সংকটে চামড়া খাত, পর্যাপ্ত জোগানেও বন্ধ হচ্ছে না আমদানি

​​​​​​​শাহনূর শাহীন, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৫ জুন ২০২৪, ০৮:১০| আপডেট : ১৫ জুন ২০২৪, ০৮:৪৭
অ- অ+

প্রতি বছর কোরবানির ঈদ সামনে এলেই আলোচনায় উঠে আসে চামড়া শিল্পখাতের সংকটগুলো। সম্প্রতি রপ্তানি আয়ের হিসাবে অবনতি হয়েছে দেশের একসময়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানির আয়ের খাতটি।

এই সংকটের পেছনে কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে আমদানি-রপ্তানিতে চামড়া শিল্পের মান নিয়ন্ত্রণকারী বৈশ্বিক সংস্থা ওয়ার্কিং লেদার গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকা।

বিডার তথ্যমতে, বৈশ্বিক চাহিদার ৩ শতাংশ চামড়া উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বৈশ্বিক মোট রপ্তানির মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। সংকটগুলো দূর করতে পারলে রপ্তানি খাতে এই শিল্পের ঘুর দাঁড়ানো সম্ভব।

এলডব্লিউজি সনদ না থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রক্রিয়াজাত (ফিনিশড) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়ে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশে^র দেশগুলো আন্তর্জাতিক এই সংস্থার সনদ না থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পণ্য কেনে না। ফলে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত কাঁচামালের জোগান থাকা সত্ত্বেও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির বড় বাজারগুলো ধরতে পারে না।

লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠানের। দেশে-বিদেশে মোট চাহিদার ফিনিশড চামড়া সরবরাহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে বিদেশ থেকে বছরে ৫ থেকে ১০ লাখ বর্গফুট ফিনিশড চামড়া (প্রক্রিয়াজাত সম্পন্ন) আমদানি করতে হয়। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে গিয়ে দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করতে পারছে না। বিদেশ থেকে ফিনিশড চামড়া আমদানি করে পণ্য উৎপাদন এবং তা রপ্তানি করতে হয় উন্নত বিশে^। এই টানাপোড়েনের কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে, তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য ৫০-৬০ শতাংশ কম দামে চীনের মতো দেশে পণ্য রপ্তানিতে বাধ্য হয়।

রপ্তানিকারকদের তথ্যমতে, চীন এলডব্লিউজি সনদ ছাড়া পণ্য আমদানি করে থাকে। এই সুযোগে তারা পশ্চিমা দেশের তুলনায় অনেক কম মূল্য দেয় পণ্যের। চীনের প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে। আমাদের পাশ^বর্তী দেশ ভারতেও এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে ১৩৯টি প্রতিষ্ঠানের।

আন্তর্জাতিক এই সনদ পেতে বাধা কোথায় কিংবা কেন বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এত কম? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এই মুহূর্তে এক ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার সক্ষমতা বা যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু দেশের ট্যানারি শিল্পের অব্যবস্থাপনা এই শিল্পের উন্নতির জন্য বড় বাধা হয়ে আছে।

বিডার গবেষণা প্রতিবেদন মতে, সাভারে স্থাপিত চামড়া শিল্পনগরীতে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) না থাকার কারণে ট্যানারিগুলো এলডব্লিউজি সনদের জন্য আবেদনই করতে পারছে না।

চামড়া শিল্পের উন্নতি ও বিকাশ এবং পরিবেশ দূষণ রোধ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চামড়াশিল্প নগরী গড়ে তোলে শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সেখানে স্থানান্তর করা হয় ‘ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্ট্রেট’ নামের এই নগরীতে। এখানে এখন বরাদ্দ পাওয়া ট্যানারির সংখ্যা ১৬২। এর মধ্যে বর্তমানে ১৪০টি ট্যানারি ওয়েট ব্লু, ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদন করছে।

স্থানান্তরের সাত বছরেও শেষ হয়নি পরিবেশ দূষণ বন্ধে কমন ক্রোম রিকভারি ইউনিট নির্মাণকাজ। আন্তর্জাতিক লেদার গ্রুপের শর্ত অনুযায়ী কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রিসোর্স জেনারেশনের ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। এমনকি কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের। ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র যেমন পাচ্ছে না, তেমনি এলডব্লিউজি সনদও পাচ্ছে না এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো এফ্লুয়েন্ট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম। নির্ধারিত এফ্লুয়েন্টের ডিসচার্জের সর্বোচ্চ সীমা অনুসারে প্রতিটি ট্যানারিতে পরিমিত পানির ব্যবহার ও উৎপাদন সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। এটা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি সাভারের শিল্পনগরীতে।

এফ্লুয়েন্ট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম হলো পরিবেশ সুরক্ষায় পিক ও অফ পিক মৌসুমে চামড়া ট্যানিংয়ের তুলনামূলক ব্যবধান।

বিডার গবেষণা প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ঈদুল আজহা পরবর্তী পিক সময়ে প্রথম তিন মাসে সারা বছরের মোট ব্যবহারের প্রায় অর্ধেক কাঁচা চামড়া ট্যানিং হয়। বাকি নয় মাসে অর্ধেক পরিমাণ চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ফলে পিক ও অফ পিক মৌসুমে এফ্লুয়েন্টের গড় পার্থক্য দৈনিক ৩৫ কোটি ১৭ হাজার ঘনমিটার। এই পার্থক্যের কারণে সিইটিপির ডিজাইনের ওপর চাপ পড়ে এবং ট্রিটমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়, যা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের শর্তানুযায়ী অনেক বেশি।

এ সমস্যা সমাধানে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কাঁচা চামড়া সংক্ষণের জন্য চিলিং ব্যবস্থা করা হলে পিক সময় তিন মাসের পরিবর্তে পাঁচ মাস হতে পারে। এতে প্রক্রিয়াকরণের সময় বৃদ্ধি পাবে এবং পিক সময়ে সিইটিপিতে আসা এফ্লুয়েন্টের পরিমাণ কমে আসবে বলে বিডার গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে সরকার এখন কী ভূমিকা পালন করছে- এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হয় শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সঙ্গে। কিন্তু একাধিকবার চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে মন্ত্রী বলেছেন, খুব শিগগির সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর সিইটিপি নির্মাণ সম্পন্ন হবে।

(ঢাকাটাইমস/১৫জুন/এসআইএস/মোআ/কেএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এপ্রিলের ২৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার
নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই সব দেনা পরিশোধ করল পেট্রোবাংলা
ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব: অর্থ উপদেষ্টা
উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময়, বিভিন্ন প্রস্তাব বাস্তবায়নের আশ্বাস
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা