জনসংখ্যার তিন শতাংশই হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত

কেমন আছেন সবাই। আমার প্রত্যাশা, আপনারা যে যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। নিরাপদে থাকুন। আজ আমি যে বিষয় নিয়ে কথা বলবো, সেটা শুরু করার আগে স্বাস্থ্য বিষয়ক একটা গবেষণায় পাওয়া একটি তথ্য আপনাদের জানাতে চাই। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশই হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত এবং এই রোগে নারীরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এই রোগটির নাম অস্টিওপরোসিস। এই রোগে আক্রান্তদের অনেকেই তাদের রোগ সম্পর্কে জানেন না।
কী ভয়ানক, তাই না। আসলে এটা সত্য যে, সমস্যা দেখা না দিলে আমরা অনেকেই জানি না যে, আমার হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু জানতে হবে যে- সমস্যা তো দেখা দিবে তখনই যখন এই ক্ষয়টা একটা মাত্রায় পৌঁছে আপনাকে সমস্যায় ফেলেছে। কিন্তু এটা ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় পৌঁছে গেলে সেটা জটিল হয়ে পড়ে। আর শুরুর দিকে যদি ধরা পড়ে, তাহলে সেটাকে সামলে নেওয়া বা বিদায় জানানোর চিকিৎসা আছে। আরো একটা বিষয় জেনে নিন, গবেষণায় কিন্তু এটাও এসেছে যে, ৫০ থেকে ৭০ বয়সী যারা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই নারী। তবে ৭০ বছর থেকে শুরু করে পরের বয়সীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা কিছুটা বেশি।
অনেকদিন ধরে হাড় ক্ষয় রোগে ভুগছিলেন সালমা নামে এক ভদ্রমহিলা। তবে তিনি জানতেন না এটা যে হাড় ক্ষয় রোগ। তিনি দীর্ঘদিন পিঠ ব্যথায় ভুগছিলেন। অনেক ওষুধ খেয়েছেন। লাভ হয়নি। কিছুদিন কম থেকে আবার বেড়ে যায়। পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলেন, তার হাড় ক্ষয় রোগ।
আমরা যারা হাড় ক্ষয় রোগ নিয়ে কাজ করি তাদের ধারণা, আগামী পাঁচ বছরে নন-কমিউনিকেবল যেসব রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তার মধ্যে শীর্ষ পাঁচে এই হাড় ক্ষয় রোগ উঠে আসবে। বাকি চারটি হচ্ছে, হার্ট, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস ও ফুসফুসের সমস্যা। আসুন এবার আমরা একটু জেনে নেয়ার চেষ্টা করি হাড় ক্ষয় রোগটা আসলে কী? আমরা সবাই কম বেশি জানি যে, প্রতিটি মানুষের শরীরের হাড়ের একটি গঠন প্রক্রিয়া আছে। জন্মের পর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হাড় নানাভাবে পরিপক্ব হতে থাকে। এরপর আবার একটা সময়ে এসে ঘনত্ব কমে হাড় পাতলা হতে শুরু করে। আর এই হাড়ের ঘনত্ব যখন কমে যায় তখনই সেটা একটা রোগ। আর এর নামই হচ্ছে হাড় ক্ষয় রোগ। হাড়ের স্ক্যান করে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন যে- এর ঘনত্ব কতটা কমেছে এবং সে অনুযায়ী তারা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। জেনে রাখুন, রোগটিতে আক্রান্ত হলে হাড়ের ঘনত্ব কমে হাড় ছিদ্রযুক্ত, দুর্বল এমনকি ভেঙেও যেতে পারে। সঠিক সময়ে এর প্রতিরোধ বা চিকিৎসা না নিলে একান্ত ব্যক্তিগত কাজ করাটাও জটিল হয়ে উঠছে। বলতে পারেন, নামাজ বা ধর্ম পালন, গোসল, টয়লেটে এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অনেকেই জানতে চান যে, এই রোগে নারীরা কেন পুরুষদের চাইতে বেশি আক্রান্ত হন। শুনুন। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বয়স পর স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের হাড় ক্ষয় হতে থাকে। মানুষের শরীরের এ ধরনের পরিবর্তনের সাথে হরমোনের প্রভাব থাকে। আর নারীদের শরীর থেকে হরমোন খুব তাড়াতাড়ি কমে যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে এস্ট্রোজেন এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোনের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে মেয়েদের মাসিক বন্ধ হলে বা মেনোপোজের পর এটি বেশি হয়। আর হরমোন কমে গেলে শরীর থেকে দ্রুত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি বের হয়ে যায়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি কমে গেলে তখন শরীর আর হাড় গঠন করতে পারে না। ফলে শুরু হয় হাড় ক্ষয়। এছাড়া যারা ক্যান্সার, রক্তরোগ, অপুষ্টি রোগ, কিডনি রোগে আক্রান্ত তাদের হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এর বাইরে নানা রোগের চিকিৎসার জন্য যারা দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড সেবন করে তাদের হাড়েরও ঘনত্ব কমে গিয়ে হাড় ক্ষয় রোগ হতে পারে। বলতে পারেন, হাড় ক্ষয় একটি নীরব ঘাতক। অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তিনি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। এবার চলুন জেনে নেই, রোগটির লক্ষণ কী? হলে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় শরীরে? সাধারণত মানুষ পিঠের ব্যথা নিয়েই আমাদের কাছে আসেন। এছাড়া কোমর ব্যথাও অনেকের মধ্যে দেখা যায়। পরে দেখা যায় তারা হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত। এই লক্ষণগুলোই বেশি আগে ধরা পড়ে।
আরেকটি কথা মনে রাখবেন, এ রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত যতটুকু আঘাতে একজন ব্যক্তির হাড় ভাঙার কথা তার মাত্র এক পঞ্চমাংশ আঘাতেই হাড় ভেঙে যায়। আর মেরুদণ্ডের হাড়ের ক্ষয় হলে মানুষ একটা পর্যায়ে গিয়ে কুঁজো হয়ে যায়। মেরুদণ্ড ছাড়াও কোমর, হাতের কব্জি, পায়ের কুচকির হাড়ের ক্ষয় হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। সব চেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, যেসব হাড় মানুষের দেহের ওজন বহন করে সেগুলোই ক্ষয় হয় বা ভেঙে যায়। এখন জানতে চাইবেন যে, এর কি কোনো চিকিৎসা নেই? আমি বলবো, আছে এবং নেই দুটোই। তবে ধরা পড়ার পর আসলে চিকিৎসার চেয়ে রোগটি প্রতিরোধ করাই মুখ্য এবং উত্তম। এজন্য সুষম খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে ছোটোবেলা থেকেই। আর শারীরিক পরিশ্রম ও রোদে যাওয়াটাও সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রোদ একটি ভালো ওষুধ। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পুডিং, দুধ, দই, সবুজ শাক-সবজি ও তাজা ফলমূল যেমন খেতে হবে তেমনি বাচ্চাদের বাইরে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। সুষম খাবার না পেলে আর খেলাধুলা না করলে বাচ্চাদের হাড় গঠন ঠিক মতো হয় না যা ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি যদি এই রোগের লক্ষ্য নিজের মাঝে অনুভব করেন বা নিশ্চিত হন, তবে শরীরের ক্যালসিয়ামের জন্য নিয়মিতভাবে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও দুধজাতীয় খাবার খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ মিনিট সূর্যের আলোতে থাকবেন। এছাড়া সামুদ্রিক মাছ খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে এবং ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি রোগ থাকলে সেটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
আর সতর্কতা হিসেবে বাসা বাড়িতে বাথরুমের পিচ্ছিল ভাব দূর করা, রাতে ঘরে মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখা এবং অন্ধকারে চলাফেরা না করাটাও আপনার জন্য একটা পরামর্শ থাকলো। পাশাপাশি এ রোগে যারা আক্রান্ত হন তাদের কোনোভাবেই অতিরিক্ত ওজন বহন না করার জন্যও অনুরোধ থাকলো। বিদায় নেওয়ার আগে আবারো বলছি, আসলেই এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। আছে নিয়ন্ত্রণে থেকে ভালো থাকার জন্য চিকিৎসা। আর সেটা হচ্ছে এতক্ষণ যা বললাম সেগুলো মেনে চলা। আর পাশাপাশি একজন ভালো অর্থোপেডিক চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা।
লেখক: অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক, নিটোর (পঙ্গু)

মন্তব্য করুন