সেই সময় এই সময়-২

সবটুকুই সত্য

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ১৬:৫৭ | প্রকাশিত : ২১ জুন ২০১৭, ১০:১৫

একরামুল হক বুলবুলকে প্রথমে পাশে বসিয়ে লিখতে বসে গেলাম। পরে তাকে বললাম গল্প-গুজব করে যেন কনস্টেবল আর স্টেনোগ্রাফারকে একটু মাতিয়ে রাখে। আমি লেখা শেষ হলেই ডাকব। হাত খুলে লিখলাম। সম্ভবত ছয় পাতা। ফ্যাক্স লাইন পাওয়া নিয়ে মহা বিড়ম্বনা। কখনো লাইন ব্যস্ত, আবার কখনো লাইন পেতে পেতে কেটে যাচ্ছে। পুলিশ সুপার অফিসের লোকজন কিঞ্চিত বিরক্ত হচ্ছে, মুখচ্ছবি অন্তত তাই বলে। জানিয়ে দিলাম বখশিসের ব্যবস্থা আছে। উৎসাহ পেল তারা। অবশেষে ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর কাক্সিক্ষত লাইন পাওয়া গেল। বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, নগর সম্পাদক সানাউল্লাহ লাবলু ভাই নিশ্চিত করলেন যে কপি পাওয়া গেছে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সঙ্গী একরামুল হক বুলবুল নোয়াখালী অঞ্চলেরই ছেলে। তাঁকে বললাম, এই রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পরে তো আমাদের খোঁজাখুজি শুরু হয়ে যাবে। আমরা থাকব কোথায়? ইতিউতি তাকিয়ে কোনো যুতসই জবাব দিতে পারলেন না। বললাম, এক কাজ করি ফেনী থাকার ব্যবস্থা করার জন্য প্রতিনিধি আবু তাহেরকে ফোন করি। প্রস্তাব পছন্দ হলো সহকর্মী বুলবুলের। পুলিশ সুপারের অফিসের ফোনে মেলালাম ফেনীর তাহের ভাইকে। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি রওনা দেন। পরে আর বাসও পাবেন না। হঠাৎ বুলবুল বললেন, তিনি থেকে যেতে চান। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে পরের দিন ফিরবেন। আমার পছন্দ হলো প্রস্তাবটি।

ওই সময় লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন মাহবুব আলম। প্রশাসনের ’৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা। মুক্তিযোদ্ধা। ভালো মানুষ হিসেবে পরবর্তী সময়ে মাহবুব ভাইকে নানাভাবে পেয়েছি। লক্ষ্মীপুরের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসানের জন্য একরকম মুখিয়েই ছিলেন মাহবুব ভাই। চাচ্ছিলেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরুক। তাহের বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন বন্ধ হোক। কিন্তু শক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নিতে পারছিলেন না। খানিকটা সিদ্ধান্তহীনতা, খানিকটা চাকরির ভীতি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব চাইছেন, একটা বিহিত হোক। তাঁর কাছেই আমরা জানতে পারি কীভাবে অপহৃত হওয়ার পরে টুকরো টুকরো করে মেঘনা নদীতে নুরুল ইসলামের লাশ ফেলে দেওয়া হয়। আবু তাহের তখন ঢাকায়। এসব দুর্বৃত্তপনার নেতৃত্ব দেন তাহেরপুত্র বিপ্লব। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে বিপ্লব কথা দিয়েছিল আইনজীবী নুরুল ইসলামকে ফেরত দেবে তারা। কিন্তু কথা রাখেনি। জেলা প্রশাসক সব জানান আমাদের। কথা বলতে বলতে তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। জেলা প্রশাসকের মুখে সব শুনে আমরা বিস্মিত হই। প্রশাসন সব জানে! সব খবর আছে তবু কিছু হচ্ছে না! তবে প্রশাসনের কাছ থেকে নিশ্চিত এসব খবর পেয়ে আমাদের অনেক সুবিধা হয়। বাকিটা কেবল ঘুরে ঘুরে দেখা আর ভুক্তভোগীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনা।

ফেনীর তাহের ভাই আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের আধা পরিত্যক্ত একটি ভবনে। ফেনীতেও তখন সংবাদকর্মীদের চোখে চোখে রাখা হয়- সর্বত্রই জয়নাল হাজারীর ক্যাডারদের দাপট। কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক নেতা তাহের ভাই অসাধারণ ভালো মানুষ। প্রবীণ তাহের ভাইয়ের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নাতীত। তাহের ভাইয়ের সাথে লক্ষ্মীপুরের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললাম। সব জেনে বললেন, ‘আপনি একা একা ফেনী থেকে আবার লক্ষ্মীপুর যাবেন, ঠিক হবে না। সঙ্গে আমরাও যাব।’ পরদিন তাহের ভাই, বখতিয়ার ইসলাম মুন্না, ইউএনবির প্রতিনিধি টিপু সুলতানসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে আমরা লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। আগের দিন ফ্যাক্সযোগে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম ঢাকায়, পরের দিন সেটি ছাপা হয়নি। ফোনে যেটি জানলাম- দুই কারণ। এক. রিপোর্ট একটু দেরিতে গেছে। দুই. এটা খুব ভালোভাবে প্রকাশের জন্য একটা দিন দেরি করতে বলেছেন সম্পাদক। ছাপা হওয়ার আগেই নাকি রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে অফিসে।

যা হোক, এক দিন বিরতি দিয়ে ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ‘প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় প্রকাশ হয় ‘ভয়াবহ আতঙ্কের শহর লক্ষ্মীপুর’। এটি ছিল লিড নিউজ। চারদিকে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এত দিন কেউই মুখ খুলছিল না। পারছিল না-ও বলা যায়। ‘প্রথম আলো’র একটি খবর সব বাধা ভেঙে দিল মনে হয়। খোদ সদর আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট খায়রুল এনাম স্বেচ্ছায় এলাকাছাড়া হয়ে ছিলেন। অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তখন বিরোধীদলীয় উপনেতা। ‘প্রথম আলো’তে খবর প্রকাশের কয়েক দিনের মাথায় তাঁর নেতৃত্বে ৪০ জনের বেশি সাংসদ এলেন লক্ষ্মীপুরে। তখন হাতেগোনা টেলিভিশন, বিটিভি, একুশে টিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই। যেসব নেতা লক্ষ্মীপুর আসার কথা চিন্তাও করতেন না, টেলিভিশন ক্যামেরা দেখার পর ছবি তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হলো রীতিমতো তাদের মধ্যে। এখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মর্যাদার এক নেতা তো বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার ছবি ঠিকমতো উঠছে না আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় এই কারণে ধাক্কা দিয়ে আমায় ফেলেই দিলেন। আমি তো হতভম্ব। ‘প্রথমে আলো’তে আমার পাঠানো রিপোর্ট প্রকাশ না হলে, সারা দেশে আলোচনার ঝড় না তুললে যেসব নেতা আসতেই পারতেন না, সেই পরিস্থিতিই তৈরি হতো না, সেই আমাকেই কিনা মাটিতে পড়তে হলো ধাক্কা খেয়ে! দুবার সাংসদ হয়েছেন এমন এক তরুণ নেতা লক্ষ্মীপুর সার্কিট হাউজের সামনের প্রধান সড়কে আমাকে মাটি থেকে তুলে ওঠালেন। ওই নেতাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন। বললেনও, ‘লক্ষ্মীপুর তো আসতেই পারতেন না। যার কারণে আজ আসার পরিস্থিতি তাকে হেনস্তা করলেন! কাজটা ভালো হলো না।’ ওই নেতা পরে দুঃখ প্রকাশও করলেন।

[তৃতীয় পর্বের জন্য চোখ রাখুন ঢাকাটাইমসে]

সেই সময় এই সময়-১

লেখক: সম্পাদক, ঢাকাটাইমস ও সাপ্তাহিক এই সময়

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা