কুমিল্লায় ঘর-বাড়ি হারিয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার পরিবার

‘পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি, এখন কিছুই তো নাই। সব পানি নিয়ে গেছে। কেবল আমরাই বেঁচে আসছি। কী কইমু, আমি তো একেবারে নিঃস্ব হইয়া গেছি। ঘর, জিনিসপত্র সব ভাসাইয়া নিছে পানি। ঘরে যা ছিল তা টানা ১১ দিনের পানিতে পচে গেছে। পানিতো কমে গেছে, কিন্তু আমার যে ক্ষতি অইল, তা তো কোনোভাবে পুষাবে না।’ এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন ভয়াবহ বন্যায় সহায়-সম্বল হারানো কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ইন্দ্রবতী গ্রামে ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাস।
বন্যায় ভেঙে গেছে তার মাটির ঘর। বানের তোড়ে আধাপাকা ঘর মিশে গেছে মাটিতে। ঘর বাড়ি হারা ধীরেন্দ্র দাসের এখন শেষ সম্বল খালি ভিটের উপর ঘরের শেষ স্মৃতি চিহ্ন।
ছেলের বউ আর দুই নাতনিকে নিয়ে ভিটের উপর দাঁড়িয়ে নতুন ঘর করার দুশ্চিন্তায় তিনি। ছেলে বিশ্বজিৎ বিদেশে থাকলেও সেখানে তিনি বেকার হওয়ায় পরিবারটির ঘর তৈরি করা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংকট।
একই অবস্থা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা রহিমা আক্তারের।
তিনি বলেন, ‘ডাকাতিয়া নদীর পানি নামায় আমাদের বাড়ির পানিও নামতে শুরু করছে। তাই আশ্রয় কেন্দ্র থেকে আজ ঘরে ফিরে গিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি দেখে আঁতকে উঠেছি। হাঁস, মুরগি আর একটা মাত্র গবাদি পশু ছিল। বন্যার পানিতে সব ভেসে গেছে। বাড়ির সামনে পুকুরের মাছ, রান্না করার চুলাও নেই। এতদিন তো মানুষ ত্রাণ দিয়েছে, এখন আমরা কীভাবে চলবো। জীবনের শেষ সম্বল টুকু হারিয়ে রাস্তায় বসা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।’
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) কুমিল্লা জেলার বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঘরবাড়ি ও স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে। আবার কিছু ঘরের চাল উড়ে গেছে। কিছু ঘরের টিন থাকলেও চারপাশের বেড়া-মাটির দেয়াল ধসে পড়েছে। পুকুর-মাছের ঘের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বের হয়ে গেছে চাষের মাছ। মরে গেছে কয়েকশ খামারের মুরগি। গোমতি চরের বাসিন্দারা বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে বড় সংকটে পড়েছেন। অনেক টিউবওয়েলই জোয়ারের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।
এক বেলা খাবে, সে পরিস্থিতিও নেই অনেকের। আবার কারও ঘর ও ঘরের জিনিসপত্র জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। প্রায় পরিবারেরই হাঁস-মুরগি মারা গেছে। ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে গ্রামের মেঠো পথ। এর ফলে মানুষের স্বাভাবিকভাবে চলাচলেও বাঁধা তৈরি হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে এখন নিঃস্ব হাজার হাজার পরিবার ।
এদিকে বুড়িচং, চৌদ্দগ্রাম, মনোহরগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব এলাকার শত শত ঘর বাড়ি, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট এখনো পানিতে নিমজ্জিত। আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে বন্যাকবলিত মানুষগুলোর।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বুরবুড়িয়ায় বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে এখনও পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। তবে প্রবাহের মাত্রা অনেকটা কমে আসছে। এর ফলে বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় ১৭টি উপজেলার মধ্যে বন্যা আক্রান্ত ১৪টি উপজেলার ১২৬টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাণিসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৮ কোটি টাকা, মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার, কৃষিখাতে ৮৪৮ কোটি টাকা। এছাড়া অবকাঠামো, সড়কসহ বিভিন্ন খাতে ১৪শ’ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৪ উপজেলায় ঘর- বাড়ি হারিয়েছে এক লাখ ১০ হাজার পরিবার, সবচেয়ে বেশি বুড়িচং উপজেলার ৪০ হাজার পরিবার ঘর বাড়ি হারিয়েছে।
জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা আবেদ আলী বলেন, জেলায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি ছিল। ৭ শ’ ২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসন থেকে ৩৯ লাখ নগদ টাকা ও ৮০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কুমিল্লা জেলায় ১৬শ’ টন চাল ও নগদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার ম. মুশফিকুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, আমরা আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি তাদের।
(ঢাকাটাইমস/০২আগস্ট/পিএস)

মন্তব্য করুন