বিশ্বে প্রায় এক কোটি আইবিডি রোগী আছে
বিশ্বে প্রায় এক কোটি ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ (আইবিডি) বা পরিপাকতন্ত্রের মারাত্মক প্রদাহ সৃষ্টিকারী রোগে আক্রান্ত মানুষ আছেন। রোগটি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ১৯ মে ‘বিশ্ব আইবিডি দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) পরিপাকতন্ত্রের মারাত্মক প্রদাহ সৃষ্টিকারী রোগ বিশ্ব আইবিডি দিবস ২০২৪ উপলক্ষে র্যালি, সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এবারে আইবিডি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘আইবিডির কোনো সীমা নাই’। এখন রোগটি শুধু পশ্চিমা বিশ্বে নয়, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্ট্রারোলজি বিভাগের আইবিডি ক্লিনিকের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এসকল কর্মসূচীতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিডি ক্লিনিকে ২০১৭ সাল থেকে এ ধরণের রোগীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি ব্লকে ১৪ তলায় গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের আইডিবি ক্লিনিকে এসকল রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আইবিডি ক্লিনিকে সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বায়োলজিক্স ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে দেশেই এসব রোগীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হওয়ায় এ ধরনের রোগীদের বিদেশে যাওয়া প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, মানুষকে তা জানাতে হবে। মিডিয়াতে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাসহ আন্তর্জাতিক জার্নালে তা প্রকাশ করতে হবে। এই সকল গবেষণা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষ জানতে পারবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার খ্যাতি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ ‘আইবিডি’ ক্লিনিকে অনেকগুলো গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে, কিছু গবেষণা চলমান রয়েছে, এ বিষয়েও মানুষকে জানাতে হবে।
উপাচার্য তার বক্তব্যে রোগীদের রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে ডায়াগনোসিস এর ওপর গুরুত্ব দিতে চিকিৎসকদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি আরও বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো বিভাগে কোন মেশিন যেন বাক্সবন্দি না থাকে, দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে না পরে থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেওয়ান সাইফুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মনিরুজ্জামান খান, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল হান্নান, প্রক্টর অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল প্রমুখসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, ছাত্রছাত্রীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফজলুল করিম চৌধুরী সঞ্চালনায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইবিডি ক্লিনিকের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ এবং ফেইজ বি এর রেসিডেন্ট ডা. অদিতি সরকার।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সাহাদত হোসেন সেখ ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. রাজীবুল আলম।
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিশেষজ্ঞ ও আইবিডি ক্লিনিকের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ জানান, আইবিডি দুই ধরনের হয়। একটি হলো-আলসারেটিভ কোলাইটিস, এটি প্রধানত বৃহদন্ত্রে প্রদাহ বা আলসার তৈরি করে থাকে। আর দ্বিতীয়টি হলো ক্রন্স ডিজিজ, এই রোগে পরিপাকতন্ত্রের যেকোনো অংশ (মুখ থেকে পায়ুপথ) আক্রান্ত হতে পারে। আলসারেটিভ কোলাইটিস হলে দীর্ঘদিন ধরে রক্তমিশ্রিত পাতলা পায়খানা হতে পারে। তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে তলপেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া, মলদ্বারে ব্যথা ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্রোনস ডিজিজের উপসর্গ হলো পাতলা পায়খানা, পেটব্যথা, ওজন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি, এছাড়া রক্তমিশ্রিত পাতলা পায়খানাও হতে পারে। জটিলতা হিসেবে খাদ্যনালি সরু হয়ে পেট ফুলে যেতে পারে, খাদ্যনালি ও মলদ্বারে ফিস্টুলা হতে পারে। রোগীর রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে, শরীরে পানি আসতে পারে। আইবিডিতে পরিপাকতন্ত্রের বাইরেও কিছু উপসর্গ যেমন অনেক সময় আইবিডি রোগীরা চোখের প্রদাহ (চোখ লাল, চোখে ব্যথা) উপসর্গ নিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। এছাড়া মুখে ঘা, গিরাব্যথা ও ফোলা ও ত্বকে প্রদাহ ইত্যাদি হতে পারে। আইবিডির আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা বাংলাদেশেই সম্ভব। অতীতে অনেক আইবিডি রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমন করত, যার ফলশ্রুতিতে দেশের প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যেত। বর্তমানে আইবিডি ক্লিনিক বিএসএমএমইউ এর মাধমে এই সব রোগীদের দেশেই উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ফলে দেশের অনেক অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে।
সেমিনারে জানানো হয়, আইবিডি ক্লিনিকে এ পর্যন্ত ৫৭৬ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ক্রোনস ডিজিজ ২৪১ জন এবং আলসারেটিভ কোলাইটিস ৩৩৫ জন। ক্রোনস ডিজিজের মধ্যে পুরুষ ১৬৫ জন মহিলা ৭৬ জন, এদের মধ্যে শহরে বসবাসকারী রোগীর সংখ্যা ৪৩ শতাংশ এবং গ্রামে বসবাসকারী রোগীর সংখ্যা ৫৭ শতাংশ। আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগীদের মধ্যে পুরুষ ২১৬ জন এবং মহিলা ১১৯ জন। শহরে বসবাসকারী রোগীর সংখ্যা ৪৫ শতাংশ এবং গ্রামে বসবাসকারী রোগীর সংখ্যা ৫৫ শতাংশ। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা বিভাগে পাওয়া গেছে। ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও রাজবাড়ী এই ৪টি জেলায় আইবিডি রোগী বেশি পাওয়া গেছে।
সেমিনারে জানানো হয়, আইবিডি রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। এ কারণে কারো মধ্যে রোগটির যেকোন ধরন শনাক্ত হলেই তা নিয়ন্ত্রণের টার্গেট নেন চিকিৎসকেরা। এ জন্য রোগীদের ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেয়া হয়। চিকিৎসকের ফলোআপে থেকে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে- এটি বেড়ে কিছুতেই যেন জটিল আকার ধারণ না করে। আইবিডি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যেই আসল সাফল্য। তবে রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়ার কারণে সারা জীবন চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয়।
(ঢাকাটাইমস/১৯মে/টিআই/ইএস)