকতা' গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে একান্তভাবেই দেশীয় শিল্পের শিকড়মূল থেকে কীভাবে একটি বৃক্ষের বংশবিস্তার হয়ে থাকে সেই রূপটিও। যেকোনো দৃশ্যমান প্রয়োগিক বিষয়েরই মৌলিক ভিত্তি হলো তার তাত্ত্বিক বিষয়। তাত্ত্বিক বিষয়ের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়েই একটি দৃশ্যমান বিষয় সকলের দৃষ্টি ও হৃদয় কাড়তে সমর্থ হয়। কিন্তু এই পথ খুব মসৃণ নয় মোটেও; তা বিভিন্ন আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রয়োজন-আনুপাতিক আয়োজনের পরিমিত ব্যবহারেই হয়ে ওঠে যুক্তিপূর্ণ বিষয়। সমবেত পাঠক-দর্শকের একটি নাট্য সমালোচনা শুধু ভালোলাগারই বিষয় হয়ে উঠতে পারে না; তার সঙ্গে শিক্ষা ও প্রজ্ঞার বিষয়টিও প্রযুক্ত হয়। তাই সংগত কারণেই কোনো নাট্যবিষয়ই সমালোচকের নির্মোহ সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। বস্তুতপক্ষে একজন নির্মোহ সমালোচকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিপূর্ণ সমালোচনার মধ্য দিয়েই ঐ শিল্পবস্তুকে প্রকৃতরূপে অনুধাবন করা বা জানা যায়। গবেষক আবু সাঈদ তুলুর 'নাট্য সমালোচনার কথকতা' গ্রন্থটিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে এই বিষয়টিই সর্বাগ্রে সামনে চলে আসে।

এই গ্রন্থে লেখকের মোট ১০টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে; যার মধ্যে প্রায় সবগুলি প্রবন্ধই বাংলা নাট্যের তত্ত্বীয় বিশ্লেষণমূলক- আর কয়েকটি প্রবন্ধ হলো একটু আলাদা ধরনের। আলাদা বলেই তা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির একেবারে বাইরে নয় মোটেও। 'নাট্য সমালোচনার কথকতা' গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো হলো: নাট্য সমালোচনার কথকতা, বাংলা নাট্য: তত্ত্ব ও রীতি, 'পালা': বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব নাট্য, থিয়েটারে দর্শকের অবস্থান, প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যরীতি, বাংলাদেশের নাট্যচর্চা: প্রথম দশক (১৯৭১-১৯৮০), শিল্প-সাহিত্যে নন্দনভাবনা ও নৈতিকতা, কবিতার পাঠক, পাঠকের কবিতা, বর্ণমালা কীভাবে তৈরি হলো। বাংলাদেশে শিল্প সাহিত্যের প্রধান ম্যাগাজিন ‘কালি ও কলম’সহ অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলোর মূল্য যে অপরিসীম তা প্রবন্ধগুলোর শিরোনামই জানান দেয়।

গবেষক আবু সাইদ তুলু একজন আপাদমস্তক পূর্ণাঙ্গ লেখক- বিশেষভাবে সমালোচনা সাহিত্যের একজন ক্ষুরধার লেখক হিসেবে বাংলাদেশের লেখক মহলে নিজের অবস্থান ইতোমধ্যেই শক্ত করে নিয়েছেন। সমালোচনা সাহিত্যের মধ্যে আবার নাট্য সমালোচনাকেই তিনি প্রধান করেছেন তার অধীত সাধনার পথে। তিনি ইতোমধ্যেই এমফিল ডিগ্রি কমপ্লিট করেছেন যার বিষয়বস্তুও বাংলা নাট্য বিষয়ক।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক জনাব আবু সাঈদ তুলু’র এতদ্বিষয়ক রচনাগুলো সম্পূর্ণতই বিষয়ভিত্তিক সমুন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে ওঠেছে এইজন্য যে- তিনি এ পথের একজন নিরলস সাধক। ‘নাট্য সমালোচনার কথকতা’ গ্রন্থের প্রথম ফ্লাপে লেখক সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ হয়েছে তা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।

"অনেকেই সাহিত্য-নাট্যচর্চা করেন কিন্তু জানেন না তার তাত্ত্বিক ভিত্তি। 'নাট্য সমালোচনার কথকতা' গ্রন্থটি নাট্যকলা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ১০টি প্রবন্ধের সংকলন। এর অধিকাংশ প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি নানা নাট্যপত্র, ওয়েব পোর্টাল ও সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত। এ গ্রন্থ শুধু সমালোচনার চিন্তা বিকাশেই ভূমিকা রাখবে না। সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, নাট্যকলার মৌলিক উপাদান-উপকরণ-নন্দনভাবনা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে উন্নত ধারণা তৈরি করবে। এ গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে কবিতা শুধু একাধারে ভাবের বিষয় বা আন্দোলনের বিষয়ও নয়। অনুভব-অনুভূতি কীভাবে কবিতা হয়ে ওঠে তার রূপরেখা। নাটকে হেরাসিম লেবেদেফ, কবিতায় র‌্যাঁবো-বোদলেয়ার, উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কট প্রভাবিত ইউরোপীয় আধুনিকতার ধোঁয়ায় এতই আচ্ছন্ন যে বাঙালি ভুলেই গেছে তার নিজস্ব সাহিত্য-শিল্পরীতি! পূর্বাপর না ভেবেই শিল্প-সাহিত্যে মন্তব্য করাও এখন একটি সহজাত প্রবণতা। অথচ শিল্প-সাহিত্য সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করে বলে তার প্রভাবটা ইতিবাচক হওয়া জরুরি। সে জন্য সমালোচকের থাকতে হয় নাট্যতত্ত্বের পরিপক্ববোধ, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, অপক্ষপাত মূল্যায়ন ক্ষমতা ও সুসংহত ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা। এ গ্রন্থটি ক্রিটিক্যাল বোধ বিকাশে সাহায্য করে আবহমান কাল ধরে চর্চিত সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপ-রীতি-পদ্ধতি-মূল্যবোধ-সমালোচনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেবে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য-শিল্পের তাত্ত্বিক রূপ, নন্দনভাবনা ও মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই এ গ্রন্থের অভীষ্ট। গ্রন্থটি গবেষক, নাট্যকর্মী-সাহিত্যিক-শিল্পী, ইতিহাসকার, কলাবিদ্যার ছাত্র-শিক্ষক-সমঝদারদের উপকারে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।"

গ্রন্থভুক্ত 'নাট্য সমালোচনার কথকথা' প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন- কীভাবে নাট্য সমালোচনা একটি নাট্য বিষয়ের নেপথ্য প্রাণস্পন্দন হয়ে উঠে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পধারা আলাদা এবং এর সমালোচনার ধরনও অনেকটা আলাদা বটে। এই প্রবন্ধে লেখক তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তা দেখিয়েছেন। হাজার বছর ধরে বিভিন্ন প্রচেষ্টায় সমালোচনা সাহিত্য কীভাবে গড়ে উঠেছে এবং বিস্তৃতি লাভ করেছে তাও তিনি দেখিয়েছেন এখানে। সমালোচনার চিন্তা কাঠামো ও সমালোচনার ভাষা ব্যবহারে কতটা যত্নবান ও সচেতন থাকতে হয় একজন সমালোচককে- এই প্রবন্ধের ভিতরে তা চমৎকারভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।

'বাংলা নাটক: তথ্য ও রীতি' প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন বাঙালির হাজার বছরের নাট্য কীভাবে গড়ে উঠেছে এবং বাংলা নাটক যে কোনোভাবেই পাশ্চাত্য প্রভাবের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়নি তাই স্পষ্ট করেছেন তিনি। বাংলা নাটক একান্তভাবেই বাঙালির নিজস্ব শিল্প ও মননরুচি থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং তা বিস্তৃত হতে হতে এখন গগনবিস্তারি আকার ধারণ করেছে- এই বিষয়টিও তৃণমূল সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখেছেন তিনি। প্রবন্ধটির পড়তে পড়তে তিনি দেখিয়েছেন প্রাচীন বাংলার নাট্য পরিবেশনাগুলো কেমনভাবে পরিবেশিত হতো এবং কেমনভাবে তা সমবেত দর্শকের মন জয় করে নিতো। তিনি এখানে দেখিয়েছেন- মধ্যযুগে কতগুলো রীতিতে বাংলা নাটক পরিবেশন হতো এবং সে সময়ে কোন-কোন লোকনাটক সমবেত দর্শককুলের মন জয় করে নিতে সমর্থ হতো।

আসরভিত্তিক নাট্যপরিবেশনের মাধ্যমে কীভাবে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর শিল্প ও জনরুচি গড়ে ওঠে তা প্রমাণসহ তিনি উল্লেখ করেছেন এই প্রবন্ধে। একটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এমনি-এমনি গড়ে ওঠে না- তার পেছনে থাকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক লোকমানসের এক দীর্ঘ ও পরিশ্রমলব্ধ প্রচেষ্টা।

'পালা: বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব নাট্য' এই প্রবন্ধে তিনি আদি ও মধ্যযুগের নাটকগুলোতে অভিনয় সহযোগে যেসব কীভাবে পালা পরিবেশিত হতো তার বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন। বাংলা পালা, পাঁচালী, কেচ্ছা, কথকতা, গান- নানা বৈশিষ্ট্যমূলক পরিবেশনায় ঋদ্ধ যে সমস্ত পরিবেশনা তখন দর্শকবেষ্টিত মঞ্চে অভিনীত হতো সেই মঞ্চ বিষয়ের শিল্পতাত্ত্বিক বিষয়গুলোও তিনি এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। উল্লিখিত পালাগুলো স্থানভেদে যে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হতো এবং তা ড. দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত 'মইমনসিংহ গীতা' গ্রন্থের আলোকে তিনি দেখিয়েছেন এখানে।

'থিয়েটারে দর্শকের অবস্থান' প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন দর্শকেরও একটি নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে সমকালীন শিল্পরুচির জায়গায় পৌঁছাতে নিজেকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে। শিল্পের নানা শাখার মধ্যে থিয়েটার এমন একটি মাধ্যম যেখানে অভিনেতা-অভিনেত্রী সরাসরি দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে থাকে তাই দর্শকের অনুভবকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখা সম্ভব নয়। দর্শকের জন্যই পরিবেশিত হয় নাটক সুতরাং দর্শকের অবস্থান নির্ণয় করা ও নির্মিত করা থিয়েটার তাত্ত্বিক বিষয়ের একটি অপরিহার্য অঙ্গ বলেই বিবেচনা করেছেন লেখক এই প্রবন্ধে।

'বাংলাদেশের নাট্যচর্চা: প্রথম দশক (১৯৭১-১৯৮০)'- এই প্রবন্ধে লেখক চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে প্রথম দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের নাট্যচর্চার যে সমুন্নতি তৈরি হয় সেই বিষয়টি। বলা হয়ে থাকে- স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ যতগুলো শিল্পের মাধ্যম উন্নত হয়েছে তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে ‘থিয়েটারচর্চা’। সুতরাং স্বাধীনতার পরে প্রথম দশকের নাট্যচর্চার গুরুত্ব কোনোভাবেই অবহেলা করার মতো নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর এই প্রথম দশক নাট্যচর্চার উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে এখনকার পাঁচ দশকের শিল্পচর্চা এবং এই শিল্পচর্চা নিজস্ব ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়েই নিজের সমৃদ্ধ অস্তিত্ব ঘোষণা করছে এবং বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রয়াস পাচ্ছে।

মূলত গবেষক ও লেখক আবু সাঈদ তুলু তার ‘নাট্য সমালোচনার কথকতা’ গ্রন্থে থিয়েটার ও বাংলা সংস্কৃতির এমন নেপথ্য ও তৃণমূল পর্যায়ের তথ্যবিশ্লেষণ তুলে নিয়েছেন যে- যেকোনো শিল্পসাহিত্যের পথিক এবং নির্নিমেষ পাঠকবৃন্দের এই গ্রন্থপাঠ অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাট্যবিষয়ী শিক্ষার্থীদের জন্য এই গ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে অত্যাবশ্যকীয় পাঠসঙ্গী।

অমর একুশে বইমেলা-২০২৪-এ প্রকাশিত 'নাট্য সমালোচনার কথকতা' গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল প্রকাশনা সংস্থা 'অয়ন প্রকাশন'। ঝকঝকে প্রচ্ছদ ও প্রায় দুইশ পৃষ্ঠা আয়তনে উন্নত মোটা কাগজে তৈরি এই বইটির বাইন্ডিংও খুবই মজবুত। কমিশন ব্যতিরেকে ৪৫০/- টাকা মূল্যের এই গ্রন্থটি যেকোনো শিক্ষার্থী, শিল্পানুরাগী ও সাহিত্যানুরাগীর জন্য একান্তভাবে সংরক্ষণে রাখার উপযোগী একটি সংগ্রহ হতে পারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :