ক্যানসার প্রতিরোধ করে ভেষজ চা, ওজনও কমায়
শীতের সকালে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক না দিলে, শহরের ঘুম ভাঙে না। সকালের দিকে শরীর সচেতনদের গলা ভেজে লিকার চায়ে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি, এই নিয়মেই চায়ের পাতা তুলে আমাদের অন্যতম পানীয়টি তৈরি হয়। প্রতিদিন সারা বিশ্বের ৩৭০ কোটি মানুষ কাপ চা পান করেন। দুধ কিংবা লিকার চায়ের পাশাপাশি ইদানীং অবশ্য ভেষজ চায়ের প্রতিও আসক্তি বাড়ছে। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। আবার স্বাদ বদলও হয়। সেই সঙ্গে সুস্থ থাকে শরীরও। কারণ ভেষজ চায়ের রয়েছে একাধিক গুণ।
শরীরকে ডিটক্স করতে এবং ওজন কমাতে ভেষজ চা একটি উৎকৃষ্ট পানীয়। ভেষজ চা শুধু শরীরকেই ভাল রাখে না, এই চা মানসিক প্রশান্তি দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে ভেষজ চা বিষণ্ণতা রোধ করে, ভাল ঘুম হতে সাহয্য করে, প্রদাহ কমায় এবং হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
ওজন কমাতেও ভেষজ চা খুবই কার্যকর। ভেষজ চা একটি লো-ক্যালরি পানীয়, যা আপনাকে পাতলা হতে সাহায্য করবে এবং এর স্থূলতা বিরোধী গুণাগুণ আপনার ক্ষুধা কমাবে এবং শরীরে নতুন ফ্যাট সেল উৎপাদন বন্ধ করবে।
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ে থাকা কিছু রাসায়নিক পদার্থ শরীরের চর্বি শোষণে বাঁধা দিতে পারে। তাই ওজন কমানোর কর্মসূচীতে দৈনিক চা রাখা উচিত সবারই। আবার যারা ওজন কমাতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তারা গ্রিন টি ছা়ড়া অন্য কিছু চেনেন না। আবার অনেকে এসব থেকে কয়েক কাঠি উপরে। ভেষজ চায়ে চুমুক দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন, অথচ কোন চায়ের কী গুণ, সেটা এখনও অনেকে জানেন না। শীতের মরসুমে ভেষজ চা প্রেমীরা জেনে নিন, কোন চায়ের কী গুণ।
গ্রিন টি
গ্রিন টি নিয়মিত পান করলে শুধু যে হার্ট ভাল থাকবে তাই নয়, তার সঙ্গে এর আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। ওবেসিটি কাটাতে এই চা দারুণ কাজ করে। তাই এই চায়ের অন্য নাম স্লিমিং টি। এই চা ফ্লাভোনয়েড, ক্যাথেচিন ও এপিগ্যালোক্যাথেচিন সমৃদ্ধ হওয়ায় তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আর এতে উপস্থিত পলিফেনলস নামক উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
দারুচিনি চা
টাইপ টু ডায়াবেটিস থাকলে শরীরে ইনসুলিন হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। তাই বেড়ে যায় রক্তের শর্করার মাত্রা। দারুচিনি চা ইনসুলিনের ক্ষরণ বাড়ায়। ফলে নিয়ন্ত্রণে থাকে ডায়াবেটিস। শরীর থেকে অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে চান? তা হলে এই পানীয়টি আপনাকে খেতেই হবে। একটি পাত্রে পানি গরম করে দারুচিনি গুঁড়া, লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে নিন। তার পর এই চা ছেঁকে খান। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, যা বিভিন্ন রোগ থেকে শরীরকে বাঁচাতে সহায়তা করে। ঋতুস্রাবের সময় পেটে ব্যথা হলে, তা থেকেও আরাম মিলবে এই চা খেলে।
পুদিনা চা
পুদিনা চা একটি সুগন্ধি চা যা অনেকের মতে গ্রিন টি’র চেয়েও বেশী উপকারি। এতে আছে অনেক কম ক্যালরি যা ওজন কমাতে সহায়ক। এছাড়া পুদিনা চা ক্ষুধা কমায়, খাবারের প্রতি তীব্র আকাঙ্খা দূর করে এবং হজমের উন্নয়ন করে। পানি গরম করে তাতে কুচি কুচি করে কয়েকটা পুদিনা পাতা কেটে মিনিট ১৫ ঢাকা দিয়ে রাখুন। পাতা কেটে দিলে পুদিনার গন্ধটা পুরোটাই পাবেন। নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ এড়াতেও খেতে পারেন পুদিনা চা। এই চা খেলে নিমেষেই দূর হয়ে যাবে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, একটানা কাজ করার জন্য মনোসংযোগ বাড়াতেও সহায়তা করে এই চা।
তুলসী চা
আয়ুর্বেদে তুলসীকে একটি ঔষধি গাছ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সবচেয়ে জেদি পেটের চর্বিও বেশিক্ষণ তুলসীর সামনে দাঁড়াতে পারবে না। একটি পাত্রে পানি গরম করে তাতে তুলসী পাতা ফুটিয়ে নিন। তার পর মধু ও লেবু মিশিয়ে নিলেই তৈরি তুলসী চা। লেবুতে থাকা ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে নিয়মিত তুলসী চা খান, এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
আদা-লেবু চা
সর্দি কাশি কমাতে অনেক চিকিৎসক আদা ও লেবু মিশিয়ে চা খাওয়ার কথা বলেন। তবে এই চা বদহজমও কমায়। একইসঙ্গে, তাড়াতাড়ি খাবার হজম করতে সাহায্য করে। আদা চা পরিপাকতন্ত্র ঠিক রেখে চটজলদি ওজন কমাতে বেশ কাজ দেয়।
হলুদ চা
হলুদ চা হলুদের মূল ও গুঁড়া থেকে তৈরি করা হয়। প্রদাহ কমাতে এটি কার্যকরী। হলুদ চা অটো ইমিউন রোগের লক্ষণ কমাতে সক্ষম। নিয়মিত এই চা পানে জয়েন্টের ব্যথা উপশম হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। হলুদ চা শরীরে মেদ জমতে দেয় না। খাবার হজম করতে সাহায্য করে। ওজন কমানোর যাবতীয় গুণ রয়েছে হলুদ চায়ে। এক চিমটি হলুদ গুঁড়া অথবা কাঁচা হলুদ বাটা, আদা কুচি অথবা আদা বাটা এক চিমটি নিন। একটি সসপ্যানে এক কাপ পানি নিয়ে চুলায় বসান, সেটা গরম হয়ে এলে তাতে এক চিমটে আদা বাটা এবং এক চিমটে হলুদ বা হলুদ বাটা দিন। পানি ফুটে এলে গ্যাস বন্ধ করে দিন। ঠান্ডা হতে দিন। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এলে। ছাঁকনি দিয়ে কাপে ছেঁকে নিন। তৈরি আপনার হলুদ দেওয়া চা।
চিনি ছাড়া রং চা
নানারকম বিশেষ চা যদি না খেতে পারেন, তাহলেও চিন্তা নেই। চিনি ছাড়া রং চা-ই খেতে পারেন নিয়মিত। এটিও আপনাকে দারুণ ফল দেবে। মেদ যতই হোক, চটজলদি ওজন কমাতে এই চা ভালো কাজ দেয়। সঙ্গে সারাদিনের কাজের ক্লান্তি তো দূর করবেই।
ওলং চা
ওলং চা একটি চাইনিজ ভেষজ চা। ওজন কমাতে বিশেষ কার্যকরী ওলং চা। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ওলং চা পান করলে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ক্ষুধা কমাতেও সাহায্য করে স্থূলতা কমাতে পারে এই চা।
সাদা চা
সাদা চা এটি শুধু নতুন চর্বি কোষ গঠনে বাঁধা দেয় না, কাজ করার জন্য শক্তিও উৎপাদন করতে নিঃসৃত চর্বি ব্যবহার করতে সহায়তা করে। এটি ত্বককে সূর্যের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে যা বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়ও কোষ ভেঙে যায়।
জবা ফুলের চা
জবা ফুলের নির্যাস দিয়েও তৈরি করা যায় বিশেষ ধরনের চা। এই চা নিয়মিত খেলে রক্তপ্রবাহ ভালো থাকে। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়াও এটি ফ্যাট কমায় ও লিভার ভালো রাখে।
গোলাপ ফুলের চা
গোলাপ ফুলের চায়ের মধ্যে রয়েছে পলিফেনল্স এবং ফ্ল্যাভোনয়েডসের মতো উপাদান। এই উপাদানগুলি আসলে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। যা শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যালের সমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। যা শরীরের কোষ নষ্ট হওয়া কিংবা প্রদাহজনিত সমস্যা রুখে দিতে পারে। গোলাপ ফুলের চায়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করতে সাহায্য করে। সংক্রমণজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও এই পানীয়ের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ওজন কমাতে চান, তারা গোলাপ চা খেলে ওজন কমাতে পারেন। গোলাপ চা ক্যাফেইনমুক্ত। তাই কফি বা চায়ের বিকল্প হিসেবে এটি খাওয়া যেতে পারে। এটি ক্ষুধানিবারক হিসেবে কাজ করে বলে ওজন বাড়ে না। তা ছাড়া শরীরে জমে থাকা ‘টক্সিন’ দূর করতেও এই গোলাপের চা খাওয়া ভাল। গোলাপের পাপড়ি শুকিয়ে তার সঙ্গে আরও বিভিন্ন রকম ভেষজ মিশিয়ে বিশেষ ধরণের এ চা তৈরি করা যেতে পারে। তবে বাড়িতে এ চা বানানোর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র গোলাপের পাপড়িই যথেষ্ট। একটি পাত্রে গরম পানি নিন। তারপর পানি ফুটে গেলে চুলার গ্যাস বন্ধ করে গোলাপের কিছু শুকনো পাপড়ি ছড়িয়ে দিন। এরপর পাত্রটি ঢেকে রেখে দিন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর পাপড়িগুলো ছেঁকে নিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন গোলাপ ফুলের চা।
(ঢাকাটাইমস/২৩ নভেম্বর/আরজেড)
মন্তব্য করুন