শান্ত কিশোরগঞ্জে অস্থিরতার পদধ্বনি...
হাওর অধ্যুষিত ষোড়শ শতকের সংস্কৃতির রাজধানী, মাসনাদে আলা ঈশা-খাঁ, বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, উপেন্দ্র-সুকুমার-সত্যজিৎ এর স্মৃতি বিজড়িত, শত সংগ্রামের ঐতিহ্যের জনপদ কিশোরগঞ্জ গড়ে উঠেছে নরসুন্দার নরম পলি মাটি দিয়ে। তাই এই অঞ্চলের মানুষের মন কাঁদা মাটির মতোই নরম। কিশোরগঞ্জের এর বুক চিরে নরসুন্দা নদী এখন অতীত হলেও আমরা যারা দূরে থাকি জীবিকার তরে, আমাদের মনে গেঁথে আছে সেই চিরচেনা কিশোরগঞ্জ।
ছকে বাঁধা জীবন আমাদের, অযথা সময় নষ্ট করার সময় কোথায়? সকালে মুখে কিছু গুজেই পা ফেলি ব্যাস্ত রাজপথে। অফিসে যাবার আগে নাস্তা করার সময় টিভি চালিয়ে একটু আপডেট নিয়ে নেয়া আমার নিত্য দিনের অভ্যাস। ৪ এপ্রিল এমনই এক সকালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির স্ক্রলে একটি নিউজ আমাকে নাড়িয়ে দেয়: ‘কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়ায় একদল মুখোশধারী যুবকের তাণ্ডব, ১০ জন আহত’। একটা অস্থিরতা কাজ করছিলো মনের ভেতর। এই শহরে আমি বড় হয়েছি। ছোট্ট, শান্ত একটা শহর। মোটামোটি আমরা সবাই সবাইকে চিনি। কী এমন হলো?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে ‘গ্যাং কালচার’ ডেভেলপ করেছে এই শান্ত শহরে। কয়েক মাস আগে ঢাকার উত্তরায় ১৩ বছর বয়েসী এক কিশোরকে (আদনান, নবম শ্রেণির ছাত্র) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। হত্যাটি ঘটিয়েছিলো ‘ডিসকো বয়েজ’ নামে একটি গ্রুপ। র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছর ধরে উত্তরা এলাকায় সক্রিয় গ্যাং এর মধ্যে অন্যতম হলো কাঁকড়া গ্রুপ, জি ইউনিট গ্রুপ, ব্ল্যাক রোজ গ্রুপ, রনো গ্রুপ, কে নাইট গ্রুপ, ফিফটিন গ্রুপ, ডিসকো বয়েজ গ্রুপ, নাইনস্টার গ্রুপ, নাইন এম এম বয়েজ গ্রুপ, পোটলাবাবু গ্রুপ, সুজন গ্রুপ, আলতাফ গ্রুপ, ক্যাসল বয়েজ গ্রুপ, ভাইপার গ্রুপ ইত্যাদি। এসব গ্রুপে প্রায় শতাধিক সদস্য সক্রিয়। এরা সবাই কিশোর-বয়সী। এই সব ‘গ্রুপ’ বা ‘গ্যাং’ এ উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত থেকে শুরু করে পাড়ার বখাটে কিশোর তরুণেরাও আছে।
প্রত্যেকটি ‘গ্যাং’ এর আলাদা সাইন আছে, যা তাড়া তাদের এলাকায় কালার স্প্রে করে জানান দেয়। এলাকার স্কুল কলেজের মেয়েদের উত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাই, দ্রুত গতিতে বাইক, সাইলেন্সার দিয়ে উচ্চ শব্দে গাড়ি চালিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা, অশ্লীল ভিডিও নিজেদের মধ্যে আদান প্রদান করা ওদের নিত্য দিনের কাজ। ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে শোভা পায় দৃষ্টিকটু কালার স্প্রে, যার মাথামুণ্ডু আগে বুঝতাম না, এখন বুঝি ...
আমাদের কিশোরগঞ্জ শহর এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে, সেই সাথে জনসংখ্যা বেড়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ সহজ হয়েছে। আছে নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এই সুযোগের অপব্যবহার করছে কতিপয় বিপথগামী কিশোর তরুণ। এমনই দুই দল কিশোর গ্যাং এর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে গোটা কিশোরগঞ্জে আতঙ্ক নেমে এসেছে। খবরে প্রকাশ, কিশোরগঞ্জ শহরে মুখোশধারী একদল সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালিয়ে সাতজনকে গুরুতর আহত ও অন্তত অর্ধ শতাধিক দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে পুরো শহরবাসীর মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে রাতেই সন্দেহভাজন তিন চার জনকে আটক করেছে।
৩ এপ্রিল নয়টার দিকে কালো মুখোশধারী অন্তত ২০-৩০ জন সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে রামদা ধারালো দেশি অস্ত্র নিয়ে শহরের একটা অংশে তাণ্ডব চালায়। তারা ‘ধর ধর’ চিৎকারে রাস্তার পথচারীদের কুপিয়েছে, নগুয়া প্রথমমোড়, এতিমখানা রোড, নতুনপল্লী এলাকায়। সন্ত্রাসীরা নগুয়ায় লাইসিয়াম প্রি ক্যাডেট স্কুল, হাবিবা বিউটি পার্লার, ঘোমটা বিউটি পার্লার, মুদির দোকান, লন্ড্রিসহ অন্তত অর্ধ শতাধিক বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর করে। এই আক্রমণের এক পর্যায়ে নগুয়ায় অবস্থিত লাইসিয়াম কোচিং সেন্টার থেকে বোন আদৃতাকে আনতে যাওয়া খরমপট্টি এলাকার ফাহিদুর রহমান ফাহিমকে এলোপাথাড়ি কুপিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তার মুখে, পিঠে, মাথায় ৪০ টি শেলাই দিতে হয়েছে, অথচ এই ফাহিমের সাথে ছিলো না কোন পূর্ব শত্রুতা। বর্তমানে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন আছেন ফাহিম।
আখড়া বাজারের কিছু বন্ধু জানিয়েছেন, সন্ধ্যার পর ১৪/১৫ বছর বয়সী একদল কিশোর দল বেঁধে মহড়া দেয়, এতে গোটা এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় কিশোরগঞ্জের সুশীল সমাজ সোচ্চার হয়েছেন, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। গুরুদয়াল কলেজের সাবেক জিএস এনায়েত করিম অমি নগুয়া প্রথম মোড়ে একটি মানববন্ধন আয়োজন করেছেন, যার নাম দিয়েছেন ‘দানবের বিরুদ্ধে মানবের বন্ধন’। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এই দানবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, কিশোরগঞ্জবাসী শান্তি চায়, আমরা যাবতীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ।
প্রজন্ম ৭১, কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার উদ্যোগে গুরুদয়াল কলেজের সাবেক জি এস সাকাউদ্দীন আহমেদ রাজন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদ সমাবেশ’ এর আয়োজন করেছেন আখড়াবাজার ব্রিজের পাশে। পৌর মেয়র, মুক্তিযোদ্ধা নেতা, আইনজীবী নেতা, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ ব্যাপক জনসমাগমে গোটা শহর ঐক্যবদ্ধ হয়ে জানিয়ে দেয় এই তরুণদের অপকর্মে আমরা লজ্জিত, ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ।
সম্প্রতি খরমপট্টি এলাকায় অবস্থিত সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক সংগঠন ময়ূখ খেলাঘর আরো একটি মানববন্ধন আয়োজন করে। এতেও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিলো লক্ষ্যণীয়।
যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ হতেই হবে, তা না হলে অন্যায়কারীরা প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। এবার আইন প্রয়োগকারীদের ভূমিকা দেবার পালা, আপনাদের কাছে জিরো টলারেন্স আশা করি। অন্যায়কারী যেই হোক, তাকে গ্রেপ্তার করতেই হবে। ইতিমধ্যে ১২/১৩ জন বখাটে তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, অনতিবিলম্বে অন্যান্য অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। আমি শুনে আনন্দিত হয়েছি, কিশোরগঞ্জের আইনজীবী সমাজ এই অপরাধীদের পক্ষে আইনি লড়াই না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, সেই সাথে প্রত্যাশা করি, তারা যেন কোনভাবেই আইনের ফাঁক ফোকড় গলিয়ে বেড়িয়ে না আসতে পারেন।
কিছুদিন আগে, ওয়াচ টাওয়ারের পাশে দশম শ্রেণির একজন ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আতঙ্কের কথা হলো যারা এই অপকর্মের সাথে যুক্ত, তারাও আমাদেরই সন্তান, এই সমাজেরই অংশ। তবে অন্যায় করলে তার প্রায়শ্চিত্য করতেই হবে। তা না হলে আরো বড় কোন অন্যায় করতে তারা উৎসাহিত হবে।
আমাদের শান্ত শহরের বিপথগামী কিশোর তরুণদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান, ফিরে এসো সত্য ও সুন্দর জীবনের পথে। আমরা কিশোরগঞ্জবাসী তোমাদের কৃতকর্মে ক্ষুব্ধ, আমরা তোমাদের এই অপকর্মের পক্ষে নই। তোমাদের অপকর্মের দায়ভার তোমার পরিবারকেও বহন করতে হচ্ছে, এটা ভীষণ লজ্জাজনক তোমার জন্য। তোমরা ফিরে এসো...
লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী