নারী উদ্যোক্তাদের পাশে নাদিয়ার ‘ওয়েন্ড’

জহির রায়হান
  প্রকাশিত : ১৮ মে ২০১৯, ১৩:৫৪| আপডেট : ১৮ মে ২০১৯, ১৪:০২
অ- অ+

নারী উদ্যোক্তাদের বাধা দূর করে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। নাম ‘উইমেন এন্টাপ্রিনিওয়ার্স নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-ওয়েন্ড। এর প্রধান নির্বাহী নাদিয়া বিনতে আমিন। সংগঠনটির প্রধান লক্ষ্য নারীর উৎপাদিত পণ্য বিপণন প্রক্রিয়া আরো সহজ করা। ড. নাদিয়া বিনতে আমিন একাধারে বিয়াস এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী, বেস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্সের পরিচালক, তারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, আরসিএস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ওমেন এন্টাপ্রিনিওয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (উইভ)-এর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করা নাদিয়া এর আগেও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে গবেষণাভিত্তিক কাজ করেন। পরে নিজেই কিছু করার উদ্যোগ নেন। চার বন্ধু মিলে ১৯৯৩ সালে রিসার্চ অ্যান্ড কম্পিউটিং সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড (আরসিএস) নামে একটি গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সামাজিক গবেষণা ছাড়াও মার্কেট রিসার্চ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ইউনিসেফ, ওয়ার্ল্ড ভিশন, ইউএসআইডি, এসএমসি, এইচআরসির জন্য কাজ করে তারা। কিছু দেশি ও বিদেশি সংস্থার ইভেন্ট পরিচালনাও করেছে আরসিএস।

এবার নারী উদ্যোক্তাদের সমস্যা সমাধানে অ্যাডভোকেসি ছাড়াও নানা ভূমিকা রাখতে চাইছেন নাদিয়া।
এসব নিয়েই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জহির রায়হান।

ওয়েন্ড শুরু করেন কীভাবে?

নারীর ব্যবসায় অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ভেবে দেখলাম এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ অনেক সময় নারীরা বিচ্ছিন্নভাবে তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে, কিন্তু সেটা জোরালো হয় না। দাবি আদায়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে কথা বলে দাবি আদায়ে ভয়েসটাকে জোরালো করতে হবে। এই ভাবনা থেকেই এ সংগঠন শুরু করি।

কবে থেকে কাজ শুরু করেছেন আর কী কী কাজ করেন?

২০১৭ সালে সরকার থেকে ওয়েন্ড গঠনের অনুমোদন পেয়েছি। এরপর নারী উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহায়তা করব ভেবে রিসার্স সেন্টার গড়ে তুলছি। যেখানে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন তথ্য থাকবে। এই সংগঠনের মূল লক্ষ নারী ব্যবসায়ীদের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করা। আমরা সারা দেশে নারী উদ্যোক্তাদের থিউরিটিক্যাল সাপোর্টের পাশাপাশি ট্রেড লাইসেন্স সহজে পাওয়া, ই-টিআইএন ও ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া, ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পণ্য বাজারজাতকরণে সহায়তা, টেকনোলজি বিষয়ে সাপোর্ট দেওয়া, নারীর ক্ষমতায়নে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাসহ নানা কাজ করব।

নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের কাছে কী ধরনের নীতিগত সহায়তা চান?

নারীদের কর ও ভ্যাটের হার কমানো জরুরি। এখন পর্যন্ত আয়ের তিন লাখ টাকা করমুক্ত। এটা পাঁচ লাখ টাকা করার দাবি জানাই। আমাদের সুপারিশগুলো হলোÑ সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, ভ্যাট, কর ও শুল্কহার হ্রাস করা, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা, প্রতি বিভাগে সাপোর্ট সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা, আন্তঃজেলা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মেলায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহায়ক নীতি প্রণয়ন, বাংলাদেশ ইকোনোমিক জোন (বেজা), ইপিজেড-এ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে শিল্প স্থাপনে প্লটসহ সুযোগ সৃষ্টি। আমরা আশা করি বাজেটে এগুলোর প্রতিফলন ঘটবে।

নারীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট নেই। আমারা শিখতে চাইলে কোথায় শিখব। তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের সাপোর্ট সার্ভিস নেই। এটা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মেলায়? নারীদের প্রতিনিধিত্ব খুবই স্বল্প। এটা বাড়ানো খুবই জরুরি।

ইকোনোমিক জোনে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। আমরা চাই দেশে-বিদেশে যারা বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তা আছেন তারা যেন তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন।

প্রতি ব্যাংকের নারীদের জন্য আলাদা শাখা থাকলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়। নারীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকও প্রয়োজন, যাতে আমাদের সমস্যাগুলো তারা বুঝে। এখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আশা করি।

নারীদের ব্যবসা শুরুতে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে?

ব্যবসা শুরু করতে একটি ট্রেড লাইসেন্স বানাতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। সেটা শেষ হলে আছে পণ্য বিপণনে সমস্যা। আমি ভালো রান্না করতে পারি, ভালো জামা বানাতে পারি। কিন্তু আমাকে এগুলো তো বিপণন করতেও হবে। আমাকে তো এটা বিক্রি করতে হবে। পণ্য বিপণনের যে জায়গাটা সেই জায়গাতে একটা বিশাল গ্যাপ আছে। এখনও তেমন নারীবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সময়মতো সঠিক জায়গায় পণ্যটা পৌঁছাতে পারে না তারা। এরপর আছে পরিবার সামলানো। চাইলেই সে চট করে ঘরের বাইরে যেতে পারে না।

এরপর মূলধন সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কয়জন নারী বাসা থেকে অর্থ নিয়ে ব্যবসা করতে পারে। তাকে তো প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিতে হবে। সেই ঋণ পাওয়াও নারীদের জন্য কঠিন হয়। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১০ শতাংশের নিচে সুদে ঋণ দেওয়ার কথা থাকরেও সব ব্যাংক সেটা মানছে না।

নারীদের মেইনস্ট্রিমে যাওয়ার জন্য পরিবারের সহযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকাতা আরও বেশি প্রয়োজন। নারীরা উদ্যোক্তা হলে রপ্তানি আরও বাড়বে। প্রবৃদ্ধি ডবল ডিজিট করতে হলেও নারীদের নিয়ে এগুতে হবে। প্রান্তিক নারী উদ্যোক্তাদের কথাও সবাইকে ভাবতে হবে ।

এ ক্ষেত্রে ওয়েন্ড কী ভূমিকা রাখছে?

প্রাথমিকভাবে আমরা আটটি বিভাগে কার্যক্রম শুরু করেছি। ওয়েন্ড-এর আটজন সদস্য আটটি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। তাদের একটি নির্দিষ্ট ফোন নম্বর রয়েছে। বিভাগের দায়িত্বে থাকা নারী উদ্যোক্তা তার বিভাগের প্রতিটি জেলার নারী উদ্যোক্তাদের সমস্যা নোট করে আমাদের জানাবেন। আমরা কেন্দ্র থেকে তার সমাধানের চেষ্টা করব। সরকারের নজরে আনব।

আপনার ব্যবসা সম্পর্কে বলুন, বিশেষ করে রিটেল শপের ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ কেমন?

‘তারা’ নামক রিটেল শপের ব্যবসা করছি। এই ব্যবসা খুবই চ্যালেঞ্জিং। আমাদের উত্তরা ও বনানীতে দুটি আউটলেট রয়েছে। এই ব্যবসায় সময় দিতে গিয়ে গবেষণা প্রকল্প কমিয়ে দিতে হয়েছে। বেস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্সেও সময় দিচ্ছি। এখন আমার স্বপ্ন বাবার প্রতিষ্ঠান বিয়াস এন্টারপ্রাইজকে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া। এটি আন্তর্জাতিক ট্রেডিং অর্গানাইজেশনটির প্রতিষ্ঠান।

মেয়েদের জন্য এ সেক্টরটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। তবুও চ্যালেঞ্জ নিলাম। আমার বাবা মারা গিয়েছেন। তিনি সব সময় বলতেন তার সন্তানরা যেন গ্রামের জন্য কিছু করেন। সেজন্য আমি আমার বাবার নামে ‘তারা’ ফাউন্ডেশন করেছি। এ ফাউন্ডেশন থেকে একটি স্কুল পরিচালনা, বাচ্চাদের প্রতি মাসে বৃত্তি দেওয়াসহ স্কুলের যাবতীয় খরচ আমি দেই। এ কাজগুলো ধীরে ধীরে বাড়ানোর চিন্তা আছে। ‘তারা’ ফাউন্ডেশনের আওতায় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করছি।

নারী উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে কি আশা করছেন?

আমাদের সুপারিশগুলো হলো- সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণপ্রদান, ভ্যাট, কর ও শুল্কহার হ্রাস করা, ট্রেনিং ইনন্সিটিউটপ্রতিষ্ঠা,প্রতি বিভাগে সাপোর্ট সার্ভিস সেন্টারপ্রতিষ্ঠা, আন্তঃজেলা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মেলায় নারীরপ্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহায়ক নীতিপ্রণয়ন, বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন (বেজা), ইপিজেড-এ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে শিল্প স্থাপনে প্লটসহ সুযোগ সৃষ্টি। ‘মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন এন্টারপ্রেনার্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসা ক্ষেত্রে মোট মালিকদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থাৎ ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাপ্রতিনিয়ত দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য সরাসরি কাজ করছেন।’‘অথচ নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া এসডিজি-৫ বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। আরো ১১টি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের সাথেও নারীরা জড়িত। সুতরাং নারী উদ্যোক্তা তথা নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা ও স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়।’দেশের অর্থনীতিতে নারীদের এতো সব সম্ভাবনা ও অবদান থাকার পরও নারী উদ্যোক্তারা কাঙ্খিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণপ্রদানের নীতিমালাপ্রণয়ন করলেও নারী উদ্যোক্তারা এই সুবিধা পাচ্ছেন না। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত জটিলতা নানাবিধ শর্তের বেগড়াজাল এবং উচ্চ সুদের কারণেপ্রতিনিয়ত পুঁজি সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে।এসব সমস্যা ও জটিলতা নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা।

আমরা নতুন ভ্যাট আইনে তিনটি স্তরে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ হার নির্ধারণের সুপারিশ করে আয়করের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য বর্তমানেপ্রচলিত করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখের পরিবর্তে পাঁচ লাখ টাকায় উন্নীত করার দাবী জানাই।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
টস হেরে বোলিংয়ে বাংলাদেশ
৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’, সাধারণ ছুটি ঘোষণা
সংগীতশিল্পী জীনাত রেহানা আর নেই
আমাজনে কাজ করছে ১০ লাখ রোবট, মানবকর্মীদের চাকরি হারানোর শঙ্কা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা