উপাচার্যকাণ্ডে বিএসএমএমইউতে তুলকালাম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ও তড়িগড়ি করে শেষ সিন্ডিকেট মিটিং করার পাঁয়তারাকে কেন্দ্র করে তুলকালাম পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই উপাচার্যের দ্বিতীয় মেয়াদে থাকার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর পরই শুরু এই অস্থিতিশীলতা।
বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হকের নাম ঘোষণার পর থেকেই শারফুদ্দিন আহমেদ তাড়াহুড়া করে তার হাতে থাকা অসাপ্ত নিয়োগ শেষ করতে চান। এ নিয়েই মূলত ক্যাম্পাস উত্তপ্ত।
উপাচার্যের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে শনিবার তার কার্যালয়ের সামনে শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কার্মচারী ও নার্সরা বিক্ষোভ করেন। এ সময় শারফুদ্দিন আহমেদপন্থী কয়েকজন চিকিৎসককে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া উপাচার্যের দপ্তরের সামনে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত আনসার সদস্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিএসএমএমইউর প্রক্টর অধ্যাপক হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করা হলো।
রবিবার সকাল ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখা গেছে, ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ডা. মিল্টন হলের সামনে ও বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছে। উপাচার্যের দপ্তরের সামনে নিরাপত্তার জন্য আট থেকে ১০ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
শারফুদ্দিন আহমেদের মেয়াদকালে যে নিয়োগগুলো হয়েছে, তা অধিকাংশই বিতর্কিত। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে।
সরেজমিনে ক্যাম্পাসে গেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, প্রচলিত আছে ইট-কাঠ পর্যন্ত জানে, যাদের থেকে উপাচার্য টাকা নিয়েছেন তাদের যদি নিয়োগ দিয়ে যেতে না পারেন তাহলে উপাচার্যকে টাকা ফেরত দিয়ে যেতে হবে। এ জন্য শেষ সময় উপাচার্য সিন্ডিকেট মিটিং করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এছাড়া উপাচার্যর মেয়াদকালে তার অনুসারীরা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তারা অন্যদের কোনঠাসা করে রেখেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও পুলিশ মোতায়েনসহ সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তার কার্যালয়ে কথা হয় ঢাকা টাইমসের এ প্রতিবেদকের। উপাচার্য বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আর যাতে মারামারি না হয়, এজন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ কবে সরানো হবে তা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর।’
আপনার মেয়াদকালে আপনারই অনুসারীরা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। অন্যদের কোণঠাসা করে রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আপনি দায়িত্ব থেকে যাওয়ার পর আপনার অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়বে কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমার অনুসারীরা কোণঠাসা হবেন বলে আমি মনে করি না। বিষয়টি নতুন উপাচার্য দেখবেন। এখানে অনুসারী বলতে কিছু নেই, তারা আমার কাজের সহযোগিতা করেছেন।’
উপাচার্য কার্যলয়ের সামনে মোতায়েনকৃত আনসার সদস্যরা ঢাকা টাইমসকে বলেন, নতুন উপাচার্য স্যারের নাম ঘোষণার পর থেকে ক্যাম্পাসে অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এজন্যই আমাদের এখানে আনা হয়েছে। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ঘটবে, এটা আগ থেকে বুঝা যাচ্ছিল।
আনসার সদস্য দুলাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে পরিস্থিতি খারাপ। গতকালের (শনিবার) ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তার জন্য উপাচার্যের রুমের সামনে আমরা অবস্থান নিয়েছি।’
শনিবার উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছে আওয়ামী লীগপন্থি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সংগঠনের শিক্ষকরা; বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কার্মচারী ও নার্সরা।
আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বিএসএমএমইউ শাখার সদস্য সচিব অধ্যাপক মো. আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার টিটো ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট মিটিং না হলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। প্রক্টর থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে কোনো সিন্ডিকেট মিটিং করা হবে না, কাউকে পদায়নও করা হবে না।’
ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন সম্পর্কে জোয়ারদার টিটো বলেন, ‘এটা আমাদের কাছেও প্রশ্ন ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন? তারপরও আমরা এটাকে ভালোভাবে নিয়েছি, কারণ যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।’
এই পরিস্থিতির পেছনের কারণ উল্লেখ করে এই স্বাচিপ নেতা বলেন, ‘এর আগের উপাচার্য (কনক কান্তি বড়ুয়া) শেষ সিন্ডিকেট মিটিং করে যেতে পারেননি। তখন এই উপাচার্যই (শারফুদ্দিন আহমেদ) তার পূর্বের উপাচার্যকে সিন্ডিকেট মিটিং করতে দেননি। ঐতিহ্যটাই এমন। পরবর্তী উপাচার্যর নাম ঘোষণার পর রার্নিং উপাচার্য শুধু রুটিন কাজ করে যাবেন। এটাই চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।’
বিএসএমএমইউ শাখার স্বাচিপের এই সদস্য সচিব বলেন, ‘উপাচার্যর মেয়াদকালে তার অনুসারীরা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তারা অন্যদের কোণঠাসা করে রেখেছেন, যার শতভাগ সত্যতা আছে।’
আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার টিটো বলেন, ‘বিগত দিনের কোনো উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামগ্রিকভাবে বিদায় সংবর্ধনা পাননি। এর কারণ হলো তাদের শেষ সময়ের কর্মকাণ্ড, যা দুঃখজনক।’
বিএসএমএমইউর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মাদ আতিকুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে পুলিশ এনেছে, এ সম্পর্কে আমি অবগত নই। আমরা অফিস করছি, রোগী দেখছি, শিক্ষা, গবেষণার কাজ সবই চলছে। কোনো কিছুই থেমে নেই।’
কোষাধ্যক্ষ ভিসি হতে না পেরে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন— উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদের এমন অভিযোগ সম্পর্কে কোষাধ্যক্ষ বলেন, ‘উপাচার্য নিয়োগ দেন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। এতে আমি এখানে গণ্ডগোল করাব কেন? উপাচার্য স্যার যা বলেছেন, তা সত্য নয়। ক্যাম্পাসের বর্তমান পরিস্থিতির পরিবেশ তারই তৈরি। এটি নিয়োগ সংক্রান্ত ঝামেলা। এখানে আমাদের চেয়ার তো স্থায়ী নয়। সেক্ষেত্রে এমনটা কারো বিরুদ্ধে বলে যাওয়া ঠিক না।’
সার্বিক বিষয় নিয়ে বিএসএমএমইউ উপাচার্যের সিন্ডিকেটকে দায়ি করেছেন প্রক্টর ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি শান্ত নেই, এটা তো বাস্তব। উপাচার্য যাবেন, আসবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নতুন উপাচার্যর নাম ঘোষণার পর থেকেই ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করেছে। এর অনেক কারণ আছে। এতো ব্যাখা আমি দিতে পারব না। তবে গত দেড় বছরে এই উপাচার্যর (শারফুদ্দিন আহমেদ) আশেপাশে একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এরা সঠিকভাবে উপাচার্যকে পরিচালনা করতে পারেনি। তারা ক্ষমতার এমন পর্যায়ে অপব্যবহার করেছেন, যাতে করে পুরো ক্যাম্পাসে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এসব ক্ষোভ বাড়তে থাকে, এরপর যখনই নতুন উপাচার্যর নাম অর্ডার হয়, তখনই এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।’
উপাচার্যকে কেন্দ্র করে এই সিন্ডিকেট করার জন্য অনেক বিতর্কিত নিয়োগ হয়েছে। এর কারণে ডাক্তার, নার্সসহ অনেকেই বিরক্ত ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ ছিল বলেও স্বীকার করেন প্রক্টর। পুলিশ মোতায়েন নিয়ে প্রক্টর বলেন, ২৮ মার্চ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন থাকবে।
হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় স্থবির হয়ে গেছে। নতুন উপাচার্য এসে স্থবিরতা কাটিয়ে উঠবেন বলে আশা করি। আমরা সবাই চাই বিশ্ববিদ্যালয় গতিশীল হোক।’
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবাণিজ্য নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করার দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে প্রক্টর বলেন, ‘নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ আমাদের কাছেও প্রচুর আসে। এ ধরনের কিছু হলে অবশ্যই আমরা তদন্ত করে দেখব। আর বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের বিষয়টা নতুন উপাচার্য আসার পরে দেখবেন।
(ঢাকাটাইমস/২৪মার্চ/টিআই/কেএম)

মন্তব্য করুন