বিশ্বজিৎ হত্যা: আট ছাত্রলীগ কর্মীর ফাঁসির রায় আটকা চার বছর

মোসাদ্দেক বশির, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৬ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:০২

পাঁচ বছর আগে রাজধানীতে বিশ্বজিত দাস নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর ফাঁসির রায়ের ওপর আপিলের শুনানি হয়নি চার বছরেও। দণ্ড পাওয়া ২১ জনের মধ্যে ১২ জনকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় বিচারিক আদালতের রায় যখন উচ্চ আদালতে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তখন আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার শুনানি কবে হবে-এ নিয়ে ভুক্তভোগীর স্বজনদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে ছাত্রলীগের কর্মীদের কোপানোর ভিডিও ফুটেজ প্রচার হয়েছে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে। বিশ্বজিৎকে বিএনপি-জামায়াতের ‘বোমাবাজ’ কর্মী সন্দেহে তাকে ধাওয়া করে একটি মার্কেটের দোতলার বারান্দায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয় সেদিন। এই ধকল তিনি সহ্য করতে পারেননি। এক রিকশাচালক তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার আগেই পৃথিবী ছাড়েন তিনি।

এই হত্যার ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। চাপে পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। এই ঘটনার বিচার হবে কি হবে না-এ নিয়েও গণমাধ্যমে বহু লেখালেখি হয়। তবে এক বছরের মাথাতেই বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সাজা ঘোষণা করে।

হত্যার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই রাতেই সূত্রাপুর থানায় মামলা করে পুলিশ। পরদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। এরপর সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ জন কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। ওই বছরের ২৬ মে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষ বিশ্বজিতের বাবাসহ ৩৩ জনকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করে।

২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান বাকি ১৩ জন। এদের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গোলাম সরোয়ার পায়েল জানান, রায় ঘোষণার পর মামলাটির রায় ও নথিপত্রসহ হাইকোর্টে পাঠায়ে দেয় বিচারিক আদালত। আইন অনুযায়ী, বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা হাইকোর্ট থেকে অনুমোদন করে নিতে হয়। আসামিরা আপিল করতে চাইলে তাকে রায়ের অনুলিপি পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। আর যদি আসামি আপিল না করে তাহলে আদালতের পক্ষ থেকে একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হবে আসামির পক্ষে শুনানির জন্য।

এই আইনজীবী জানান, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকেই মামলার পেপার বুক প্রস্তুত করা হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি মামলাটি শুনানির জন্য একটি বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। তিনি জানান, হাইকোর্ট থেকেও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে তাদের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। আপিলেও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে তারা ওই রায় পুনর্বিবেচনা করে রিভিউ চাইতে পারেন। তাতেও বহাল থাকলে জেল কোর্ড অনুযায়ী রায়ের অনুলিপে পাওয়ার পর থেকে ২১ দিনের আগে নয় ও ২৮ দিনের পরে নয় সরকার ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। এরমধ্যে আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষাও চাইতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তাদের প্রার্থনা ফিরিয়ে দিলে সরকার তাদের ফাঁসি কার্যকর করবে।

বিচারিক আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স শুনানি হবে হবে- জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের ডেথ রেফারেন্স বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক অশোক পাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলাটির যাবতীয় নথিপত্র আমরা ঠিকঠাক করে দিয়েছি। বিজি প্রেসে মামলার প্রেপার বুক প্রস্তুতের কাজ চলছে। এ মাসের মধ্যেই আশা করি সেটি প্রস্তুত হয়ে যাবে। প্রস্তুত হয়ে গেলে প্রধান বিচারপতি শুনানির জন্য বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন।’

অশোক পাল এও বলেন, ‘প্রেসে পাঠিয়ে আমাদের অফিসার তাদের বলে দিয়েছেন এই মামলাটি দ্রুত প্রস্তুতের জন্য। তাই সেটি আর বেশি দেরি হবে না। আশা করছি চলতি মাসের মধ্যেই এই কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

যোগাযোগ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্টার সাব্বির ফয়েজের জবাবও ছিল একই রকম। তিনি বলেন, ‘মামলাটির প্রেপার বুক প্রস্তুতের কাজ চলছে। সেটি প্রস্তুত হলে শুনানির জন্য আসবে।’

যাদের সাজা, যারা পলাতক

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি হলেন- রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, জি এম রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, কাইয়ুম মিয়া, ইমদাদুল হক ওরফে এমদাদ, সাইফুল ইসলাম, রাজন তালুকদার ও নূরে আলম ওরফে লিমন। এদের মধ্যে রাজন তালুকদার ও নূরে আলম এখনও পলাতক। বাকিরা কারাগারে।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ জন হলেন: এ এইচ এম কিবরিয়া, গোলাম মোস্তফা, খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন। এঁদের মধ্যে এস এম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা কারাগারে আছেন। বাকি ১১ জনই পলাতক।

পলাতকদের কেন গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না- জানতে চাইলে রাজধানীর সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম আশরাফ উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসামিদের গ্রেপ্তারের পরোয়ানাটি পাঠানো হয়েছে তাদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায়। যে ঠিকানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা গেছে সংশ্লিষ্ট থানা তাদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেবে। আর মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন গোয়েন্দা শাখার। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের বলার কিছুই নেই।’

বিচার চলাকালে আদালতে যা উঠে এসেছে

বিচারের সময় সাক্ষীদের জবানবন্দিতে বলা হয়, অবরোধের ওই দিন বাহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে ছাত্রলীগের একটি মিছিল যাওয়ার সময় বোমা বিস্ফোরণ হলে সবাই যখন পালাচ্ছিল, তখন পলায়নরত বিশ্বজিৎকে মিছিল থেকে ধাওয়া করে তার ওপর হামলা চালানো হয়।

সাক্ষী রিকশাচালক রিপন রায় হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় বলেন, বোমার শব্দে এক ব্যক্তি (বিশ্বজিৎ) পার্কসংলগ্ন পেট্রোল পাম্পের দিকে দৌড় দেন। ওই মিছিল থেকে ধাওয়া করে কয়েকজন তাকে মারতে থাকে। বিশ্বজিৎ তখন মার খেতে খেতে পাশের ভবনে উঠে যান। লোকগুলো সেখানেও তাকে চাপাতিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তাকে মারতে থাকে। এরপর তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে নিচে নেমে শাঁখারীবাজারের গলির মুখে গিয়ে পড়ে যান। তিনি পানি চাইলে পাশের এক দোকানি পানি খাওয়ান। এরপর রিপনের রিকশায় মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্বজিৎকে, সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঘটনাস্থলে থাকা পরিবহনকর্মী ইউসুফ বেপারী ও আব্দুর রাজ্জাক আদালতে আসামি রফিকুল ইসলাম শাকিলকে সনাক্ত করে বলেন, তাকে চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিৎকে কোপাতে দেখেছেন তিনি।

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও

বিশ্বজিৎ হত্যার পর পরই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হত্যার কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১০ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও তিনজনের সনদ বাতিল করে।

বহিষ্কৃতরা হলেন- কাইয়ুম, রাজন, সাইফুল, শাওন, শাকিল, নুর আলম, ওবায়দুল, মশিউর রহমান, মামুন ও তাহসিন। আর সনদ বাতিল হয়েছে মাহফুজুর রহমান, ইমদাদুল ও কিবরিয়ার।

এ ব্যাপারে বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত দাশ ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিশ্বজিতের হত্যার রায় হয়েছে। কিন্তু সাথে সাথে কার্যকর হয়নি। হলে খুশি হতাম। তিনি বলেন, আসামিদের মধ্যে বাইরে যারা আছে (১৩জন) তাদেরকেও পুলিশ ধরতে পারেনি। রায় হয়েছে দুই বছর , আজও ফাঁসি কার্যকর হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, যারা বাইরে আছে, তাদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের রায় কার্যকর করা হোক। তাহলে বিশ্বজিত ও তার বাবার আত্মা শান্তি পাবে।

(ঢাকাটাইমস/২৬জানুয়ারি/এমএবি/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :