জবি ক্যাম্পাস: দিনে-রাতে সমান তালে বসে মাদকের আসর

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসে মাদকের অপব্যবহার বাড়ছে। এখানে অবাধে চলে মাদকের আসর। ছোট এ ক্যাম্পাসে প্রায় ১০টিরও বেশি স্পটে নিয়মিত চলে ধূমপান ও মাদক সেবন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাকের ডগায় এসব অপকর্ম ঘটলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ প্রশাসন। অবাধে ও প্রকাশ্যে মাদক গ্রহণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এতে শিক্ষকরাও নিয়মিতই বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন। এতে ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে অপকর্মও। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারে (নিয়ন্ত্রণ) ২০০৫ সালের আইনে বলা আছে যে, পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা যাবে না। এই পাবলিক প্লেসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। সংবিধানের ১৮ নং অনুচ্ছেদেও বলা আছে, রাষ্ট্র জনগণের পুষ্টিমান উন্নয়ন, জীবনমান উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকল্পে যত নেশাজাতীয় দ্রব্য আছে সেগুলো নিরুৎসাহিত করবে।
সরজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে-কানাচে, ফটকের পাশে প্রকাশ্যেই চলছে মাদক সেবন। বিজ্ঞান অনুষদের বারান্দায়, প্রতিদিন যাতায়াত করা বাসগুলোর আড়ালে, নতুন ভবনের নিচের গ্যারেজে, মুক্তমঞ্চ এলাকায়, রফিক ভবনের পূর্ব পাশে, কাঁঠালতলার পাশে, দ্বিতীয় ফটকের সামনে, বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে, প্রধান ফটক ঘেঁষে, বিবিএ ভবনের পেছনের অংশে, বাসের দ্বিতীয় তলায় বসে মাদকের আসর। এছাড়াও রাত যত গভীর হয়, জবির কথিত টিএসসিতে ততই বাড়তে থাকে মাদকসেবীদের আড্ডা।
জবি শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি মাদক ব্যবসায়ী চক্র। বাংলাবাজারে অবস্থিত ফুটওভার ব্রিজের আশপাশে হাত বাড়ালেই মিলছে নেশাজাতীয় দ্রব্য। শিক্ষার্থীদের চাহিদামতো মাদক সরবরাহ করেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় অনেক মাদক ব্যবসায়ী বিভিন্ন বেশ ধরে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করেন। এদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের মাদকসেবীদের রয়েছে বিশেষ সখ্য।
ক্যাম্পাসে পুলিশ না আসায় ও সন্ধ্যার পর প্রক্টরিয়াল বডি চলে যাওয়ার পরেই বসে মাদকের আসর। মাদক গ্রহণে পিছিয়ে নেই নারী শিক্ষার্থীরাও। সন্ধ্যা পেরোলেই কথিত টিএসসির এক কোণায় একসঙ্গেই বসে চলে ছাত্রছাত্রীদের মাদকের আড্ডা। অবকাশ ভবনের বিভিন্ন স্থানেও এদের মাদক সেবন করতে দেখা যায়।
মাদক সেবনের খরচ জোগাতে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধেও জড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এদের হাতে বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকের সামনে নিয়মিতই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। ছিনতাইকারীদের মধ্যে অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত মাদকসেবী। এদের অধিকাংশই ছিনতাই ছাড়াও ক্যাম্পাসের সামনের এলাকায় চলাচল করা গাড়ি ও দোকানদারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির সঙ্গেও যুক্ত। মাদকের টাকার জোগান দিতে জবির মূল ফটকের সামনে থাকা বাসগুলো থেকে বিভিন্ন সময়ে চাঁদা দাবি করে আসছে এসব মাদকসেবী। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে নারী হেনস্তার মিথ্যা অভিযোগ এনে মারধর করে বাসচালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এসব নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারবার সংবাদ প্রকাশিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সরকার যখন মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে তখন দেশসেরা বিদ্যাপীঠখ্যাত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশ মাদকের করাল গ্রাসে পতিত হচ্ছে। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে জবি ক্যাম্পাসকে মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে এসব মাদকসেবী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বহিরাগতরাও ক্যাম্পাসের ভেতরে মাদক সেবনে জড়িত। শুধু সেবনই নয়, অনেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামসর্বস্ব কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরাও প্রকাশ্যেই মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
গত কয়েক মাসে এসব সাংস্কৃতিক সংগঠনের এক ডজনের মতো কর্মীকে মাদক সেবনরত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি আটক করলেও পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সেবনের এই মহোৎসব থামছে না। এছাড়াও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদেরও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে আড়ালে ধূমপান করতে দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, শিক্ষকরা হলেন জাতির আলোকবর্তিকা। তারা নিজেরাই যদি ধূমপান করে তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি শিখবে। এ বিষয়ে তাদের সচেতন হওয়া উচিত।
ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি ক্যাম্পাসে মাদকসেবীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সাইন্স বিল্ডিংয়ের দিকটা তুলনামূলক নির্জন হওয়ায় সন্ধ্যার পর মাদকের গন্ধে ওইদিকে বসা যায় না। মাদক মেধা বিকাশের অন্তরায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় মাদকের এমন অবাধ বিচরণ খুবই দুঃখজনক।
আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাসুম বিল্লাহ বলেন, মাদক গ্রহণের বিরুদ্ধে আইন আছে। পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে জরিমানা করার বিধান আছে। যদিও এই আইন অনেকে মান্য করে না। আসলে আইন কাজ করে জনগণের মানার ক্ষমতার ওপর। জনগণ যদি সচেতন হয় তাহলে এটি কার্যকর হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০৪০ সাল নাগাদ আমাদের বাংলাদেশ ধূমপানমুক্ত হবে এবং একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আসলে আমাদের যে উন্মুক্ত লাইব্রেরি আছে সেটা খোলা রাখাটাও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আবার বন্ধ করাটা আরেক সমস্যা। এটা খোলা থাকে বলেই রাতে শিক্ষার্থীরা প্রবেশের সুযোগ পায়। আমাদের হল নেই, রিডিং রুম নেই, ভালো লাইব্রেরি নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রতিকূল পরিবেশে লেখাপড়া করে। তো সে জায়গা থেকেই উন্মুক্ত লাইব্রেরির সুবিধাটা আমরা দিচ্ছি। এই উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে আমাদের প্রাক্তন ছাত্ররা লেখাপড়া করে। এটি রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে। ওই সেন্সে দেখলে আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই তো বহিরাগত। আমরা রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত থাকি। আর তারপর নিরাপত্তা কর্মীরা থাকেন। আমি নিরাপত্তা অফিসার যিনি আছেন তাকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলবো।
(ঢাকাটাইমস/২২মে)

মন্তব্য করুন