রাতের আঁধারে পদ্মায় বালু উত্তোলন, হুমকির মুখে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো
শরীয়তপুরের জাজিরায় রাতের আঁধারে পদ্মা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে হুমকির মুখে জাজিরা বেড়িবাঁধ, সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনা, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, ঘরবাড়ি। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শত শত ঘরবাড়ি, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা।
জানা যায়, দিনের বেলা ওই চক্রের ড্রেজারগুলো কুন্ডেরচর ইউনিয়নের বিভিন্ন খালের মুখে ভেড়ানো থাকে। রাত নামলে নদীতে এসে বালু উত্তোলন করে।
সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর, বাবুর চর, সিডারচর ও নড়ীয়া উপজেলার সুরেশ্বর পয়েন্টে রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন করছে বালু খেকোরা। রাত আটটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত একটানা ২০-২৫টি ড্রেজার দিয়ে উত্তোলিত বালু রাতেই বিক্রি করা হয়। রাতের আঁধারেই শত শত বলগেট নৌযান বালু ভর্তি করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একটা বলগেট ভরাট করতে একটি ড্রেজারের সর্বোচ্চ ২০-২৫ মিনিট সময় লাগে। প্রতি রাতে কোটি টাকার বালু উত্তোলন করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অনুসন্ধানে উঠে আসে সাত-আটজনের একটি বালু চক্রের নাম। এই চক্রের অন্যতম রফিক খাঁ। তার নেতৃত্বে চারটি, রিপন শেখের নেতৃত্বে চারটি, ফিরোজ খানের নেতৃত্বে তিনটি, লতিফ মল্লিকের নেতৃত্বে দুটি, খালেক মাদবরের নেতৃত্বে দুটি, বোরহান মল্লিকের নেতৃত্বে দুটি, সাহেদ মল্লিকের নেতৃত্বে দুটি ড্রেজার বালু তুলছে। এছাড়া নামে-বেনামে আরও বেশ কয়েকটি ড্রেজার দিয়ে প্রতিরাতে লাখ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হয় সেখান থেকে।
স্থানীয়রা জানান, গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের আগ একশ্রেণির বালু খেকো আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে নামে-বেনামে বালু উত্তোলন করত। সরকারের পটপরিবর্তনে সবাই ভেবেছিলেন এবার অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। হাত ঘুরে অন্য বালু খেকোরা বালু উত্তোলনে যুক্ত হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কথা বললে হুমকি-ধমকি ও মারধরের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অব্যাহত বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনের কবলে পড়েছে জাজিরা ও নড়িয়ার নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা। হুমকির মুখে জাজিরা বেড়িবাঁধ। স্কুল-কলেজ, মসজিদ, ঘরবাড়ি সহ সরকারি-বেসরকারি নানান স্থাপনা। এরমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শতশত ঘরবাড়ি, প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থাপনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুন্ডেরচর গ্রামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তলনের কারণে বর্ষা এলেই নদীর পাড়ে ভাঙন শুরু হয়। তখন আমাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী প্রভাব খাটিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করছে। ভয়ে সাধারণ লোকজন তাদের কিছু বলতে সাহস পায় না।’
বেশ কিছুদিন ধরে জাজিরার নদী ও কৃষিজমি থেকে অবাধে বালু তুলে কোটি টাকার ব্যবসা করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা- এমন অভিযোগ করে মানবাধিকারকর্মী এস এম রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘এর সঙ্গে জড়িত আছেন রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, অসাধু সরকারি কর্মচারীসহ অনেকে। প্রকাশ্যে উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্রি করা হচ্ছে বালু। তবুও প্রশাসন নিশ্চুপ।’
নদী থেকে বালু উত্তোলনকারীদের অন্যতম রফিক খাঁর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘নদীতে অনেক কিছুই ঘটে। সবকিছু লিখতে হয় না। আমি একা এই কাজ করি না, অনেকেই করে। এটা প্রশাসনও জানে। নিউজ করে কোনো লাভ নেই। এখানে প্রশাসন আসবে না।’
প্রশাসন কেন যাবে না জানতে মচাইলে রফিক খাঁ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আপনি কী নিউজ করবেন করেন, সমস্যা নাই। নদী ভাঙে না কী ভাঙে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না।’
নৌপুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু এলাকায় ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। দিনে অথবা রাতে কোনো সময়ই পদ্মা নদীতে যেন ড্রেজার থাকতে না পারে, আমরা সেই ব্যবস্থা করব।’
জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে এবং অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের তালিকা করে নিয়মিত মামলার আওতায় আনার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘খুব শিগগির বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত থাকবে।’
(ঢাকাটাইমস/১৭নভেম্বর/মোআ)মন্তব্য করুন