ঢাকাটাইমসকে সাক্ষাৎকারে চিফ অপারেটিং সুপারিনটেন্ডেন্ট (পূর্ব)
রেলওয়েকে সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব

দেশের মানুষের যাতায়াতের প্রথম পছন্দ ট্রেন। এমন একটি চাহিদাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসানের ঘানি টানছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রতি মানুষের অভিযোগেরও শেষ নেই। অনলাইনে বা কাউন্টারে টিকিট পাওয়া যায় না, কিন্তু বেশি টাকায় কালোবাজারে টিকিট মেলে। আবার টিকিট পাওয়া না গেলেও ট্রেনে অনেক আসন ফাঁকা থাকে। ট্রেনের যাত্রা বিলম্ব কিংবা বিলম্বে পৌঁছানো তো নিত্যদিনের ঘটনা। কেন হচ্ছে এমন? রেলওয়ের এত এত ভূসম্পদ, এত যাত্রীচাহিদা, মালামাল পরিবহন, তবু কেন লোকসান? এটি কি কোনো দিনই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে না?
দেশের সবচেয়ে বড় এই জাতীয় সম্পদকে জনবান্ধব, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্ব) মো. শহিদুল ইসলাম। ঢাকাটাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কিছু ব্যবস্থা নিলে রেলওয়েকে দেশের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব।
ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশ রেলওয়েতে ট্রেনের সময়মতো চলতে না পারার সমালোচনা হয় প্রতিনিয়ত। রেলের সময়ানুবর্তিতার সাথে ট্রেন পরিচালনা করতে না পারার কারণ কী বলে মনে করেন ?
মো. শহিদুল ইসলাম: সময়ানুবর্তিতার সাথে ট্রেন পরিচালনা করতে না পারার জন্য বেশ কটি সমস্যা দায়ী। এর মধ্যে প্রধান সমস্যাটি হলো লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনস্বল্পতা। এ কারণে কিছু কিছু ট্রেনের ক্ষেত্রে যথাসময়ে ইঞ্জিন সরবরাহ পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ লোকোমোটিভ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ইঞ্জিন ফেইলিওরের হার বেশি। এ ছাড়া স্টেশন মাস্টার, পয়েন্টসম্যান, গেইটম্যান ইত্যাদি জরুরি অপারেটিং কর্মচারীর অভাবে ১২৮টি স্টেশনের অপারেটিং কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ঢাকাটাইমস: প্রশাসনের তরফে অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা গেলেও টিকেট কালোবাজারিমুক্ত রেলব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি।
মো. শহিদুল ইসলাম: রেলে টিকেট কালোবাজারি অনেক পুরনো একটি সমস্যা। তবে এ সমস্যা থেকে মুক্ত হতে হবে রেলব্যবস্থাকে। মূলত চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধানই টিকেট কালোবাজারির জন্য প্রধানত দায়ী। বাংলাদেশ রেলওয়েতে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ লাখ টিকেটের চাহিদা। বিপরীতে রেলওয়ে মাত্র ২ লাখ টিকেট (স্বল্প দূরত্বসহ) সরবরাহ করতে পারে। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার, শনিবার এবং বিশেষ ছুটির দিনে টিকেটের ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়। সাধারণত এ দিনগুলোতেই কিছু অসাধু ব্যক্তি টিকেট কালোবাজারি করায় রেলওয়ের ভাবমূর্তি নিদারুণভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ে। প্রতিদিন অন্তত ১০ লাখ টিকেট সরবরাহ করা সম্ভব হলে কালোবাজারি প্রতিরোধ করা যাবে এবং যাত্রী চাহিদা পূরণ করে রেলওয়েকে একটি উন্নত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে বলে মনে করি।
ঢাকাটাইমস: ট্রেন ও স্টেশনে যাত্রীসেবার মান নিয়ে সমালোচনা আছে। এ থেকে উত্তরণে রেলওয়ের করণীয় কী?
মো. শহিদুল ইসলাম: দেশে ট্রেনকে আরামদায়ক ও নিরাপদ পরিবহণ মনে করেন মানুষ। তাই তাদের যাত্রার প্রথম পছন্দ ট্রেন। এ জন্য ট্রেনে ও স্টেশনে উন্নত যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। উন্নত যাত্রীসেবার জন্য প্রথমেই দরকার টিকেটের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। তারপর যথাসময়ে ট্রেন ছাড়া এবং গন্তব্যে পৌঁছানো। এ দুটো ঠিক ঠিক করতে পারলে অনেকটা যাত্রীসন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব। এরপর আসে স্টেশনে অপেক্ষমাণ সময়ে উন্নত পরিবেশে বসা, উন্নত টয়লেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত ফ্যান ও লাইট থাকা, সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা, স্টেশনে প্রবেশ ও নির্গমনের সুব্যবস্থা থাকা। স্টেশন ও ট্রেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকটিও নিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। ঢাকাটাইমস: রেলওয়ে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম বয়ে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর। এ অবস্থার নিরসন করে একে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন কি ?
মো. শহিদুল ইসলাম: রেলওয়েকে অবশ্যই লাভজনক প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব। এর জন্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে কমপক্ষে ৩০০টি আন্তঃনগর ট্রেন পরিচালনা করতে হবে।
এখানে একটা খাতভিত্তিক হিসাব দেওয়া যেতে পারে। ৩০০ আন্তঃনগর ট্রেন পরিচালনা করে প্রতিদিন ৫ লাখ টিকেট বিক্রি হবে। এই হিসাবে বছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা যাত্রী খাতে আয় করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়-ব্যয় (অপারেটিং কস্ট) সমান হয়ে যাবে।
অন্যান্য খাতে যেমন মালবাহী ট্রেন পরিচালনায় যে আয় হবে, সেটি লাভের ঘরে জমা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। প্রস্তাবিত ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণ করা সম্ভব হলে ঢাকা আইসিডিতে যেখানে বছরে ১ লাখ টিইউস হ্যান্ডেল করা যায় সেখানে ধীরাশ্রম আইসিডিতে ৭ লাখ টিইউস হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব কন্টেইনার হ্যান্ডেল করা হয় (বছরে প্রায় ৫০ লাখ টিইউস) তার মাত্র ২ শতাংশ রেলওয়ে পরিবহন করে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে হ্যান্ডেলকৃত কন্টেইনারের ৩০ শতাংশ রেলযোগে পরিবহন করার সুযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতে ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মিত হলে মালামাল খাতে শুধু কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে বছরে এক হাজার কোটি টাকা আয় করার সম্ভাবনা রয়েছে।
পরিকল্পিত ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ- বাণিজ্যিকভাবে সম্ভাবনা রয়েছে এমন স্টেশনগুলো (বিদেশে রয়েছে, যেমন- মালয়েশিয়া) এবং অপারেটিং কাজে ব্যবহার হবে না এমন রেলভূমিতে বহুতল মার্কেট গড়ে তুলে ভাড়ার বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দেওয়া। এক্ষেত্রে বিপুল আয়ের সুযোগ রয়েছে।
তবে মার্কেট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ ব্যবহার না করে এবং পিপিপি পদ্ধতি পরিহার করে ব্যবসায়ী বা গ্রাহকের কাছ থেকে স্কয়ার ফিট অনুযায়ী স্থানীয় বাজার মূল্যে অফেরতযোগ্য পজেশন মূল্য নিয়ে মার্কেট ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে (লিজের সময়সীমা ৫০/৯৯ বছর হতে পারে)। আর বাণিজ্যিক হার অনুযায়ী বাৎসরিক ভাড়া আদায় করতে হবে।ঢাকাটাইমস: রেলওয়েকে লাভজনক করার জন্য এই যে সম্ভাবনা বা করণীয় সম্পর্কে বললেন, তা কি বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে সম্ভব?
মো. শহিদুল ইসলাম: এই উন্নত রেলব্যবস্থা ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেশ কিছু কাজ করতে হবে রেলওয়েকে। যাত্রী ও মালামাল খাতে আয় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিশ্চিত করতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিকল্প নেই।
পরিকল্পিতভাবে পর্যায়ক্রমে আগামী ৫ বছরের মধ্যে তিন হাজার যাত্রীবাহী কোচ এবং ২০০ লোকোমোটিভ সংগ্রহ করতে হবে। কোচ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ওয়ার্কশপ নির্মাণ লাভজনক হবে। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে ওয়ার্শপে কোচ এসেম্বল করলে ৫০ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে।
ঢাকা স্টেশনের প্লাটফরম পর্যায়ক্রমে ১৫-২০টিতে উন্নীত করতে হবে। এখানে উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কথা বলা যেতে পারে। তাদের জনসংখ্যা ১০-১২ কোটি, সেখানে শিয়ালদহ স্টেশনে প্লাটফরম ১৮টি, হাওড়া স্টেশনে ২১টি। বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী ৩০০-৪০০টি আন্তনগর ট্রেন পরিচালনা করতে গেলে এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হবে ঢাকা অভিমুখী। এই চাপ সামলাতে ঢাকা স্টেশনে ১৫-২০টি প্লাটফরম করতে হবে।
উন্নয়ন পরিকল্পনা তিনটি ধাপ বা পর্যায়ে সম্পাদন করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে ১ নং প্ল্যাটফরমের পশ্চিম পাশে আরো তিনটি প্ল্যাটফরম নির্মাণ করতে হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বিদ্যমান প্ল্যাটফরমের প্রশস্থতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। চট্টগ্রাম বা রাজশাহী স্টেশনের মতো প্রশস্থতা রেখে পলাটফরম গুলো পুনরায় নির্মাণ করা হলে আরো ৪টি প্ল্যাটফরম নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
তৃতীয় পর্যায়ে ঢাকা আইসিডি ধীরাশ্রমে স্থানান্তর হলে উক্ত স্থানটি প্ল্যাটফরম, ওয়াশপিট, সিকলাইন, লোকোসেড স্থানান্তর করে ঢাকা স্টেশনে পরিকল্পনা মাফিক প্লাটফরম ১৮ থেকে ২০টিতে উন্নীত করা যাবে। তাতে ৩০০-৪০০টি ট্রেন পরিচালনা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
কমলাপুর স্টেশন ভবনের অবকাঠামোগত পরিবর্তন করে নিচতলা সম্পূর্ণ জায়গা শুধু লাইন এবং প্ল্যাটফরমের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। যাত্রীদের জন্য দোতলা থেকে প্রবেশ-নির্গমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সব লেভেল ক্রসিং গেইট আন্ডারপাস করতে হবে। এতে ট্রেনের গতি বাড়িয়ে অধিক সংখ্যক ট্রেন পরিচালনা করা যাবে।
(ঢাকাটাইমস/১৫ফেব্রুয়ারি/মোআ)

মন্তব্য করুন