রোগ নিরাময়ের অব্যর্থ দাওয়াই ভেষজ খেজুরের গুড়
শীত মৌসুমে গুড়ের মিষ্টি গন্ধ আর স্বাদ গুড়প্রেমীদের মন কেড়ে নেয়। শীতকালে গুড়ের স্বাদ বাঙালির কাছে মধুর সমান। আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি হয় হরেক রকমের পিঠা ও পায়েস। গ্রামাঞ্চলে গাছীরা খেজুরের রস আহরণ শেষে হাঁড়িতে সংগৃহীত রস নিয়ে বড় চুলার কাছে ছুটে আসেন। এরপর টিনের বড় পাত্রে রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে শুরু হয় গুড় তৈরির প্রক্রিয়া। আস্তে আস্তে এসব রস শুকিয়ে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার ব্যাবধানে জ্বালানোর ফলে তৈরি হয় লাল গুড় ও পাটালি গুড়।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেজুরের গুড়ের ভূমিকা অনেক। যেহেতু এটা প্রাকৃতিক মিষ্টি তাই এর আছে নানা উপকারিতা। যারা অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়ায় ভোগেন তাদের জন্য আদর্শ গুড়। খাবার পরে একটুকরো গুড় খেলেই হজম নিমেষে হয়। গুড় কোষ্ঠকাঠিন্যও সারায় দ্রুত।
প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরের রসে প্রোটিনের পরিমাণ ১.০৮ গ্রাম, লিপিডের পরিমাণ ১.১৫ গ্রাম, ফাইবার ০.১৮ গ্রাম, অ্যাস ০.৪৬ গ্রাম, শর্করা ৮৫.৮৩ গ্রাম, রিডিউসিং সুগার ৩.৯৫ গ্রাম, ক্যালরি ৩৫৮ কিলোক্যালরি। এতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বিদ্যমান। ভিটামিন এ ৪১০ আইউ (ওট), থায়ামিন (ভিটামিন বি ১) ০.৫ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, রাইবোফ্লোবিন (ভিটামিন বি ২) ০.৬২ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, নিয়াসিন (ভিটামিন বি ৩) ১২.৩ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, প্যানটোথেনিক এসিড (ভিটামিন বি ৫) ০.১২৭ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, পাইরিডক্সিন (ভিটামিন বি ৬) ০.৪৫ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, এসকরবিক এসিড (ভিটামিন সি) ১২.৭৫ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম । এ ছাড়াও সামান্য পরিমাণে ফলিক এসিড (ভিটামিন বি ৯), সায়ানোকোবালঅ্যামিন (ভিটামিন বি ১২), কোলেক্যালসিফেরল (ভিটামিন ডি ২ ও ডি ৩), বায়োটিন (ভিটামিন এইচ) ও ফাইটোনাডিওন (ভিটামিন কে) রয়েছে যার পরিমাণ নির্ণয়যোগ্য মাত্রার নিচে।
ম্যাক্রো উপাদানের মধ্যে রয়েছে ক্যালসিয়াম ৪.৭৬ মিলি.গ্রাম/১০০ গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ২.২৩ মিলি.গ্রাম/১০০ গ্রাম, পটাশিয়াম ৮০ মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম, ফসফরাস ১৮০.৯ মিলি.গ্রাম/লিটার। এতে সোডিয়াম ১৮.২৩ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, কপার ২.১৩ মিলিগ্রাম/লি, জিংক ৭.২৩ মিলিগ্রাম/লি, আয়রন ১৫.৮ মিলিগ্রাম/লি।
সারা শীতে সুস্থ থাকতে চাইলে গুড় খেতেই হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রোজ খাবার শেষে একখণ্ড গুড় থাকলে সর্দি-কাশি-জ্বর পালাতে পথ পাবে না। শরীর গরম রাখবে। ফলে, রক্তসঞ্চালন দ্রুত হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে। জেনে নিন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেজুরের গুড়ের উপকারিতা-
রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়
গুড়ে থাকা আয়রন, জিঙ্ক, সেলেনিাম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস একযোগে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রক্তাল্পতায় ভুগছেন যারা তারা রোজ গুড় খান। অ্যানিমিয়া কমে হিমোগ্লোবিন বাড়বে ওষুধ ছাড়াই। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে গুড় খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি কমতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ কমায়
রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকলে প্রেসার এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই কাজটাই করে গুড়। তাই একটুকরো গুড় হাইপ্রেসারের রোগীদের জন্য খুবই ভালো। প্রেসার স্বাভাবিক গুড়ে
দ্রুত হজম
শেষপাতে গুড় মানেই দ্রুত হজম। শীতে অম্বল, বদহজম, গ্যাস থেকে মুক্তি পেতে চাইলে রোজ একটুকরো গুড় মাস্ট।
কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে
কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতেও সাহায্য করে গুড়। ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি পারগেটিভের কাজ করে।
লিভার সুস্থ রাখে
লিভার ভালো রাখতে সাহায্য করে গুড়। এর মধ্যে থাকা জিঙ্ক আর সেলেনিয়াম রক্তও পরিশ্রুত করে।তাই আয়ুর্বেদে গুড় দিয়ে কাঁচা হলুদ সকালে খালিপেটে খাওয়ার কথা বলা আছে।
ঠান্ডা কমাতে
সর্দি-কাশি-জ্বর কমাতে সিদ্ধহস্ত। ঈষদুষ্ণ জলে এক চা-চামচ গুড় মিশিয়ে খেলে সর্দি কমে ঝটপট। সর্দি-কাশি-জ্বর কমায় গুড়।
ফুসফুস পরিষ্কার করে
ফুসফুস পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে গুড়। যাঁরা অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়ায় ভোগেন তাঁদের জন্য আদর্শ গুড়।
বাতের ব্যাথা দূর করতে
শীতে বাতের ব্যথা বাড়ে। সাদা তিলের নাড়ু বানাতে পারেন গুড় দিয়ে। অল্প ঘি মাখিয়ে রোজ খেলে ব্যথা অনেকটাই কমবে।
ঋতুস্রাবের ব্যথা কমায়
ঋতুস্রাবের ব্যথা কমাতে তিল বীজের সঙ্গে এক চা-চামচ গুড় মিশিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন।
শরীরে হরমোনের সমতা বজায় রাখে
প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম বা পিএমএস সমস্যায় কমবেশি প্রায় সমস্ত মহিলারা ভোগেন। প্রতিদিন নিয়ম করে অল্প পরিমাণ গুড় খেলে শরীরে হরমোনের সমতা বজায় থাকে। এছাড়া গুড় আমাদের শরীরে হ্যাপি হরমোনের বৃদ্ধি ঘটায় ও হরমোনের সমতা বজায় রাখে।
গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে
আমাদের শরীরে কার্বোহাইডেড জাতীয় খাবার অথাৎ চিনি এনার্জি প্রদান করে। কিন্তু এই এনার্জি অনেক সময় আমাদের শরীরে রক্তে চিনির পরিমাণ বাড়িয়ে কিডনি, চোখ ও রক্তের চাপ বাড়িয়ে দেয়। গুড় খেলে এই সমস্যাটি কম হতে পারে। কারণ গুড় রক্তের সঙ্গে মিশতে কিছুটা সময় লাগে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হঠাৎ করে বেশি কমে বা বেড়ে যেতে পারেনা। ফলে আমাদের শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোর ক্ষতি কম হয়।
সাবধানতা
ডায়াবেটিসের রোগী ভুলেও গুড় খাবেন না। এতে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট থকে। তাই বেশি পরিমাণে খেলে ওবেসিটি বাড়বে।
আসল খেজুরের গুড় চিনবেন যেভাবে
খেজুরের গুড় কেনার সময় লক্ষ্য রাখা দরকার। কারণ খেজুরের গুড়ে থাকছে না রসের বিন্দুকণাও। চিনিতে আটা, হাইড্রোজ, ফিটকারি, সোডা, চুন, ডালডাসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রাতের আঁধারে তৈরি হচ্ছে নকল খেজুরের গুড়।
কেনার সময় একটু গুড় ভেঙে নিয়ে চেখে দেখুন। নোনতা স্বাদের হলে বুঝবেন এই গুড়ে ভেজাল রয়েছে। গুড়ের ধারটা দুই আঙুল দিয়ে চেপে দেখবেন। যদি নরম লাগে, বুঝবেন ভালোমানের আর ধার বেশি শক্ত হলে না কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সাধারণত গুড়ের রং গাঢ় বাদামি হয়। হলদেটে রঙের গুড় হলে বুঝতে হবে অতিরিক্ত রাসায়নিক মেশানো। কৃত্রিম চিনি মেশানো গুড় দেখতে খুব চকচকে হয়।
(ঢাকাটাইমস/১৯ নভেম্বর/আরজেড)
মন্তব্য করুন