পাবনায় দেড় মাসে ৮ খুন, আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে উৎকণ্ঠা
হঠাৎ করেই খুনখারাপি বাড়ছে উত্তরের জেলা পাবনায়। গত দেড় মাসে জেলায় ৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি নভেম্বর মাসের ২৪ দিনেই ঘটে ছয়টি হত্যাকাণ্ড। তবে সম্প্রতি দুই দিনের ব্যবধানে ঘটেছে তিনটি হত্যার ঘটনা।
হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বেড়েছে ছিনতাই, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, লুটপাট, অপমৃত্যুসহ নানা অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতিতে জনমনে ভর করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ৫ আগস্টের পর পুলিশ এখনো পুরোদমে মাঠে সক্রিয় হতে না পারায় অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
জেলা পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ নভেম্বর সকালে বাড়ি থেকে নিজের মাছের খামারে যাওয়ার পথে খুন হন পাবনা সদর উপজেলা মৎসজীবী দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জালাল উদ্দিন (৪৫)। স্থানীয় বেতেপাড়া মোড়ে হেমায়েতপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদস্য মুন্তাজ আলী এবং তাদের লোকজন জালালকে কুপিয়ে হত্যা করে।
পরদিন ১৭ নভেম্বর রাতে পাবনা শহরে তুষার হোসেন (১৬) নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সে ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর স্কুলছাত্র সিয়াম হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিল।
তার পরদিন ১৮ নভেম্বর সকালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে ওয়ালিফ হোসেন মানিক (৩৫) নামের এক যুবলীগ কর্মীকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০২৩ সালের ১৭ জুন ছাত্রলীগ কর্মী তাফসির আহম্মেদ মনা হত্যা মামলার আসামি ছিলেন তিনি। জামিনে বের হয়ে প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারান মানিক।
সর্বশেষ ২৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তের হাতে খুন হন বাকুল মিয়া (৪৫)। চরমপন্থী জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনের ফিরেও শেষ রক্ষা হলো না তার।
এর আগে গত ৮ নভেম্বর সকালে আতাইকুলা থানার গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে আসিফ হোসেন (৩২) নামের মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের গলা কাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আগের দিন ৭ নভেম্বর রাতে এলাকায় একটি জলসা শুনে বাড়ি ফেরার পথে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।
আর অক্টোবর মাসে ঘটেছে চারটি হত্যাকাণ্ড। তবে দুটি মৃত্যু নিয়ে পুলিশ এখনো সন্দিহান এটি হত্যা নাকি অপমৃত্যু।
২৯ অক্টোবর বিকেলে নিখোঁজ হয়েছিলেন আতাইকুলার ভ্যানচালক রবিউল ইসলাম (৪৫)। চার দিন পর ১ নভেম্বর সকালে তার মরদেহ তৈলকুপি গ্রামের একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যার পর তার ভ্যানটি নিয়ে লাশ গুম করার জন্য পুকুরের পানিতে ফেলে দেয় বলে পুলিশের ধারণা।
এর আগে গত ১০ অক্টোবর সকালে ঈশ্বরদীতে লিচুবাগান থেকে নয়ন হোসেন (২৮) নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক ছিলেন। নয়নের মুখমণ্ডল ও গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় তাকে।
এসব হত্যাকাণ্ড ছাড়াও গত ৩০ অক্টোবর সুজানগরের নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাট এলাকার পদ্মা নদী থেকে মুকুল হোসেন (৪০) নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মুকুল হোসেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার এএসআই ছিলেন।
৩১ অক্টোবর সকালে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়ার সিংহনগর স্কুলের সামনে পদ্মা নদীর তীরে অজ্ঞাতনামা ১২ বছরের এক কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
পরদিন ১ নভেম্বর বিকেলে একই উপজেলার সাতবাড়িয়ার কাঞ্চন পার্কের সামনে ভাসমান অবস্থায় ২২ বছরের এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক বিরোধের বলি হেমায়েতপুরের জালাল উদ্দিনকে হারিয়ে দিশেহারা স্বজনরা। এ বিষয়ে নিহত জালালের স্ত্রী সালমা খাতুনের অভিযোগ, ‘স্থানীয় কবরস্থানের কমিটি গঠন নিয়ে জালালের ওপর ক্ষুব্ধ হয় মুন্তাজ ও তার লোকজন। কমিটিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রাধান্য দিয়ছিলেন জালাল, মুন্তাজের কথা শোনেননি। সেই ক্ষোভের আগুনে প্রাণ দিতে হলো তাকে। হত্যাকাণ্ডের পর মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জালালের ছেলে লাবু হোসেন। জতিদের ফাঁসির দাবি জানান তিনি।
কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে থাকতেন নিহত তুষারের মা তাসলিমা খাতুন। তাকে ফেরানোর চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি একমাত্র ছেলেকে। তিনি বলেন, ‘সিয়াম হত্যার সময় তার ছেলে তুষার বন্ধুদের সাথে গিয়েছিল। ওই সময় মারামারিতে রক্তাক্ত হয়েছিল তুষার। পুলিশ তাকে সেই অবস্থায় গ্রেপ্তার করায় হয়ে যায় এক নম্বর আসামি।’ কিন্তু তার ছেলে হত্যা করেনি বলে দাবি করেন তিনি।
তুষারের বোন আশা খাতুন বলেন, ‘আমার ভাই হত্যার সাথে জড়িত কি না, বা সে হত্যা করেছে তা প্রমাণ হবে আদালতে। আইনে তার বিচার হবে। তাই বলে তাকে হত্যা করবে! যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানাই।’
শুধু জালাল, তুষার বা মানিক-ই নয়। গত দেড় মাসে পাবনা জেলায় মোট হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আটটি। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে দুটি আর নভেম্বর মাসের প্রথম পনের দিনেই ঘটে ৫টি হত্যাকাণ্ড। এ ছাড়া ২৪ নভেম্বর আরও একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে।
এর মধ্যে একটি মৃত্যু মামলা নিয়ে সন্দিহান পুলিশ। হত্যা না অপমৃত্যু সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু অপমৃত্যু, ছিনতাই, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও সংঘর্ষের মতো নানা অপরাধমূলক ঘটনা। বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়র দৌরাত্ম্য ও মাদক ব্যবসা। এসব ঘটনায় উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় সাধারণ মানুষ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) পাবনার সভাপতি আব্দুল মতিন খান মনে করেন, ’৫ আগস্টের পর পুলিশ প্রশাসন এখনো মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। যখন অপরাধীর বিচার হবে না, তখন অন্য অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়। প্রশাসন এখনই লাগাম টেনে না ধরলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রেজিনূর রহমান বলেন, ‘অতীতের রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায় পাবনা জেলায় প্রতি মাসে সাধারণত ৪ থেকে ৫টি হত্যা মামলা হয়ে থাকে। চলতি নভেম্বর মাসে ৫টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৪টি হত্যা মামলা হয়েছে। আর একটি মৃত্যুর মামলা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে সেটি হত্যা নাকি অপমৃত্যু। সেটি সন্দেহজনক হিসেবে আছে। ইতিমধ্যে প্রায় সবগুলো মামলার রহস্য উদঘাটন হয়েছে এবং অনেক আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
আতঙ্কিত না হয়ে পুলিশের ওপর আস্থা রাখার পরামর্শ দিয়ে রেজিনূর রহমান আরও বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সংকট কাটিয়ে পুলিশ আরও বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মানুষের আস্থা হারানোর এখানেই কিছু নাই।'
জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে পাবনায় সাতটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৬০ জন। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১ জনকে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড পূর্ববিরোধ, রাজনৈতিক বিরোধ ও প্রতিশোধ পরায়ণতা থেকে ঘটেছে বলে জানায় পুলিশ।
(ঢাকাটাইমস/২৭নভেম্বর/মোআ)
মন্তব্য করুন