শিবির নেতাদের সঙ্গে নিয়ে নয়াটোলা কামিল মাদরাসায় চাকরিচ্যুত শিক্ষক, যা ঘটল
প্রতারণার অভিযোগে দুই দফা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন নয়াটোলা আনোয়ারুল উলুম নোমানীয়া মডেল কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মুনির আহমেদ খান। অবৈধভাবে নিজের বেতন স্কেল বাড়িয়ে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এমনকি চাকরি নিতেও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেন এই শিক্ষক।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পৃথক নির্দেশনা ও পরামর্শে ২০১১ সালে চাকরিচ্যুত হন মুনির আহমেদ খান। এর সাত বছর আদালতের রায়ে চাকরিতে ফের এলেও ছিলেন অনুপস্থিত। এরপর দ্বিতীয় দফায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হন।
গত ৫ আগস্টে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে জোরপূর্বক মাদরাসায় ফেরার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ‘পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত হয়েছেন’— এই বিষয়টিকে সামনে রেখে মাদরাসায় ফিরতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে গত রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী এবং অন্যান্য বহিরাগতদের নিয়ে মাদরাসায় প্রবেশ করেন।
মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং উপস্থিত শিক্ষার্থীরা এসময় বাঁধা দিলে শিবিরনেতাদের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। এসময় স্থানীয়রাও হামলার শিকার হন। রবিবার সকালে রাজধানীর মগবাজারস্থ নয়াটোলা কামিলা মাদরাসা ক্যাম্পাসে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও শিক্ষার্থীরা জানান, এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় সরকারি কোনো নির্দেশনা ছাড়াই প্রতারণার দায়ে চাকরিচ্যুত মাদরাসা শিক্ষক মুনির আহমেদ খান মাদরাসায় প্রবেশ করে জোরপূর্বক পুনঃনিয়োগের জন্য অধ্যক্ষকে চাপ সৃষ্টি করেন। মাদরাসায় এলে আগে থেকে প্রস্তুত তার অনুগত বহিরাগত লোকজন ও স্থানীয় ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করেন। এসময় এলাকাবাসী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও মাদরাসার গভর্নিং বডির পক্ষ থেকে মুনির আহমেদ খানের কাছে বৈধ কাগজ দেখতে চাইলে সঙ্গে থাকা বহিরাগতরা মাদরাসার সাধারণ শিক্ষার্থী, উপস্থিত অভিভাবক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। হামলাকারীরা মাদরাসার বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে।
হাতিরঝিল থানা ছাত্রশিবির সভাপতি সাদ্দাম, হাতিরঝিল পূর্ব শাখা সভাপতি ফজলুর রহমান, স্থানীয় জামায়াতের সদস্য আমিরুল ইসলাম ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী মো. ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে হামলায় আরও অংশ নেন মাহমুদুল ইসলাম তামিম, আশরাফুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম, সাদিক মাহমুদ, নবীর হোসেন ও আমিরুল ইসলাম প্রমুখ।
অতর্কিত এই হামলায় সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ অন্তত ১১ জন আহত হন।
মুনির আহমেদ খানের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মাওলানা রেজাউল হক জানান, ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে কর্মস্থলে যোগদেন মাওলানা মুনির আহমেদ খান। যোগদানের পর এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেন। তার নিয়োগপত্রে সরকারি বেতন গ্রেড ছিলো ৩ হাজার ৮১৫ টাকা (১০ম গ্রেড)। কিন্তু তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার নির্ধারিত বেতন স্কেল থেকে কয়েক ধাপ ডিঙ্গিয়ে ৭, হাজার ২০০ টাকা (৬ষ্ঠ গ্রেড) স্কেলে বেতন উত্তোলন করার ব্যবস্থা করেন।
২০১১ সালে বিষয়টি নজরে আসে। পরে নির্ধারিত বেতনের চেয়ে অতিরিক্ত সরকারি অর্থ বেতন হিসেবে উত্তোলনের বিষয়ে গভর্নিং বডি তার কাছে সেসময় ব্যাখ্যা জানতে চায় এবং কারণ দর্শাতে বলে। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি এবং তিনি উত্তোলিত অতিরিক্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমাও দেননি। ঘটনা খতিয়ে দেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন এবং নিরীক্ষা অধিদপ্তর ও বিষয়টি তদন্ত করে প্রতারণার প্রাণ পায়। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মুনির আহমদ খানের এমপিও বাতিল করার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত শিক্ষা পরিচালনা সংস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে তার (মুনির আহমেদ) নিয়োগ বিধিসম্মতভাবে হয়নি বলেও মন্তব্য করা হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি কিছু জাল কাগজপত্রও ব্যবহার করেছেন বলে তদন্তে উঠে আসে। এ কারণে বেতন হিসেবে উত্তোলিত সমুদয় টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
অধ্যক্ষ মাওলানা রেজাউল হক জানান, এই প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর মাউশি এমপিও শীট থেকে মুনির আহমেদ খানের নাম কর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অধ্যক্ষ জানান, এরও আগে ২০১১ সালের ৩ জুলাই গর্ভর্নি বডির সভাপতি তাকে অবৈধভাবে উত্তোলিত সরকারি টাকা কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু তিনি তা জমা দেননি। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল ও ২১ জুনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির নির্দেশনা অনুযায়ী তাকে চাকরি হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
রেজাউল হক বলেন, চাকরিচ্যুতির প্রায় সাতবছর পর ২০১৮ সালের এপ্রিলে অসদোপায় অবলম্বনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে এলে আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে গভর্নিং বডি তাকে মাদরাসায় পুনঃনিয়োগ প্রদান করে। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ পূর্ব প্রতারণার বিষয়ে অবহিত থাকায় তদন্তপূর্বক আইন বিভাগের মতামত গ্রহণ করে এমপিও শীটে তার নাম পুনঃসংযোজন করা যাবে না মর্মে মতামত দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে।
অধ্যক্ষ জানান, পুনঃনিয়োগের পর পাঁচ মাস তিনি মাদরাসায় নিয়মিত ক্লাস করান। কিন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে বিনা অনুমতিতে মুনির আহমদ খান মাদরাসায় অনুপস্থিত থাকতে শুরু করেন। এ বিষয়ে ওই বছরের পহেলা ডিসেম্বর তাকে প্রথম শোকজ করা হয়। এরপর ১৫ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা শোকজ করা হয়। পরপর দুটি শোকজ করার পরও কোনো জবাব না পাওয়ায় নতুন বছরের ৫ জানুয়ারি গভর্নিং বডির সভায় মুহাদ্দিস মুনির আহমেদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং তৃতীয় শোকজ করা হয়। বিধি মোতাবেক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং ২৫ এপ্রিল তদন্ত কমিটির সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাকে পত্র প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তিনি তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হননি। এরপর ২৫ মে গভর্নিং বডির সভায় মুনির আহমেদকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হয় এবং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর ইআবি/প্রশ/কা.গ.র/৩১২১/২০১৩/১০০৯৮ স্মারকমূলে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মুনির আহমেদের চূড়ান্ত বরখাস্তের পূর্বানোমোদন করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে মাওলানা মুনির আহমেদ খানের সঙ্গে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম রবিবার বিকালে গণামধ্যমকে জানান, সন্ধ্যায় দুই পক্ষকে তিনি থানায় ডেকেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবেন। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিষয়টি তিনি অস্বীকার। তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বিষয়টির সুরাহা হয়নি এখনো।
রবিবারের ঘটনার বিষয়ে অধ্যক্ষ মাওলানা রেজাউল হক বলেন, ‘প্রতারণার দায়ে চাকরিচ্যুত মাদরাসা শিক্ষক মুনির আহমেদ খান চিহ্নিত সন্ত্রাসীবাহিনী এনে যেভাবে মাদরাসার সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্র অভিভাবকদের ওপর হামলা করে রক্তাক্ত করেছে তা দুঃখজনক। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। আমরা অবিলম্বে দায়ীদের শাস্তির দাবি করছি’।
বিষয়টি নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ‘মুনির আহমেদ খানের কর্মকাণ্ডের দায় জামায়াত ইসলামী নেবে না। এটি তার ব্যক্তিগত বিষয়।’
(ঢাকাটাইমস/৩০সেপ্টেম্বর/এসআইএস)