প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে আর্টিজান হামলার ভয়াল রাত

প্রবীর বড়ুয়া চৌধুরী
| আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৭, ১৩:১৩ | প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০১৭, ০৮:৫৪

এক বছর আগের পহেলা জুলাইকে বাংলাদেশের জন্য একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনিই বলা চলে। আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার সেই রাতের পর কেটে গেছে এক বছর, কিন্তু ওই হামলার ভয়াবহতা মনে করে আজও গা শিউরে ওঠে। আর ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন সমাজ, রাজনীতি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের ভেতর পড়েছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার ঘটনায় সেদিন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও চরম বিস্ময়কর ছিল। মানসিকভাবে অনেকটাই অপ্রস্তুত ছিল ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রায় সব সাংবাদিক। সেদিন হলি আর্টিজানের আশপাশে সমবেত সাংবাদিকরা খবরাখবর সংগ্রহ করছিলেন ঠিকই, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের মতো তারাও দুশ্চিন্তায় ছিলেন এই ভেবে যে ঘটনার পরিসমাপ্তি কী হয়।

আমার নাতিদীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে এমন কিছু ঘটনা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি, যা যেকোনো পর্যায়ের সাংবাদিকের জন্য দুর্লভ অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা, ২০১৩ সালের ৫-৬ মে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সমাবেশ ও এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে, এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে পহেলা জুলাইয়ে গুলশান হামলার ঘটনা অন্য যেকোনো কিছু থেকে অনেক বেশি সংবেদনশীল ছিল।

হলি আর্টিজান হামলার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সেদিন আমিও এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে গিয়েছিলাম। এ লেখায় সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতির কিছু কিছু তুলে আনব।

দিনটি ছিল শুক্রবার। গণমাধ্যমের জন্য ‘ডাল ডে’, অর্থাৎ সংবাদ-খরা দিন। সেদিন উল্লেখযোগ্য সংবাদ বলতে, সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আন্দোলনের খবর। তখনো আমরা সংবাদকর্মীরা জানতাম না দিনের শেষ সময়টি আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।

ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে নয়টার মতো। আমি আমার তখনকার কর্মস্থল ‘দ্য ডেইলি স্টার’ অফিসের নিচে নামতেই সিনিয়র একজন ফটোগ্রাফার বললেন, গুলশানের কোনো এক হাসপাতালে অথবা রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। প্রথমে গুলশানের কয়েকটি জায়গায় ফোন করে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউ কোনো সঠিত তথ্য দিতে পারল না। শুধু একজন জানাল ৭৯ নম্বর সড়ক বা ইউনাইটেড হাসপাতালের আশপাশে কোথাও সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। তবে হামলাটি যে জঙ্গিরা করেছে, তখনো আমরা কেউ বুঝতে পারেনি। এমনও শোনা যায় হামলাটি চাঁদাবাজির টাকা আদায় করার জন্য সংঘটিত হয়।

আমি অতটা গুরুত্ব না দিয়ে বাসার পথে রওনা হই। কিন্তু পথিমধ্যে বিভিন্ন জনের ফোন পেয়ে ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পারি। এর মধ্যে জানতে পারি হামলাকারীরা ক্যাফেতে প্রবেশের সময় বিভিন্ন জিহাদি স্লোগান দেয়। আর তা শুনে ঘটনাটি সম্পর্কে মুহূর্তে একটা ধারণা পেয়ে যাই। তাই দ্রুত বাসায় গিয়ে মোবাইল চার্জার সঙ্গে নিয়ে ছুটি গুলশানের দিকে।

বনানীর কাকলী মোড়ে পৌঁছতেই দেখলাম পুলিশ গুলশানের দিকের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। ওই সড়কে চলাচল শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে আর সামান্য কিছূটা রিকশা দিয়ে যখন গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তখন ঘড়িতে রাত ১১টা ছুঁই ছুঁই। রাস্তাটি আমার ভালোই চেনা, কারণ সংবাদ সংগ্রহের জন্য এই এলাকায় বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ বেশ কিছু রাজনীতিবিদের বাস ও দূতাবাসে প্রায়ই যেতে হতো।

হেঁটে এগুতে গিয়ে পুলিশ-র‌্যাবের সমাগম দেখতে পেলাম রাশিয়ান দূতাবাসের সামনে। ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি সংবাদকর্মীরা জড়ো হয়ে গেছেন গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেটি ঘিরে। কিছুদূর যেতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার কারণে আর এগোনোর সুযোগ পেলাম না। রাস্তার দুই পাশে জিম্মিদের উদ্বিগ্ন আত্মীয়-স্বজনদের পায়চারী। আমরা সংবাদকর্মীরা সবাই সর্বশেষ অবস্থা যার যার অফিসকে জানাতে ব্যস্ত। কিন্তু অজানা উৎকণ্ঠা কম-বেশি সবার মধ্যেই ছিল। সংবাদকর্মীদের ধর্ম বুঝি এটাই, সব দুশ্চিন্তা ও বিপদের মধ্যে ধীরস্থিরভাবে তাদের কাজটা করে যেতে হয়।

সড়কের পাশেই সাদা পোশাকে আহত কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখলাম। আলাপের শুরুতেই নাম প্রকাশে অপারগতা জানান তারা। তবে পরে আশ্বস্ত হয়ে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনায় জানান, তারা কোনো এক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার দেহরক্ষী। জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে হামলার মুখে পড়া আহত পুলিশ অফিসারকে নিরাপদে সরিয়ে আনতে গেলে, তারা আহত হন।

তাদের কাছ থেকেই জানতে পারি, হামলার খবর পেয়ে পুলিশ সদস্যরা তৎক্ষণাৎ ওই ক্যাফেতে যায়। কিন্তু, এর প্রাঙ্গণে প্রবেশের সাথে সাথে ভেতর থেকে গুলি চালায় ও বোমা সদৃশ কিছু ছুড়ে মারে জঙ্গিরা। আর তাতে আহত হন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তাদের বর্ণনায় বুঝতে পারলাম ঘটনার ভয়াবহতা কতটুকু। বক্তব্যটি নিউজ রুমে জানিয়ে দিলাম খুব দ্রুত। তবে বলে রাখা ভালো, এই সব ঘটনার সময় বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ আসতে থাকে, কিন্তু এই পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের সৃষ্টি হয়নি।

পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় জানতে পারলাম ইউনাইটেড হাসপাতালে বেশ কয়েকজন গুরুর আহত ভর্তি রয়েছেন। ততক্ষণে অবশ্য জানা হয়ে গেছে দু-একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার মারা গেছেন। কিন্তু খবরের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। দায়িত্বশীল কেউ কোনো মন্তব্য করছিল না। ঘটনাস্থলে উপস্থিত অন্যান্য সহকর্মী জানালেন, একজন নিহত হবার খবরে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যম বলছে, পুলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মারা গেছেন। তাই দেরি না করে, সঠিক খবরের জন্য কুড়ি মিনিট দূরত্বের ইউনাইটেড হাসপাতালে চলে গেলাম। সামনে যেতেই পুলিশের বাধা।

অনেকক্ষণ প্রতীক্ষার পর রাত দেড়টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিবির) ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল হক হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসেন। যথারীতি অপারগতা প্রকাশ করেন কিছু বলতে। তবে গণমাধ্যম কর্মীদের অনুরোধে তিনি জানালেন, ডিবির সহকারী কমিশানর রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন নিহত ও আরো কুড়ি জনের মতো পুলিশ সদস্য আহত। তবে, ক্যাফের ভেতরে কী হচ্ছে তখনও অজানা সকলের কাছে। শেখ নাজমুল হকের বরাত দিয়েই নিউজরুমে হতাহতের সংখ্যা জানিয়ে দেই।

হাসপাতালের সামনে থেকে এরপর জিম্মিদের মা-বাবা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চলে গেলাম। এ সময় অন রেকর্ড কেউ কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তাই আমি আমার মোবাইল-রেকর্ডার, প্যাড-কলমসহ তথ্য সংগ্রহের যাবতীয় উপকরণ আড়াল করে তাদের ভয়মুক্ত করার চেষ্টা করলাম। জিম্মীদের স্বজনদের মাঝে যে আতঙ্ক দেখেছিলাম, এরপর তাদের সামনে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতেও খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিরুপায় ছিলাম। কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, কিভাবে নিঃশব্দে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তারা মধ্যে দু-একজন জানালেন ঘটনার প্রথম দিকে খুদে বার্তার মাধ্যমে তাদের জিম্মি স্বজনরা জানিয়েছেন, জঙ্গিরা ক্যাফেতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। কিন্তু ওই যোগাযোগ বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না। রাত তিনটার দিকে ৭৯ নং সড়কের পুলিশের শেষ ব্যারিকেডে এর সামনে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর দেখলাম একজন বিদেশীকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। আমরা কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যর্থ হলাম। পরবর্তীতে পুলিশের একজন কর্মকর্তা মাধ্যমে জানতে পারলাম ওই ব্যক্তি ক্যাফের ইটালিয়ান শেফ, যিনি ঘটনার শুরুর দিকে অনেক কষ্টে পালিয়ে যান।

রাত ৩.৫০ এর দিকে দুটি গুলির শব্দ শুনতে পাই ক্যাফের দিক থেকে। এর কিছুক্ষণ পর দেখলাম আহত এক যুবককে গাড়িতে তুলছে পুলিশ। তার পরিচয় জানতে চাইলে পুলিশ শুধু বলল- সন্দেহভাজন।

ওই সময়ের একটু পর শুনতে পেলাম একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল লিখেছে জঙ্গিরা বলেছে, তাদের এক নেতাকে মুক্তি দিলে জিম্মিদের ছেড়ে দেবে তারা। কিন্তু আমিসহ কয়েকজন এই খবরের সাথে একমত হতে পারিনি কারণ এই জঙ্গিদের যে ধরনের আচরণ ও উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে জিম্মিদের বিনিময়ে কারো মুক্তি চাইবার সম্ভাবনা কম। পরে ওই খবরের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

আরেকটি বিষয়ে নিয়ে আমার মনে কিছুটা প্রশ্ন উঠেছে, তা হলো রাত জুড়ে কিছু সংবাদমাধ্যম উদ্ধার প্রক্রিয়া ও অভিযান সম্পর্কে আগাম কিছু সংবাদ দিয়েছে। এ ধরনের সংবাদ কতটুকু যৌক্তিক তা ভাবনার দাবি রাখে। কারণ জঙ্গিরাও ওই সব সংবাদ পর্যবেক্ষণ করেছে। এই বিষয়গুলোতে গণমাধ্যম কীভাবে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে এর সংশ্লিষ্টরা ভাববেন বলে আমার বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে বলতে পারি সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সে, জার্মানি ও লন্ডনে হামলার পর খবর প্রকাশে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অনেক বেশি সাবধান ছিল। যা আমাদের গনমাধ্যমের জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে। ভোর চারটা ১০ মিনিটের দিকে পুরো সড়কটি ফাঁকা করে দেয়া হয়। আমাদের পরবর্তী অবস্থান হয় ৮০ নং সড়কের সামনে। সকাল ৫টায় জানতে পারলাম আর্মির কমান্ডো, সোয়াত, পুলিশ, বিজিবি ভোরের দিকে ক্যাফে মুক্ত করতে অভিযান চালাবে।

কিন্তু সময় গড়িয়ে যায়। সারা রাত থেমে থেমে বৃষ্টি। সবাই ভিজছে। কম-বেশি সবাই ক্ষুধার্ত। আশপাশে কোথাও খাবার পানিও নেই। সবাই বাসার দরজা বন্ধ করে রেখেছে। এভাবেই কাটল আরও দুই ঘণ্টা।

আলো ফুটতেই আরো কিছু স্বজন এল। তাদের একজন গোপাল, জানালেন- তার বড় ভাই শিশির বাড়ৈ ক্যাফের কিচেন স্টাফ এবং তাদের ১২ বৎসরের এক ভাগিনাসহ ক্যাফের বাথরুমে লুকিয়ে আছে।

গোপাল জানান, তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে ঘটনার পর রাত সাড়ে নয়টা সকাল ৬টা ২২ মিনিট পর্যন্ত মোবাইলে টেক্সট আদান-প্রদান করে। আমরা দু-তিনজন সাংবাদিক টেক্সটগুলো লিখি এবং আমি আমার অনলাইন ডেস্কে দিয়ে দিই। The Dialy Star অনলাইনে দুই ভাইয়ের এই টেক্সট ছাপানোর পরে Asian News Network (ANN), Dwan সংবাদটি প্রকাশ করে।

সকাল ৭.৩০, আমাদের দিক থেকে প্রথম নজরে এল আর্মির সাঁজোয়া যান। ঠিক তার দশ মিনিট পরে ৭.৪০ কমান্ডোরা গুলি করতে করতে ক্যাফেতে প্রবেশ করতে থাকেন। এই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল অপারেশান ‘থান্ডার বোল্ট’। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, আমরা জানতাম অভিযান অবধারিত। তাই আমি আগে থেকে আমার ঘড়ির সময়টি সেকেন্ডসহ আপডেট করি। আর অফিসের অনলাইন ডেস্কে ফোন করে অভিযানের আগাম আভাস দিয়ে রাখি। ফলে তারাও যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।

প্রথম বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আমি তা ডেস্ককে জানালে ব্রেকিং দেয়া হয়। আইএসপিআর পরবর্তী সময়ে সংবাদ সম্মেলনে অভিযানের যে টাইমলাইন দেয়, তার পুরোটাই মিল ছিল আমার সংবাদের সঙ্গে।

অভিযানের শুরু থেকেই বিস্ফোরণের বিকট শব্দ আর গুলির শব্দের সঙ্গে কমান্ডোদের চিৎকারে এলাকাটি প্রকম্পিত হতে থাকে। অভিযান শুরু হলে আমি ৮০ নং সড়কের শেষ মাথায় লেকের পাড়ে চলে যাই, যা ঘটনাস্থল থেকে এক-দুই মিনিটের দূরত্বে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও পুলিশের বাধা, আর মাঝখানে আরেকটি বাড়ি থাকার কারণে অভিযান সরাসরি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু প্রায় প্রতিটি শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

সকাল সাতটা ৪৮ মিনিটের দিকে গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ তীব্র আকার নেয় এবং সাতটা ৫৫ মিনিটের দিকে কিছুটা কমে আসে। ওই রকম একটি বিপজ্জনক মুহূর্তে পুলিশের মাঝখানে বসে আমি প্রতিটা বিষয় মিনিটসহ লিখে রাখি। পরবর্তীতে অনেক গণমাধ্যম কর্মী আমার কাছ থেকে ঘটনার টাইম লাইন সংগ্রহ করেন। প্রায় ১৩ মিনিট লড়াইয়ের পর জঙ্গিরা সেদিন পরাস্ত হয়, আর ক্যাফের নিয়ন্ত্রণ নেয় কমান্ডোরা।

এরপর আহত-নিহতের সংখ্যা জানার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু গণমাধ্যম কর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এ সময় পুলিশের একটি সূত্র জানায়, অভিযান শুরুর আগে কয়েকজনকে মুক্তি দেয় জঙ্গিরা। প্রাথমিকভাবে জানতে পারলাম, ১৫ জন বিদেশি ও পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়েছে। চূড়ান্ত হিসাব মতে, ২৯ জন নিহত হয় এ ঘটনায়। এর মধ্যে জঙ্গিদের হামলায় ১৭ জন বিদেশি, ৩ জন বাংলাদেশি ও দুজন পুলিশ নিহত হয়। বাকি সাতজনের মধ্যে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয় সেনা অভিযানে। একই অভিযানে ক্যাফের একজন বাবুর্চিও নিহত হয়। নিরাপত্তা বাহিনী এই বাবুর্চিকে শুরুতে জঙ্গি বলে চিহ্নিত করলেও পরে এই বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। এ ছাড়া ক্যাফের এক কর্মী রাতে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পরবর্তী সময়ে মারা যায়।

প্রায় ১১ ঘণ্টার মাথায় আর্টিজান ট্র্যাজিডির সমাপ্তি হয়। দেশের মানুষের মতো আমিও তখন হতাশ হয়ে পড়ি এই ভেবে যে, বাংলাদেশের ভবিষৎ কী? তবে, ঘটনার এক বছরের মাথায় এসে বলতে হয়, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রচেষ্টায় সেই ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। কিন্তু এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকে গেছে জনমনে। এই আশঙ্কা দূর করতে চাই জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সামাজিক আন্দোলন আর আইনের সঠিক প্রয়োগ। তবেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি হবে সব শঙ্কা থেকে মুক্ত।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, বৈশাখী টেলিভিশন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :