‘গরম মসলার ঝাঁজে’ বাজার গরম

মেহেদী হাসান, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৪ জুন ২০২৪, ১৯:৫৯
অ- অ+

আর মাত্র দুদিন পর পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদ উপলক্ষে কোরবানির জন্য বাড়িতে আনা হচ্ছে গবাদি পশু। কোরাবানির মাংসের পাশাপাশি বিভিন্ন আইটেমের খাবারের স্বাদ বাড়াতে মসলার চাহিদা এই সময়ে বেড়ে যায়। এ কারণে ঈদ সামনে রেখে মসলার দাম বেড়েই চলেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সারা বছরই ওঁৎ পেতে থাকেন। সুযোগ পেলেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এই ধারাবাহিকতায় ‘গরম মসলার ঝাঁজে’ এখন বাজার গরম। এমনকি মসলার দামের উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ সাধারন মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে দরকারী এই পণ্য।

স্বাভাবিকভাবে ঈদে মসলার চাহিদা বেড়ে যায়। কোরবানির ঈদে তা বাড়ে আরও কয়েকগুণ। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট করে মসলার দাম বাড়িয়েছে। অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঈদের আগ মুহূর্তে অস্থির হয়ে উঠেছে মসলার বাজার। সরবরাহের ঘাটতি দেখা না গেলেও প্রতিটি মসলার দামেই বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে গ্রাহকদের।

রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ ও জয়ত্রি।

খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বলছেন, ঈদুল আজহা ঘিরে তিন মাস আগে থেকেই মসলা আমদানি শুরু করেন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা। এর ফলে দেশের বাজারে বিপুল পরিমাণ মসলা আমদানি হলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে দাম। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটের কারণে মসলার দাম এতো চড়া। সংশ্লিষ্টদের মতে গুটি কয়েক ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি মসলার বাজার।

রামপুরা কাঁচা বাজারের খুচরা মসলা বিক্রেতা আলী আজগর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যদিও আরও দুই তিন মাস আগেই এসব মসলা আমদানি করা হয়েছে। তবুও দাম বেড়েছে মসলার। তাছাড়া দুই মাস ধরে ভারত থেকে আমদানি কম হয়েছে এতে লাগামহীন হয়ে পড়েছে এলাচের দাম। প্রতিকেজি এলাচের দাম দ্বিগুণ হয়ে চার হাজারে গিয়ে ঠেকেছে।’ নানা ধরনের কথা বলে মসলার দাম বাড়িয়ে ফেলেন পাইকারি মসলা ব্যবসায়ীরা— অভিযোগ এই বিক্রেতার।

মসলা কিনতে তালতলা বাজারে এসেছেন আবু সাঈদ মিয়া। বাজার ঘুরে ঘুরে বিক্রেতাদের ‍দরদাম করতে দেখলেও মসলা কিনতে দেখা যাচ্ছে না তাকে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সারা বছরের লাভ একসঙ্গে কোরবানির ঈদের সময় করার টার্গেট হাতে নিয়েছে মসলা ব্যবসায়ীরা। অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো মসলার দাম বাড়িয়ে দেন। এই ঈদেও তেমনটিই ঘটেছে। রোজার ঈদ থেকে কোরবানির ঈদ মসলার দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। মসলার দাম কমার কোনো খবর নেই, শুধু বেড়েই চলেছে।’

বাংলাদেশ গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হাজী সাইদুল হাওলাদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কোরবানির ঈদে যে শুধু মসলার দাম বাড়ে তাই নয়। মসলার চাহিদাও থাকে বেশ। চাহিদামাফিক মসলার সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য দাম তুলনামূলক বাড়ে। আবার নানা সময়ে মসলার বাজার পরিপূর্ণ রাখতে আমদানি বাড়াতে হয় এতে করে চড়া দামে মসলা কিনতে হয়।’

মসলা ব্যবসায়ীদের এই নেতার দাবি— শুধু দেশের বাজারেই মসলার দাম বাড়তি না। পাশের দেশ ভারতের বাজারেও মসলার দাম বাড়তি। সেখান থেকে আমদানির কারণে এই প্রভাব দেশের বাজারে পড়েছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার বেশ কিছু মসলার দাম বেড়েছে, কিছু মসলার দাম কমেছেও। এর মধ্যে সয়াবিন তেল (লুজ) প্রতি লিটার ২ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫২ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ৫ টাকা বেড়ে ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজিতে ১০ টাকা দাম বেড়ে নতুন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা এবং দেশি রসুন ২০০-২৪০ টাকা। দেশি হলুদ প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। বর্তমানে তা ৩১০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকৃত আদা প্রতি কেজি ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা। প্রতি কেজি দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৫২০-৬০০ টাকা, কমেছে দশমিক ৮৮ শতাংশ। এলাচ (ছোট) প্রতি কেজি ৩,৩০০-৪,০০০ টাকা, দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ধনিয়া প্রতি কেজি ২০০-২৭০ টাকা। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে তেজপাতার। সপ্তাহের ব্যবধানে ৪২ দশমিক ৮৬ শতাংশ দাম বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০-৩০০ টাকা। যদিও টিসিবির এ তথ্যের চেয়ে বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম আরও বেশি।

বিভিন্ন বাজারের তথ্য অনুযায়ী, দেশি পেঁয়াজের কেজি মানভেদে ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগেও ৮০ টাকা আর একমাস আগে ছিল ৫৫-৬০ টাকা। একইভাবে গত এক সপ্তাহে প্রায় সব বাজারে রসুনের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে এখন ২৫০ টাকা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় লাফ দিয়েছে আদার দাম। এ পণ্যটি কেজিতে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ২৪০-২৫০ টাকা। এটা আরও বাড়বে বলছেন বিক্রেতারা।

এ বিষয়ে কাওরান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শুক্র-শনিবার দাম আরও বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করলে শুল্ককরসহ দেশে আনতে প্রায় কেজিপ্রতি ৭০ টাকা খরচ হয়। যে কারণে ভারতের পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে না। এতে বাজার শুধু দেশি পেঁয়াজের ওপর নির্ভর করেই চলছে।’

এক সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি জিরা ৬৬০-৬৮০ টাকা করে বিক্রি হলেও বর্তমানে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। কেজি প্রতি ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে শাহী জিরা। আর ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া মিষ্টি জিরার দাম কমে এখন প্রতি কেজি ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে পাঁচফোড়ন ২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও ঈদকে সামনে রেখে কেজি প্রতি ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

একইভাবে প্রতি কেজি কালো এলাচ ২ হাজার ৪৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৬৫০ টাকা, সাদা এলাচ ৩ হাজার ৫০ থেকে ২৩০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৩ হাজার ২৮০ টাকা, দারুচিনি ৩৮০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৪২০ টাকা, লবঙ্গ ১ হাজার ৬০০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ১ হাজার ৬৮০ টাকা এবং গোল মরিচ ৭৬০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি ৮৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি আদা ২০০ থেকে বেড়ে ২৭০ টাকায়, প্রতি কেজি রসুন ২৪০ থেকে বেড়ে থেকে ২৭০ টাকা এবং শুকনা মরিচ প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকায় এবং গুঁড়া হলুদ প্রতি কেজি ২০০ থেকে বেড়ে টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

৪০০ টাকার কেজির রাঁধুনি কেজি প্রতি ২০০ টাকা বেড়ে এখন ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মেথি ১৬০ টাকা কেজি, চিনাবাদাম ১৬০ টাকা কেজি, কাজু বাদাম ১৩০০ টাকা কেজি, পেস্তা বাদাম ৩ হাজার ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এখন দাম কমে ২ হাজার ৮০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। ত্রিফলা ১৬০ টাকা কেজি, জয়ফল ১৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও দাম কমে এখন ১ হাজার টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। তেজপাতা ১২০ টাকা কেজি, সাদা গোলমরিচ ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও দাম কমে এখন ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া ২৬০ টাকা কেজির ধনিয়া কেজি প্রতি দাম কমে ১৮০ টাকা, ১৪০ টাকা কেজির সরিষা দাম কমে ১০০ টাকায়, ৮০০ টাকা কেজি দরের কিশমিশ কেজি প্রতি প্রায় ২০০ টাকা কমে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২ হাজার ৬০০ টাকা কেজির গোল্ডেন এলাচ কেজি প্রতি ২৮০০ টাকা, ২৬০০ টাকা কেজি দরের বড় এলাচ কেজি প্রতি ২০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৮০০ টাকা, গোলমরিচ ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন দাম কমে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বনশ্রীর মসলা বিক্রেতা রুহুল আমি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই ঈদে গবাদি পশু কোরবানি করা হয় এজন্য মসলার দাম বেড়ে যায়। ঈদের আগ মুহূর্তে আগামী দুই তিনদিন মসলা বেচা কেনা বেশি হবে।’

মেরাদিয়া বাজারের আরেক মসলা বিক্রেতা কুদ্দুস বেপারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা তো মসলার দাম বাড়াতে কমাতে পারবো না। মসলার দাম কম হলেও কাস্টমার খুশি না। মসলা কিনতে আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের দামাদামি করতে করতে জান শেষ।’

রামপুরা কাঁচা বাজারে মসলা কিনতে আসা আফসানা করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঈদে গরু কোরবানির জন্য হাটে গেছে আমার স্বামী। আমি বাজারে এসেছি মসলা কেনার জন্য। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহ আগের মসলার দাম এখনকার মসলার দাম যেন আকাশ পাতাল। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষের। আবার মসলা না কিনে তো কোনো উপায়ও নেই।’

সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘দাম বাড়ার কথা না থাকলেও অযৌক্তিকভাবে বাজারে কারসাজি করে কিছু পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত রোজায় দেখা গেছে, কিছু পণ্যের চাহিদাকে পুঁজি করে বাজার অস্থির করে রাখা হয়েছিল।’ এবার কেউ অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। দাম বৃদ্ধির দাম চাপাচ্ছেন এনবিআরের ওপর।

উল্লিখিত সভায় বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘পণ্য আমদানিতে বিভিন্ন স্তরে শুল্ক দিয়ে দাম বাড়ায় এনবিআর। এরপর মার্কেটে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আমাদের পেছনে ম্যাজিস্ট্রেট লাগিয়ে দেওয়া হয়, জরিমানা করা হয়। তদারকি সংস্থার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ব্যবসায়ীদের লাঞ্ছিত করছেন। জায়গায় জায়গায় অপদস্থ করাচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়।’

(ঢাকাটাইমস/১৪জুন/এমএইচ/এসআইএস)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বাংলাদেশে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আগ্রহী চীন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ২০০ কেজি ওজনের বোমা পাওয়া গেল মুন্সীগঞ্জে, নিষ্ক্রিয় করল সিটিটিসি
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ ত্বরান্বিত করার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
আইইউবিএটি-তে চীনা ভাষা কোর্সের উদ্বোধন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা