ঊর্মির জামিন: সরকারকে ধন্যবাদ

ড. আনোয়ার হোসেন
  প্রকাশিত : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৫| আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১৬
অ- অ+

জুলাই ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ জুড়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ছিল প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আন্দোলনটি এক পর্যায়ে কোটা ছাপিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্রদের আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। বিপুল গণঅভ্যুত্থানের ফলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। বিপুল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলেও অনেকে বিপ্লব বলছেন। বিপ্লব না হওয়ায় বৈপ্লবিক সরকারও গড়া হয়নি। বৈপ্লবিক সরকার না হওয়ায় সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাগণ সংবিধানকে ধারণ এবং রক্ষা করবেন বলে শপথ বাক্য পাঠ করেন। এক পর্যায়ে সাংবিধানিকভাবে এ সরকার বৈধ না অবৈধ, এ বিষয়ে দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা ও বিতর্ক হয়। অনেকে বলতে পারেন বিপ্লব হলে সংবিধানের প্রয়োজন নেই। আমিও তাই বলি। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিপ্লবী সরকার গড়তে পারলেন না কেন? কে নিষেধ করেছে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে। বাংলাদেশের কোথাও সাংবিধানিক সরকার হতে হবে এমন বিষয়ে মিছিল হতে তো দেখিনি বা শুনিনিও।

অন্যান্যের ন্যায় এ বিষয়ে সদ্য সাবেক লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (সাময়িক বরখাস্তকৃত) তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে সাংবিধানিকভাবে অবৈধ এবং আবু সাঈদকে নিয়েও মন্তব্য করেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত এবং খুলনা মেট্রোপলিটন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ২৮ নভেম্বর তাকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য সমন জারি করেন। অনেকে তিনি দেশ হতে পালিয়ে গেছেন বললেও এসব জল্পনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে তিনি ২৮ নভেম্বর সকাল ঠিক ১০টার সময় আদালতে উপস্থিত হন এবং প্রত্যাশিত জামিন লাভ করেন।

আজকের এই লেখনীতে আদালতের হস্তক্ষেপ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের শব্দচয়নের সঙ্গে মানুষ পরিচিত নয়। তাদের নিকট এটা অকল্পনীয় বিষয় আদালতে আবার হস্তক্ষেপ হয় কিভাবে? দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে অতীতের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো আদালতে হস্তক্ষেপ করেছে। মানুষকে ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত করেছে। বিচারের বাণী নীরবে কেঁদেছে।

আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের ভুলের কারণে অনেক সময় জনগণের নিকট সরকারের বিষয়ে ভুল বার্তা পৌঁছে। যেমন-ঢাকা মেট্রোপলিটন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের রেজিস্টার খাতায় লিপিবদ্ধ ছিল যে, বাংলাদেশ সরকার ঊর্মির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার জন্য পল্টন থানা, ঢাকাকে নির্র্দেশনা দিয়েছে, এ মর্মে আমার নিকট আদালতের রেজিস্টার খাতার ছবি রয়েছে। আমি নথি যাচাই করে দেখতে পেলাম, এটা একজন সহকারী শিক্ষিকার নামে শিশু আইনে মামলা। এসব ভুলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। বিচার বিভাগকে পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগ হতে আলাদা করা হলে এসব সমস্যা বহুলাংশে সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করি। তবে আমাদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি না হলে এ স্বপ্ন কখনো বাস্তবে পরিণত হবে না।

আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বলব, আমরাও বৈষম্যবিরোধী, প্রতিটি সুবিবেচক ব্যক্তি মানেই বৈষম্যবিরোধী। ঊর্মি ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। আপনারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রগণ বর্তমানে ক্ষমতায় আসীন। আমরা আজ যেমন নিপীড়িতদের পক্ষে কাজ করছি, কিছুদিন পূর্বে আপনারা নিপীড়িত ছিলেন। তখন আমাদেরকে আপনাদের পক্ষে পেয়েছেন। ভবিষ্যতে আপনারা অন্যায়ের শিকার হলে তখনও আমাদেরকে সহযোগী হিসেবে পাবেন। ঊর্মি কিছু কথা বলেছে। এ কথাগুলো বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে আলোচনায় স্থান পাচ্ছে। এক শ্রেণির অতি উৎসাহী তাকে যাচ্ছে তাই ভাষায় গালিগালাজ করছে। সে কিছু কথা বলার জন্য আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। যারা গালাগাল ও হুমকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না অর্থাৎ ‘জোর যার মুল্লুক তার।’ সরকারি কর্মচারী হলে তাকে গালাগাল দেওয়া যাবে? বর্তমানে বাংলাদেশে একশ্রেণির ব্যক্তি সকাল-বিকাল ফ্যাসিস্ট বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলছেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এরাই বড় ফ্যাসিস্ট। এরা যখন তখন হুমকি দিয়ে মব জাস্টিজের মাধ্যমে শিক্ষকসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মচারীদের নাজেহাল করছেন। ঊর্মি যে কটা কথা ফেসবুকে স্টাটাস হিসেবে দিয়েছে, অনেকেই সকাল-বিকাল প্রতিদিনই এসব কথা বলে থাকে। সে সরকারের কর্মচারী, তাই বলে তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মনে রাখতে হবে কারো হাতে একটা দা অথবা বঁটি আছে, সে একটি মাছ কাটবে। সে ইচ্ছে করলে মাছটিকে যেভাবে খুশি ওইভাবেই কাটতে পারে, কারণ তার ক্ষমতা আছে। কিন্তু মাছটিকে শালীনভাবে কাটাই ভদ্র, সুশিক্ষিত, দক্ষ মানুষের কাজ।

সরকারের অধীনস্থ কর্মচারী হওয়া মানেই সে সাধারণ মানুষ হতে তুলনামূলক সরকারের সন্নিকটে রয়েছে। তার বিষয়ে সরকার ইনসাফ কায়েম করাটাই সুবিবেচনাপ্রসূত হতে পারে। কারণ সে সরকারের নিজের লোক। যে ব্যক্তি কথা শুনতে চায় না, তাকে কাছে টানলে সে অবশ্যই কথা শুনবে। ভালোবেসেই মানুষকে কাছে টানা সম্ভব, যে ব্যক্তি যত বড় মনের মানুষ, সে তত বেশি ভালোবাসতে জানে। ভালো মানুষ হলে নিশ্চয়ই ভালোবাসার মূল্য দিবে একদিন। কাজেই বলপ্রয়োগ নয়।

অনেকে নিজেকে জাহির করার জন্য বলছেন, ঊর্র্মির জামিন হওয়া বাক স্বাধীনতার প্রমাণ। আমি যতটুকু জানি তার জামিন না হওয়ার জন্য বাদীপক্ষ কম চেষ্টা করেনি। এর অর্থ কি দাঁড়ায়? কয়েকটি বাক্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য তাকে জেলখানায় প্রেরণ করার চেষ্টা করতে হবে কেন? আমি তো মনে করি কিছু কথা বলার জন্য ফৌজদারি ধারায় মামলা হতে পারে না? এ ধরনের বিষয়ে জামিন-অজামিনের আলোচনা আসাই তো আদালতের সময় নষ্ট ব্যতীত আর কি হতে পারে। ঘুরেফিরে অনেকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবী তাই। সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় ইতিমধ্যে সে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান। একটা অভিযোগে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কয় জায়গায় বিচার হতে পারে। বাংলাদেশের আইন ও আদালতের এ বিষয়টি আমার মাথায় ধরছে না যে, একই বিষয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক জায়গায় বা আদালতে মামলা হলে সে কেন একাধিক জায়গায় হাজির হতে হবে। ঘটনা একটা হলে মামলা যত জায়গায় হোক না কেন ফলাফল একই হওয়াই স্বাভাবিক। সবকটি মামলার শুনানি এক জায়গায় হওয়াটাই সমীচীন নয়? আমি ঊর্মির ঢাকা এবং খুলনায় হওয়া মামলার দুটির এজাহার দেখেছি, একেবারে দাড়ি-কমাসহ একই অভিযোগ। একই বিষয়ে সে যদি খুলনায়ও হাজিরা দিতে হয়, এটা তার প্রতি অবিচার নয়? বাংলাদেশ সরকারের উচিত মামলার এই বিষয়গুলো একটা ফরমেটে নিয়ে আসা। যাতে বিচারটি এক জায়গায় হয়।

বাংলাদেশে আমাদের ছুরির উভয় পাশেই ধার। বাংলাদেশে অফিসপ্রধান ন্যায়পরায়ণ হলে অধীনস্থরা দুর্বলভাবে এবং অনিয়ম বেশি করে। আবার অফিসপ্রধান উল্টো পথের যাত্রী হলে অধীনস্থরা নিপীড়নের শিকার হয়। এখানে কর্মচারীরা দেদার অনিয়ম করে। যেমন আমার অধীনস্থদের বেলায় আমি দেখি যখন তখন একেকজন কথা নেই বার্তা নেই উধাও। কেউবা সকাল ৯টার সময় আমাকে ম্যাসেস দেয় স্যার আজকে ওমুকের সঙ্গে এই কাজ আছে, তাই অফিসে আসতে পারব না। একজন হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল। এক মাস পর আমাকে ম্যাসেস দিল স্যার আমি যোগদান করতে চাই। মনে হয় যেন আমি তাদের চাকরি করি। তারা যখন খুশি অফিস করবে, যখন খুশি অফিসে আসবে না। আরেকজন হঠাৎ খোঁজখবর নেই তিন মাস পর ই-মেইল করল তিনি দেখা করবেন। আজব যত কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের কর্মচারীদের। শত শত অনিয়ম থাকতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার পক্ষে বিপক্ষে কে কি লিখল এসব নিয়ে আমার মাথা ব্যথা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অনেকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রয়েছেন। বাংলাদেশের সরকারি দপ্তরসমূহে হাজারো অনিয়ম থাকলেও সরকার এসব আমলে না নিয়ে কে কোথায় ফেসবুকে কি লিখল ও ইউটিউবে কি বলল এসব দেখার সময় হয় কোথায় যা আমার বোধগম্য নয়।

এটাই স্বাভাবিক, ঊর্মিরা এ বয়সে উচ্চ শিক্ষার্থে উন্নত বিশ্বে যাবেন এবং ফেরত এসে দেশের জন্য অবদান রাখবেন। খুনি, দাগি আসামি, দুর্র্নীতিগ্রস্ত, জঙ্গি ও মাদকাসক্ত হলে ভিন্ন কথা। তা না হলে তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কি দরকার ছিল? বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। দেশটা যেন ঘটন-অঘটন পটীয়সী হয়ে উঠছে।

সদ্য সাবেক সরকারের সময় কিছু কথা ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য জামিন হয়নি। সরকারের হস্তক্ষেপে আদালত জামিন প্রদান করেননি। ঊর্মির বেলায় এমনটি না হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি সরকার অতীতের কর্তৃত্ববাদীদের পথ ধরবে না। আইন আইনের গতিতে চলুক। আদালত আদালতের গতিতে চলুক। সরকার সরকারের গতিতে চলুক। রাষ্ট্রের ৪টি স্তম্ভ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হোক। ঊর্মিরা মুক্ত আকাশে বিহঙ্গের মতো বিচরণ করুক। সে এবং তার পরিবার ভালো থাকুক। আর যেন কোনো দুশ্চিন্তায় না পড়ে তাদের পরিবার। আগামী দিনের পথচলা আরো সহজ হোক।

এবার আসছি মাদকমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রসঙ্গে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ায় ইমিগ্রেশন জটিলতার কারণে আমি সিংগাপুর এবং উজবেকিস্তানের আন্তর্জাতিক কর্মসূচি বাতিল করতে বাধ্য হই। ভিসাও ইতিমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। ইনশাআল্লাহ অচিরেই উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিস্তান এবং সিংগাপুরের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস কর্মসূচি-সিডিউল গণমাধ্যমে ঘোষণা করা হবে। কর্মসূচির সফলতার জন্য সবাই দোয়া করবেন।

লেখক: আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহলের প্রেসিডেন্ট

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত
সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সম্পাদক সুজন-অয়ন গ্রেপ্তার 
জনগণের ঐক্যই নতুন একটি গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাবে: জোনায়েদ সাকি 
খুলনায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হোয়াইট গ্রেপ্তার 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা