অন্ধকার গুহায় যাচ্ছে গাজার ভবিতব্য

মোহাম্মদ আবু মুঘাইসেব
 | প্রকাশিত : ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:৪১

একজন ডাক্তার হিসেবে আমি সারা জীবন গাজাতেই কাজ করেছি। আমি ধারণা করতাম আমি সব দেখে ফেলেছি। অনুভব করতাম যে, আমি গাজার সহ্যক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানি।

কিন্তু গত ছয় মাসে এমএসএফের (মেডিসিনস স্যান ফ্রন্টিয়েরস) হয়ে আমার কর্মজীবনের ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অবস্থা অবলোকন করেছি। আমি সরাসরি ২০০৮, ২০১২ এবং ২০১৪ সালের তিনটি যুদ্ধ দেখেছি এবং সেখানে কাজ করেছি। তবে গত কয়েক মাসে মানুষের কষ্ট এবং যেসব ধ্বংস আমি দেখেছি তা যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। আহত হওয়ার মাত্রাও আশঙ্কাজনকভাবে অনেক বেশি।

আমি কখনো ১৪ মে সোমবারটিকে ভুলব না। সেই চব্বিশ ঘণ্টাকেও ভুলব না। স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রেকর্ডে বলা হয়, ওই দিন ২ হাজার ২৭১ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৫৯ জন ইসরাইলি বাহিনীর সরাসরি গুলিতে আহত হয়েছেন। আমি সেদিন গাজার প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র আল আকসা হাসপাতালে অপারেশন দলে কর্মরত ছিলাম।

সেদিন দুপুর ৩টায় আমরা বিক্ষোভ থেকে আহত হওয়া প্রথম ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য গ্রহণ করলাম। এরপর মাত্র চার ঘণ্টার ব্যবধানে তিন শতাধিক আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। আমি এর আগে এত কম সময়ে এত আহত ব্যক্তি কখনো দেখিনি। অপারেশন থিয়েটারের সামনে শতাধিক লোক লাইনে দাঁড়িয়েছিল। সামনের বারান্দা আহত লোকে পূর্ণ ছিল। প্রতিটি আহত ব্যক্তির শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তারা চিৎকার করছিল।

আমাদের কাজ করতে কতটা কষ্ট হচ্ছিল সেটা বিষয় নয়, কিন্তু এত বেশি সংখ্যক আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এটা ছিল অনেক বেশি। ইসরাইলি বাহিনী গুলির পর গুলি ছুড়ছিল। আমাদের দল প্রায় ৫০ ঘণ্টা কাজ করেছিল আহত মানুষদের জীবন বাঁচানোর জন্য। আমি ২০১৪ সালের যুদ্ধের স্মৃতি মনে করতে পারি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে ১৪ মে যে ভয়াবহতা অবলোকন করেছি তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না এবং তা আজও চলছে।

প্রতি সপ্তাহে নতুন আঘাত হানে ইসরাইলি বাহিনী। আর তাদের আঘাতে আহত হওয়া বেশিরভাগই যুবক। ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে তাদের কারো পা কেটে ফেলতে হয়েছে, কেউ প্রচ- ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে রয়েছে আর কেউ সারা জীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়েছে। এমএসএফের চিকিৎসকরা প্রতিনিয়ত এই আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা প্রদান করছে। আমরা গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে আহত ৪০ শতাংশ লোকের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এই কয়েক মাসে যার সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি।

কিন্তু যত বেশি আমরা এই বন্দুকযুদ্ধের আঘাতের চিকিৎসায় অগ্রসর হব, ততই আমরা যা করতে হবে তা জটিলতায় রূপ নিচ্ছে। এটি অত্যন্ত কঠিন, চিকিৎসাগত এবং ব্যবস্থাগতভাবে। স্বাস্থ্যসেবার উচ্চ চাহিদা অনুযায়ী গাজার চিকিৎসা কাঠামো ভেঙে পড়েছে, বিশাল সংখ্যক রোগীর বিশেষ অঙ্গ ও অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, যার মানে হলো বহু সংখ্যক অস্ত্রোপচার, যা এই মুহূর্তে গাজায় সম্ভব নয়। আমার সবচেয়ে বড় ভয় সংক্রমণ ঝুঁকির। অস্টিওমিএলাইটিস হলো হাড়ের গভীর সংক্রমণ। যদি এটি চিকিৎসার বাইরে চলে যায়, তাহলে স্থায়ীভাবে পঙ্গু এবং প্রতিবন্ধী লোক বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে এই আহত ব্যক্তিদের খুব দ্রুত চিকিৎসা দরকার।

কিন্তু এই আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা খুব সোজা নয়। আর এই মুহূর্তে গাজায় এমন অবকাঠামো বিদ্যমান নেই। যে অবকাঠামোগত চিকিৎসার মাধ্যমে হাড়ের পরীক্ষা করে তা নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু একবার আমরা এই সংক্রমণ শনাক্ত করতে সক্ষম হলে রোগীকে জটিল প্রক্রিয়া ছাড়াই চিকিৎসা প্রদান করতে পারব।

একজন ডাক্তার হিসেবে আমি গাজার সম্পূর্ণ অংশে ঘুরেছি। সেখানে দেখেছি বহু যুবক আহত হয়ে হুইল চেয়ারে জীবন পার করছে। এটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এমন অবস্থায়ও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তবে একজন ডাক্তার হিসেবে আমি জানি যে তাদের ভবিষ্যৎ বিবর্ণ।

আমি আমার কর্মজীবনে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো বেশিরভাগ যুবক এসব আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলা। যারা ইসরাইলি বাহিনীর বুলেটের আঘাতে পা হারিয়েছে এবং তাদের ভবিষ্যতের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। তাদের বেশিরভাগই আমার কাছে জানতে চায় যে, ‘আমি আবার স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারব কি না?’

এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন কারণ আমি জানি এসব যুবক আর কখনো স্বাধীন এবং স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে না এবং এটা বলা আমার দায়িত্ব যে, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, কিন্তু পুরোপুরি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। এমন কথা একজন যুবকের সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু এই কথাটিই সাম্প্রতিক মাসগুলো আমাকে বহুবার বলতে হয়েছে।

অবশ্যই আমরা যে কষ্টের মুখোমুখি হই, তা সত্ত্বেও আমরা এই লোকদের সঠিক ও উন্নত চিকিৎসা ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানে হাসপাতালের অবস্থা ভয়াবহ। আর অবরুদ্ধ থাকার কারণে গাজায় প্রতিদিন চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। সেখানে জ্বালানি সংকট রয়েছে, চিকিৎসা সরবরাহের স্বল্পতা, বিশেষজ্ঞ সার্জন ও ডাক্তারের অভাব, ক্লান্ত নার্স যাদের মাস শেষে পুরো বেতন দেওয়া হয় না, এছাড়া উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের গাজা ত্যাগের ওপর ইসরাইলের কড়াকড়ি, এসবের মধ্যেই আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এমন অবস্থায় আমাদের চারপাশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এখন রাস্তায় ভিক্ষারত শিশুদের দেখা যায়, যা দুই বছর আগেও কখনো দেখিনি। এমএসএফ বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। আমরা কখনোই একা একা এমন অবস্থার সম্পূর্ণ উন্নতি ঘটাতে পারব না। আমরা চেষ্টা করছি, আমরা ধাক্কা দিচ্ছি। আমাদের চলা অব্যাহত রয়েছে। আমার জন্য, এটা চিকিৎসা নীতির একটি প্রশ্ন। এই আহত মানুষের অবশ্যই তাদের চিকিৎসা পেতে হবে। বর্তমানে গাজার অবস্থা দেখে কল্পনা করা যায় যে, তাদের ভবিষ্যৎ একটি অন্ধকার গুহায় ঢুকে যাচ্ছে, আমি নিশ্চিত নয় যে এর শেষে কোনো আলো দেখা যাবে কি না।

[মূললেখা: আল জাজিরা ডটকম। অনুবাদ: আবুল কাশেম]

মুহাম্মদ আবু মুঘাইসেব: ফরাসি চিকিৎসাসেবাদাতা চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান মেডিসিনস স্যান ফ্রন্টিয়েরসের (এমএসএফ) একজন চিকিৎসক। ১৫ বছর ধরে গাজায় চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :