বিএনপির দশা: সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি!

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
 | প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫:০৩

একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে- ‘উপজেলা নির্বাচন: ভোটে যেতে কৌশল খুঁজছে বিএনপি’। পত্রিকাটি জানিয়েছে যে- মে মাস থেকে শুরু হতে যাওয়া উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করা নিয়ে নতুন কৌশল খুঁজছে। কৌশলের ধরনটি হতে পারে- যে কেউ চাইলে উক্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সেক্ষেত্রে দল কিছুই বলবে না; কারো বিরুদ্ধে শাস্তিরও কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তবে পত্রিকাটির ভাষ্য অনুযায়ী- বিএনপি এখনো পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু প্রতিবেদনটি পড়ে মনে হচ্ছে- বিএনপি এই মুহূর্তে এমন সিধান্তের কথা কাউকে জানাতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এটিও দলের কৌশলের অংশ হতে পারে। কেউ কেউ বলছেন যে- উপজেলা নির্বাচন নিয়েও আওয়ামী লীগ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়াবে তাতে বিএনপির লাভ হবে। আবার বিএনপির কেউ কেউ বলছেন- আন্দোলন করবো না, নির্বাচনেও যাবো না এটি তো হতে পারে না। অন্যদিকে দলের শীর্ষ নেতারা উপজেলা নির্বাচনে দলের যারাই অংশ নেবে তাদের অবস্থা নীরবে পর্যবেক্ষণ করবে। এর মানে হচ্ছে, মৌনতা সম্মতিরই লক্ষণ। এখন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অন্য নেতৃবৃন্দ যাই বলুক না কেন সেটি মানুষকে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রাখার কৌশল হতে পারে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এত বড়ো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, এখনি আবার অন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া বিএনপির জন্য বড়োই অস্বস্তিকর হবে; নানা জনে নানা প্রশ্ন তুলবে। আমাদের সমাজে প্রচলিত প্রবাদ, ‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’! এমন সমালোচনা শুনতে বিএনপির যে ভালো লাগবে না তা বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু দলকে আর কতদিন নির্বাচনের বাইরে রাখা যাবে? বিএনপি তো কোনো ছোটোখাটো দল নয়। ছোটোখাটো দলগুলোর একদিকে সুবিধা আছে অন্যদিকে বিপদও আছে। সুবিধা হলো- নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, বর্জন করা, রাস্তায় চেঁচামেচি করা, নির্বাচন সম্পর্কে মানুষকে নানা তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলে তাদের বিভ্রান্ত করতে কোনো জুড়ি নেই। জনগণের কাছে তারা নিজেদের যে ভাবমূর্তি দাঁড় করাতে চায় তা হলো- তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে, ক্ষমতার জন্য নয়। জনগণ সেটি শুনে তাদেরকে বাহবা দিচ্ছে, দিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে- এমনটি তারা মনে করে থাকে। অসুবিধাটি হলো, নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, ভোটের বাজারে তাদের যে কোনোই মূল্য নেই সেটি প্রমাণিত হয়েছে। এমন জনদরদি দলের শোচনীয় অবস্থা নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা দেখাতে চায় না। তবে বড়ো কোনো দলের ওপর সওয়ার হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে তাদের আপত্তি নেই, বরং সেই পথই এখন সবাই খুঁজছে।

বিএনপি গত নির্বাচন বর্জন করার পেছনে ছোটো ছোটো বিপ্লবী দলগুলোর পরামর্শ কতটা নিয়েছে সেটি হয়তো বিএনপিই ভালো বলতে পারবে। তবে রাজনীতি সচেতন মহল মনে করে যে- বিএনপি ২০১৪ সালে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করার পেছনে জামায়াতের শলাপরামর্শ ছিল। বিএনপিকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে আগুন সন্ত্রাস দিয়ে প্রতিহত করা গেলে আওয়ামী লীগ সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতাচ্যুত হতে বাধ্য হবে; ৫ই জানুয়ারির পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো সময় থাকবে না ফলে আরেকটি এক-এগারোর মতো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটতে পারে অথবা জনগণ ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চের মতো সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দেবে। বিএনপি তখন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছিল জামায়াত-শিবির এর ক্যাডার বাহিনীর ওপর। তারা ২০১৩-১৪ সালে যে সন্ত্রাস ও অগ্নি সংযোগ করেছিল তার বীভৎসতা এখনো ভুলে যাওয়ার নয়। বিএনপি তখন হেফাজত এবং জামায়াতসহ সকল ডানপন্থি দলের মিত্র ছিল। মিত্রদের উপর ভরসা করে ১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৫ সালেও তারা দ্বিতীয়বার সরকার উৎখাতের জন্য ৯৩ দিন হরতাল অবরোধ এবং অগ্নি-সন্ত্রাস করেছিল। কিন্তু সেটিও সরকার পতনে কোনো ‘অবদান’ রাখতে পারেনি। ২০১৮ সালে বিএনপি কৌশলের পরিবর্তন ঘটায়। জামায়াত-হেফাজতসহ ডানপন্থা ছেড়ে মধ্যপন্থায় দাড়াতে ড. কামাল হোসেনকে ইমাম মেনেছিল। কিন্তু কামাল হোসেন তাদেরকে নির্বাচনে বিজয়ী করে আনতে পারেননি। সেখানে অবশ্য বিএনপির লন্ডনস্থ কেন্দ্রীয় অফিস, গুলশান অফিস এবং নয়া পল্টন অফিসের মধ্যে প্রার্থী মনোনয়নদানে সমন্বয়হীনতা ছিল। ফলে বিএনপির কৌশল শেষ পর্যন্ত মার খেয়ে গেল। ২০২৪-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি আবার ঘরানার পরিবর্তন ঘটায়। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্টের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে দলটি এবং দেশে নামসর্বস্ব ডান, বাম, দলছুট, তিরিশ চল্লিশটি দলের ওপর নির্ভর করেছিল। এবারো সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোনোভাবেই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার, ২০১৩-১৪-এর মতো শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলার। ২৮শে অক্টোবর থেকে যুগপৎ দলগুলো সেই ভরসাই বিএনপিকে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, সরকারও গঠিত হলো, আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বের সরকারগুলো শেখ হাসিনার নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলো। তারপরেও যুগপৎ আন্দোলনকারী কয়েকটি বিপ্লবী দল বিএনপিকে নৈতিকভাবে তাদের জয়ের দীক্ষার কথা শোনাচ্ছে, প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু এভাবে কি বিএনপির মতো একটা বড়ো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বস্ত করে ধরে রাখা যায়?

বিএনপির কয়েকজন নেতা এখন মাঠে কথাবার্তা বলছেন; বিএনপি বিপ্লবীদের মতোই সরকার পতনের হুঙ্কার ছুঁটছেন, কর্মীদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন! কিন্তু সবাই জানে যে, ৫ বছর অপেক্ষা করার পরই কেবল পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে আবার বিএনপি নতুন কোন কৌশলের কাছে আত্মসমর্পণ করবে অথবা ধরাশায়ী হবে- নাকি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে- সেটি কেবল তখনই দেখা যাবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করার উপায়টা কী হবে, হাত গুঁটিয়ে বসে থাকতে হবে, না কি তৃণমূল থেকে নেতাকর্মীদের দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, পরনির্ভরশীলতা ত্যাগ করে নিজের পায়ে নিজেকে দাঁড়ানোর পথে হাঁটবে- সেইসব প্রশ্নের এখনি যদি উত্তর খোঁজা না হয় তাহলে বিএনপিকে ভবিষ্যতে আরো চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। দেশে অনেক দলই আছে কিন্তু প্রায় সবকটিই নামসর্বস্ব। যারা বিএনপির রাজনীতিতে জীবন-যৌবন কাটিয়েছেন তাদের ঐসব দলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বিএনপিও তো তাদের সান্ত্বনা দিতে পারছে না। এই অবস্থায় উগ্র হটকারী কোনো কৌশল না নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার সুযোগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু বিএনপির জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০০৬ সালের পর থেকে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দলকে যেভাবে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার অবস্থা তৈরি করে রেখেছে তা নির্মোহভাবে পর্যালোচনার কোনো উদ্যোগ দলটির মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। দলের সব সিদ্ধান্তই আসে লন্ডন থেকে। সেটি শুদ্ধ কিংবা ভুল তা নিয়ে প্রশ্ন করার কেউ নেই। কারো তেমন সাহসও নেই। দলের নীতিনির্ধারণী কমিটির কোনো সভা কালেভদ্রেও অনুষ্ঠিত হতে শোনা যায় না। এত বড়ো আন্দোলন মাঠে নামিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ একবারও সভা করেছেন বলে শোনা যায়নি। সাধারণত লন্ডন ওহি- যা তলব বা নির্দেশ করে তাই-ই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। এখানে যারা মাঠে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা মাঠের বক্তৃতায় অনেক আওয়াজ কিংবা ফাঁকা আওয়াজ দিতে পারেন, সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর আওয়াজও দিতে পারেন, আবার যখন-তখন সরকারকে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে না পাওয়ার হুঙ্কারও দিতে পারেন। কিন্তু আন্দোলনের কর্মসূচি কী হবে আর কী হবে না তা আগে থেকে বলতে পারেন না। এমন অবস্থায় আন্দোলন তো দূরে থাক দলই রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা নয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে বিএনপির মতো এত বড়ো দল চলছে কীভাবে? এর উত্তর তো বেশি কঠিন নয়। ২০০৬ সালের পর থেকে যেভাবে-যেভাবে দলটি চলে এসেছে তা তো সবারই দেখা বিষয়। কোনো সিরিয়াস গণতান্ত্রিক আদর্শবাদী দল হলে অনেক আগেই হয় দলের নেতৃত্বকে রাজনৈতিকভাবে চলার সংস্কৃতিতে আসতে হতো, নতুবা দলের মধ্যে বিভাজন অনিবার্য হতোই। কিন্তু বিএনপিতে সেটি ঘটবে না। কারণ বিএনপি আওয়ামী বিরোধিতা, ভারত বিরোধিতা এবং সাম্প্রদায়িকতা নির্ভরশীল একটি প্লাটফর্ম। এর বিকল্প দ্বিতীয়টি নেই। জাতীয় পার্টি হতে পারেনি। সুতরাং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব যেভাবে চাইবে উপযুক্ত আদর্শের শক্তিসমূহ বিএনপিকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবস্থানে নেই। সুতারাং বিএনপির অস্তিত্ব যারা বিপন্ন হওয়ার কথা ভাবছেন তারা বিএনপির আদর্শের শেকড়টির কথা বিবেচনায় রাখেন না। যতদিন পর্যন্ত আওয়ামী বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত বিরোধিতা দেশের সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রশাসনে টিকে থাকবে ততদিন এই প্লাটফর্মটি টিকে থাকবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। দুর্ভাগ্য হলো স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের আদর্শের রাজনীতি শিক্ষা সংস্কৃতিতে পুনর্জীবিত করার কাজ যথাযথভাবে দেশে হচ্ছে না বলেই বাংলাদেশের রাজনীতি এখনও রাষ্ট্রবিনির্মাণে বড়ো ধরনের কোনো ভুমিকায় যাওয়ার অবস্থানে নেই। ফলে বিএনপি আছে এবং থাকবে তবে আগের মতো শক্তিশালী অবস্থানে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সে কারণেই দলটিকে প্রতি নির্বাচনের আগে ভর করতে হয় রাজনীতির এতিম সন্তানদের ওপর। বিএনপি কোন শক্তির ওপর ভর করবে তা দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া এ মুহূর্তে আমাদের দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :