হিন্দু মহাজোটকে নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে

সত্যান্বেষী পথিক
 | প্রকাশিত : ১৩ নভেম্বর ২০১৬, ১২:২৫

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় গরিব বাঙালি হিন্দুদের ঘরবাড়ি এবং মন্দিরের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার জের ধরে সারাদেশে এবং বিদেশের কোন কোন জায়গায় প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। অন্যদিকে সরকার হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে চলেছে। হামলার পরপরই স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব মোতায়েনসহ যাবতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

সরকারের পাশাপাশি, সারাদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদে নেমেছে। প্রতিবাদে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মানববন্ধন, মিছিল, মিটিং হচ্ছে যেখানে দেশের প্রচলিত অর্থে প্রগতিশীল মানুষ ছাড়াও মাদ্রাসা-মক্তবের ওলামা মাশায়েখরাও অংশ নিচ্ছেন। হিন্দু ধর্মসহ সব ধর্মের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তাঁরা সরকার বাহাদুরের কাছে আকুতি অব্যাহত রেখেছেন। শীর্ষপর্যায়ের রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের সদস্যরা নাসিরনগরে গিয়ে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন।

অন্যদিকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট ঘোলাটে পরিস্থিতিতে বড় মাছ শিকার করতে চাইছে “হিন্দু” শব্দটিকে উপজীব্য করে গড়ে উঠা কিছু সাম্প্রদায়িক সংগঠন। আর এসব সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে তৈরি হয়েছে “বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট” নামের একটি সংগঠন। দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই সংগঠনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের পূর্বের ইতিহাস ঘাঁটলেই এদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে সমালোচিত হয়েছে।

এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভারতের শিবসেনা, বজরং পার্টি আর বিজেপির আদলে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে মিসগাইড করে একটি আত্মঘাতী রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ে সামনে এগুচ্ছে। এরা এদের ব্যানারে ভারতের হিন্দি ভাষা ব্যবহার করেন। মুসলমানদের তারা এতটাই ঘৃণা করে যে সংগঠনে মুসলমান বিষয়ক সম্পাদক নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। হিন্দু মহাজোটের প্রধান ব্যক্তি গোবিন্দ প্রামাণিক আজীবন বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি করেছেন বলে দেশের ইতিহাসবিদরা দাবি করেছেন। তিনি বক্তব্যের শুরুতে, মাঝে, পরে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে স্লোগান দেন! বাংলাদেশে থেকে এমন স্লোগান কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়? (https://www.youtube.com/watch?v=dxEgIBkXAXo এই লিঙ্কে গেলে তার ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দেখতে পাবেন)।

সাম্প্রদায়িক এই গোষ্ঠীটি এর আগেও বিদেশি বুদ্ধি আর অর্থসহায়তায় ঢাকার রমনার কালীমন্দিরের পবিত্র প্রাঙ্গণে ‘হিন্দু’ শহীদ ও গণশ্রাদ্ধ ’৭১ নামে উস্কানিমূলক কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছে। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রথম এবং বর্তমানের অন্যতম শীর্ষ অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এ ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবর একটি অসাধারণ লেখা লিখেছিলেন বিশিষ্ট গবেষক বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী।

বীরেন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় লিখেছিলেন, “সংবিধান মোতাবেক আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৯০ দিনের খাড়া শুরু হবে। এ দিন থেকেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচনোত্তর সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা চালু থাকবে। কাজেই এই সময়কালে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বেশ ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে।এ অবস্থার ঠিক প্রাক্কালে আজ ৪ অক্টোবর রমনা কালী মন্দিরে দেশ-বিদেশের কিছু লোকজন ‍মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী ‍হিন্দুদের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করবেন বলে ঘোষণা দিয়ে ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ নামের একটি অদ্ভুত অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ আয়োজন মূলত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঘোষণাপত্র এবং প্রজাতন্ত্রের সংবিধান পরিপন্থি। এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’, ‘বৌদ্ধ’ এবং ‘খ্রিষ্টান’ ধর্মীয় পরিচয়ে বিভাজনের পাঁয়তারা চলছে এবং এটি ধর্মের নামে একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক অনুষ্ঠান”। সেখানে আরো বলা হয়েছে, “দেশি-বিদেশি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহায়তায় তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তথাকথিত ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ আয়োজনের পরিকল্পনা হয়েছে। সম্প্রতি www.hindunet.org ওয়েবসাইটে শ্রীনন্দন ব্যাস নামের এক লেখকের লেখা Hindu Genocide in East Pakistan শিরোনামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

উক্ত প্রবন্ধে জনমিতি পরিসংখ্যানের অপব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী ৩০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৮০ শতাংশ হিন্দু; অর্থাৎ সংখ্যার বিচারে প্রায় ২৫ লক্ষ হিন্দুকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি আমেরিকা থেকে অনলাইনে প্রকাশিত ও প্রচারিত Unity নামের একটি নিউজ লেটারের আগস্ট ২০১৩ সংখ্যায় অবিকল প্রকাশ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’-এর মূল উদ্যোক্তা Unity নিউজ লেটারটির প্রকাশক ও প্রচারক। প্রবন্ধটিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে নতুন এক ধরনের বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বলে দৃশ্যমান। এ বিতর্ক সৃষ্টি এমন সময় করা হচ্ছে যে সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে দেশ-বিদেশের কুচক্রীরা প্রশ্ন উত্থাপন করে চলছে।

তাই মুক্তিযুদ্ধে নিহত হিন্দুদের সংখ্যা ২৫ লক্ষ বলে দাবি করলে ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে তোলা বিতর্কিত প্রশ্নের ভিত্তিকে শক্ত করে দেবে বলে ধারণা করা যায়। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মোট সংখা এবং Hindu Genocide in East Pakistan শিরোনামের প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে ২৫ লক্ষ হিন্দু আত্মাহুতি দিয়েছেন বলে অলীক দাবি করার সমসাময়িক ‘গণশ্রাদ্ধ ৭১’ আয়োজনের বিশেষ কোনো যোগসূত্র থাকলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না” (http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/12285 )।

২০১৯ সালে আরেকটা নির্বাচন হবে। এই নির্বাচন শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন আসলেই এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সরব হয়! সরকার কি এই অপরাজনীতি ধরতে পারছে?

বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের সাম্প্রদায়িক এবং চরমপন্থি তৎপরতার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসির মামুন। চলতি বছরের ২০ জুন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় এক লেখায় তিনি লিখেছিলেন, “এই গোবিন্দ প্রামাণিক কে? তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক। গোলাম আযম জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গোবিন্দ তাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন। সে সময়ের পত্র-পত্রিকা দেখুন। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের নির্বাচন চলাকালীন ভায়োলেন্সের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগই এসব কাজ করছে এবং দায় চাপাচ্ছে জামায়াতের ওপর। তিনি যে প্রেস কনফারেন্স করেছেন, তা অনেক পত্রিকাই ছাপেনি। প্রথম আলো বড় শিরোনামে তা প্রকাশ করলেও, পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেনি। এ মিথ্যাচার হচ্ছে, হিন্দু সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করা, সংখ্যাগরিষ্ঠকে অপবাদ দেয়া এবং দাঙা লাগানোর প্রচেষ্টা”।বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীসহ জঙ্গি সংগঠনসমূহের সবসময়ের টার্গেট অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের বিচার দাবি করার দুঃসাহসও দেখিয়েছে এই বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট। হিন্দিতে লেখা ব্যানারে এই জোট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে “বিভ্রান্তিমূলক, মিথ্যা, মানহানিকর তথ্যের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে আগামী ২৭ জুনের মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার” আহ্বান জানিয়েছিল। তা না হলে অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের বিচার করার হুমকিও দিয়েছিল এরা।

শুধু তাই নয়, এই নিবন্ধ প্রকাশ করার দায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম মুখপাত্র দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকিও দেয় জামায়াতের এক সময়ের “ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক” বলে পরিচিত গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।

অধ্যাপক মামুন আরও লিখেন, “এ প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছি। বিশেষ করে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক যখন প্ররোচনামূলক মিথ্যা বক্তব্য রাখেন তখন কিছু বলতেই হয়। প্রামাণিক বলেন “খুনি গ্রেপ্তার ও শাস্তি না হওয়ায় জনগণ বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকার ইচ্ছা করেই এই খুনিচক্রের মূল্যেৎপাটন করছে না। হিন্দু সম্প্রদায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, বাড়িঘর, মন্দির হারিয়ে, যাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠায়, তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিষয়ে কোন ভূমিকা রাখেন না।”

হিন্দু মহাজোটের সুভাষ চন্দ্র সাহা বলেন, “হিন্দু নারীরা এখন নিরাপত্তার অভাবে হাতের শাঁখা খুলেও সিঁদুর মুছে চলাফেরা করেন।” [প্রথম আলো, ১৮.৬.২০১৬] । তিনি আরও কিছু কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় আসেনি। কিন্তু দুই একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, তা হলো, তিনি বলেছেন, হিন্দু মহিলাদের এখন বোরখা পরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। শুধু তাই, নয়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পুজো অর্চনা বন্ধ হয়ে গেছে। হিন্দু মহাজোট, হিন্দু সমাজ সংস্কারক সমিতি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের অনেক নেতাই বিভিন্নভাবে এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন।’

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপ্লবের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় অমূল্য অবদান রাখা আইনজীবী রানা দাশ গুপ্তের প্রসঙ্গ নিজের লেখায় টেনে এনেছেন অধ্যাপক মামুন। নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ নিমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ছুটে গিয়েছিলেন রানা দাশ গুপ্ত এবং প্রখ্যাত অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মিটিংয়ে তাঁরা বাংলাদেশের হিন্দুদের বাঁচাতে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন! দেশ তো বাংলাদেশ, ভারত না। দেশে সরকার আছে, প্রশাসন আছে। তাহলে নিজ দেশের সরকারকে না জানিয়ে, প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা কেন পরদেশে গিয়ে হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন? দেশের দেশপ্রেমিক নতুন এবং প্রবীণ মানুষেরা ক্ষেপে উঠলে রানা দাশ গুপ্ত সেই খবর অস্বীকার করেন।

এই বিষয়ে অধ্যাপক মামুন তাঁর লেখায় লিখেছেন, “ রানা দাশগুপ্ত এখানে একটি ভুল করেছেন। তিনি পিটিআইএর খবর অস্বীকার করার পর বিবিসি পিটিআইয়ের কাছে জানতে চায় বিষয়টি সম্পর্কে। পিটি আই বিবিসিকে জানিয়েছে তাদের প্রতিবেদন সঠিক। জাতীয় একটি সংস্থা যখন এ বক্তব্য দেয় তখন বুঝতে হবে তাদের কাছে রেকর্ড আছে দেখেই তারা এভাবে বলতে পারে। রানাদা যদি মনে করেন তার কথা ঠিক তাহলে ভারতেই তার প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিল। সময় এখনও ফুরোয়নি। তিনি একজন আইনজীবী। পিটিআই যদি ভুল প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে এবং তা স্বীকার না করে তা’হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে মানহানি ও মিথ্যা খবর প্রচারের মামলা করা উচিত।

রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের অনেক দিনের। তাকে আন্তরিকভাবে জানাচ্ছি, এই ব্যবস্থা না নিলে তিনি আর তার পুরনো আসন ফিরে পাবেন না। বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। ফলে যে সব সংগঠনের তিনি নেতৃত্বে আছেন সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের এক সঙ্গে পথচলার লোক এমনিতেই” (https://www.dailyjanakantha.com/editorial/date/2016-06-20)

একইদিনের পত্রিকায় দেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতি আন্দোলনের বীরযোদ্ধা স্বদেশ রায় লিখেছেন, “সম্প্রতি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত পিটিআইকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যার ভেতর দিয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের হিন্দুদের বিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়াতে বলেছেন। এটা শুধু অন্যায় নয়, পাকিস্তানি নিশানের মতোই তিনি ভারতীয় নিশান হয়ে গেছেন। আর দুই প্রতিক্রিয়াশীল কিন্তু শেষ পর্যন্ত একে অপরের সহায়ক। দুজন দুজনের বিরুদ্ধে বলেন ঠিকই কিন্তু তাদের কাজের ফল একই অ্যাকাউন্টে জমা হয়।

রানা দাশগুপ্তের এ বক্তব্য বাস্তবে, জামায়াত-বিএনপি যা চাচ্ছে সেটাকেই সাহায্য করেছে। রানা দাশগুপ্ত অথচ গুলি বন্দুকের নল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে বুঝতে পেরেছেন, তাই এখন বলছেন, তিনি ওই কথা বলেননি। কিন্তু পিটিআই বিবিসিকে স্পষ্ট বলেছে, রানা দাশগুপ্তের বক্তব্য তারা সঠিকভাবে প্রচার করেছেন।

রানা দাশগুপ্তের এ বক্তব্য হিন্দু কমিউনিটির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে। কারণ যিনি দশ হাতে বাংলাদেশে হিন্দুদের রক্ষা করে আসছেন সেই শেখ হাসিনাকে তিনি অপমান করেছেন। শেখ হাসিনা নির্মোহভাবে যোগ্যতার মূল্য দিয়ে সবাইকে সমান অবস্থানে নিয়ে গেছেন। কোন সম্প্রদায়ের প্রতি কোন নেতিবাচক দৃষ্টি দেননি, এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এখন যদি বাংলাদেশে রানা দাশগুপ্তের প্রতি কেউ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা মাইনরিটিদের যেভাবে ক্ষমতায়ন করেছেন ভারতে কি সেভাবে মাইনরিটিদের ক্ষমতায়ন হয়- রানা দাশগুপ্ত উত্তর দিতে পারবেন? নিতে পারবেন সে চ্যালেঞ্জ?

শুধু তাই নয়, রানা দাশগুপ্ত এই বক্তব্যের মাধ্যমে শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অপমান করেননি, তিনি ড. আনিসুজ্জামান, মুনতাসীর মামুন, মফিদুল হক, ড. সারওয়ার আলী, শাহরিয়ার কবির এমনকি প্রয়াত ওয়াহিদুল হকসহ হাজার হাজার প্রগতিশীল বাঙালিকে অপমান করেছেন”।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী জয়শ্রী কর ঢাকার স্টেডিয়ামে ভারতের পতাকা হাতে খেলায় হইচই করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। পীযূষ বাবুর বিরুদ্ধে এফডিসির ৩৫ মিলিয়ন টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন বাদী হয়ে একটি মামলাও করেছিল (সূত্র বিডিনিউজ, ২০১৫-১০-০৮, http://bdnews24.com/bangladesh/2015/10/08/actor-director-pijush-bandyopadhyay-faces-tk-35-million-corruption-charges-in-fdc)। সেই মামলার এখন কী অবস্থা আমাদের জানা নেই।

আরেক ঘটনায় এই বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট বাংলাদেশের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত প্রকৃত হিন্দু কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেদের মৌলবাদিতা আর কট্টর দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ রাখে। কট্টর এই সংগঠন তাদের লিফলেটে বলেছিল, হিন্দুদের পারিবারিক আইনে সরকার হস্তক্ষেপ করলে পরিনাম ভালো হবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হিন্দু হয়েও হিন্দুদের অধিকার রক্ষায় কাজ না করে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্র করছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।

সর্বশেষ ঢাকার শাহবাগের একটি ঘটনা দেশের মূলধারার গণমাধ্যম রহস্যজনকভাবে সযত্নে এড়িয়ে গেলেও জনসাধারণের নজর এড়ায়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ গাড়িতে করে শাহবাগ পার হচ্ছিলেন। তখন সেখানে আন্দোলনরত তরুণেরা তাঁর গাড়িতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা তাঁর গাড়িতে লাথি মারে, জুতা নিক্ষেপ করে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিশ্চয় এই হামলা করেনি। হানিফ সাহেবের গাড়িতে হামলা আর জুতা পড়ার দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হচ্ছিল, তখন বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নিশ্চয় উল্লাস করছিল!।

এই হিন্দু মহাজোট দেশের হিন্দুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় চাচ্ছে! কেন দেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় কি শুধু এদেশের মুসলমানদের? সরকারি নানা তহবিল কি শুধু মসজিদ মাদ্রাসায় যায়? তাহলে একটা হিসেব হয়ে যাক। সরকারি কত টাকা মসজিদ, মাদ্রাসায় যায়? কত টাকা মাদ্রাসা, এতিমখানায় যায়? পুজার সময় সরকারের কত টাকা মন্দিরে যায় আর ঈদের সময় কত টাকা ঈদগাহে যায়? এই হিন্দু মহাজোট সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন দাবি করেছে! তাহলে এখন যদি খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং মুসলমানরাও এমন দাবি করে তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে?

হিন্দু মহাজোটের প্রতিটি দাবি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। এভাবে দেশের হিন্দু সমাজকে কট্টরপন্থি করে তোলে কার লাভ হবে? লাভ হবে নিশ্চিতভাবেই দেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর। দেশের সব হিন্দু যদি শুধু হিন্দু হয়ে যায়, আর মুসলমানেরা যদি শুধু মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে কী হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের?

দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকার, প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, প্রতিষ্ঠানসমূহের সবাইকে উপরের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। এদেশ কোন সাম্প্রদায়িক হিন্দুর বা সাম্প্রদায়িক মুসলমানের না। এদেশ সকল বাঙালির, সকল বাংলাদেশির। এদেশের আইন, সংসদ, বিচারব্যবস্থা সকলের জন্যই করা হয়েছে। যে আইন মুসলমানের, সে আইন হিন্দুরও। এখানে আলাদা হওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলন্ঠিত করা।

লেখক: রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :