কাশ্মীর নিয়ে কতিপয় প্রশ্ন ও উত্তর

আমিনুল ইসলাম
  প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১৩:২৯
অ- অ+

ব্রিটিশরা কত শতাংশ দায়ী কাশ্মীর সমস্যার জন্য?

এক শতাংশ না। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। ব্রিটিশরা এই বিশাল ভারতবর্ষ শাসন করার জন্য বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে-এটা ঠিক। খুব সহজে একটা কথা সবাই বলে ফেলে-ব্রিটিশরা নাকি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছে। এটা একেবারেই অসত্য।

ব্রিটিশরা ক্ষমতায় আসলে হিন্দুরা তাদের সঙ্গে সহজেই মিশে যায়। শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নতি করে তারা। মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭-এই ১০০ বছর পরে মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ তৈরি করার চেষ্টা করেন-স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখ। মুসলমানদের এই উন্নতিতে আবার শঙ্কিত হয়ে পড়েন হিন্দুরা। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার এটা হচ্ছে মূল কারণ।

কাশ্মীরের বেলায় কী হলো? যখন-ভারত আর পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষণা করলো বৃটিশরাজ, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ভারতে থাকবে, আর মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা পাকিস্তান থাকবে-এটাই সিদ্ধান্ত ছিল। কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ লোক ছিল তখন মুসলিম। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানে থাকার কথা। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলেও হিন্দু রাজা হরি সিং নিজের মতোই কাশ্মীর শাসন করছিলেন। তিনি কারো সঙ্গেই যোগদান না করে চুপচাপ রইলেন। কিছুটা ভুগলেন সিদ্ধান্তহীনতায়। বৃটিশের কী দোষ?

তাহলে দোষ কার?

ভারত স্বাধীন হওয়ার দুই মাস ৭ দিন পর ২২ অক্টোবর পাকিস্তান এবার হঠাৎ কাশ্মীর আক্রমণ করে বসল। কোনো আলোচনা নাই, হরি সিংয়ের সঙ্গে কোনো দরকষাকষির চেষ্টা নাই, পুরো কাশ্মির গিলে খেতে চাইল পাকিস্তান। এমনও তো হতে পারতো-হরি সিংয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখলে এমনিতেই কাশ্মীর পাকিস্তানের হতে পারত। যেহেতু কাশ্মীরের লোকজন পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যপরায়ন। নানা সমস্যায় জেরবার ভারত এ নিয়ে ভাববারই সময় পেত না।

কিন্তু দেশটার নাম পাকিস্তান। গোয়ার্তুমি আর নির্বুদ্ধিতা যার অস্তিত্বে। আক্রমণ করে কাশ্মীর দখলে নিতে চাইল। হতবাক হরি সিং নেহেরুর কাছে তারবার্তা পাঠালেন, ‘তাড়াতাড়ি কাশ্মীর রক্ষা করুন’। বিমানবাহিনী সহযোগে নেহেরু সেনা পাঠালেন ২৬ অক্টোবর। পাকিস্তানীদের ঠেঙ্গিয়ে কাশ্মীরের একাংশ দখল নিল ভারত। ভারত পারলে পুরোটা তখনই দখল নিতে পারত। কিন্তু পরে নির্ধারিত ‘লাইন অব কন্ট্রোলের’ কাছে গিয়ে থেমে গেল ভারতীয় বাহিনী।

কাশ্মীরের মোট আয়তন দুই লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গকিলোমিটার। পাকিস্তানের দখলে পড়ল ৭৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের কিছু বেশি। পাকিস্তান আবার এই বিরোধে তার ‘জানি জিগির দোস্ত’ চীনকে জড়ানোর জন্য ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা উপহার দেয়। যা আকসাই চীন নামে পরিচিত।

বাংলাদেশি মুসলমানদের সাথে চা খাওয়ার আড্ডায় বসলেই শোনা যায়-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভয়ে ভারত নাকি কাঁপে। ভারত-পাকিস্তান যে এখন পর্যন্ত চারবার যুদ্ধ হলো ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে। সবগুলোতেই কাপুরুষের মতো হেরেছে পাকিস্তান। তারপরও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জয়গান গাওয়ার লোকের অভাব নাই এই বাংলায়। থাক, সে কথা। এখন বলুন তো-কাশ্মীর সমস্যার জন্য আসল দায়ী কে?

কাশ্মীরের লোকজন কী বলে?

এটাইতো আসল কথা। কাশ্মিরের লোকজন কী চায়? আমি যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে কাশ্মীরের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-রাজধানী সব জায়গাতেই গিয়েছি, আমার অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান থেকে বলতে পারি-কাশ্মীরের ৭০ শতাংশ লোক পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকতে চায়। ২০ শতাংশ লোক ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়। ১০ শতাংশ লোক স্বাধীনতা চায়।

তবে এই চাওয়ার মধ্যে কিছু কথা আছে। যারা শিক্ষিত, সম্পদশালী-তারা ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়। তারা দিন দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা বলছে ভারত তাদের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। বাইরের কেউ এখানে এসে বসবাস করতে পারবে না। তাদের আইন তারা নিজেরাই তৈরি করতে পারে। তাই ভারতের সঙ্গে থাকাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। ভারতের সমস্ত প্রদেশের মানুষজনও কাশ্মীরিদেরকে সমীহ করে।

মনে রাখা ভাল, কাশ্মীরে শিক্ষার হার যথেষ্টই কম। কাশ্মীর হতে পারে ‘ভূ-স্বর্গ’। কিন্তু ওখানকার মানুষজন অত্যন্ত দরিদ্র। যে ৭০ শতাংশ লোক পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চায়-তাদের সহজ সরল মন। তাদের ধারণা-ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানই বুঝি তাদেরকে শান্তি দেবে। কিন্তু এটা কি আদৌ সত্যি হতে পারে?

যে পাকিস্তানে প্রতিদিন বোমাবাজি হয়-মসজিদে আর মাজারে, যে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে প্রায় দেউলিয়া হয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে, সেই দেশের সেনাবাহিনীর গুপ্তচরেরা সহজ সরল দরিদ্র কাশ্মীরিদের মগজ ধোলাই করে। কাশ্মীরি বালকেরা সেনাবাহিনীকে দেখে পাথর ছুঁড়ে। জঙ্গি হয়। আত্মঘাতী হয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে ধ্বংসলীলা করে।

কাশ্মীরি ছেলেরা একটু পড়াশোনা করলেই চাকরি পায়। কিন্তু পড়বে কে? সব কিশোর-কিশোরীরাই জন্মের পর শুনতে থাকে-ভারত ‘কাফেরদের দেশ’। ওদের বিরুদ্ধে জেহাদ করলে শহীদ হলেই জান্নাত। ২০১৫ সালে কাশ্মীরে ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ভারত সরকার। ১৫ হাজার লোক আবেদন করেছিল মাত্র। ভারতের অন্য রাজ্যে হলে আবেদনকারীর সংখ্যা ১৫ লাখ হয়ে যেত। কট্টরপন্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছিল, ‘এই সরকারের অধীনে চাকরি করলে ঈমান থাকবে না’।

যাই হোক, বর্তমান সময়টা আম জনতার মতামতকে সন্মান জানানোর সময়। মতামত ভালো খারাপ যাই হোক না কেন? এই আমজনতারাই মোদি আর ট্রাম্পের মতো কট্টরপন্থীদের নির্বাচিত করে। কাশ্মীরের আম জনতাও বিশ্বের অন্যান্য এলাকার মতোই হুজুগে মাতে।

ভারতের দোষ কতটুকু?

এটা সম্পর্কে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করার বিপদ আছে। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ আছে নাকি যে ইচ্ছা করে তার ভূখণ্ড অন্যকে দিয়ে দেবে? এটা কি সম্ভব? এটা ঠিক যে, কোনো এক পরিস্থিতিতে কাশ্মীর দখলে নিয়েছে ভারত। অরুন্ধতী রায়ের মতো ভারত বিখ্যাত লেখকও বলেছেন, ‘কাশ্মীর কোনোদিন ভারতের অংশ ছিল না।’

এটা সত্যি বটে। তবে, কাশ্মীরের লোকজনকে বশে আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে ভারত। তাদেরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু বিজেপির যুক্তি হলো, একটা দেশে সবগুলো রাজ্য একই নিয়ম অনুসরণ করবে। গণতান্ত্রিক নিয়মে কোনো রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেবে কেন?

আর বিশেষ মর্যাদা দিয়ে তো কোনো লাভ হয়নি। কাশ্মীরের লোকজন তো ভারতকে আপন করতে পারল না। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হলে এখনও পাকিস্তানের নামে গলা ফাটায় কাশ্মীরিরা। কাশ্মীরের লোকজনকে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য সবদিক দিয়ে সহায়তা করতে চায় ভারত। কিন্তু ওরা চায় পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে। এটা ভারত মানবে কোন যুক্তিতে?

কাশ্মীর না হয় গরিব, কিন্তু স্পেনের কাতালান প্রদেশ (যার রাজধানী বার্সেলোনা) এত সম্পদশালী হয়েও তো স্বাধীন হওয়ার জন্য কারও সমর্থন পায়নি। বিশ্বে আর বোধ হয় স্বাধীন দেশ হওয়ান জন্য কোনো সংগ্রামকে কেউ সমর্থন করবে না। কাশ্মীরের ভাগ্যে খুব সম্ভবত তাই ঘটতে যাচ্ছে। তবে ভারতের সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে তড়িঘড়ি করে বিশেষ মর্যাদা বাতিল না করে, কাশ্মীরি লোকজনকে বেসামরিক উপায়ে শান্তির পথ দেখাতে না পারা।

বিজেপিরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী যেমন-কাশ্মীরিয়ত, ইনসানিয়ত, জমহুরিয়ত-এই তিন নীতির ভিত্তিতে কাশ্মীরে শান্তি আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের হাতের পুতুল মোদী-অমিত শাহের সেই পথে যেতে বয়েই গেছে।

এখন কী হতে পারে?

জন্মুু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল তো হলোই। এখন কাশ্মীর কোনো রাজ্যই নয়। লাদাখকে আলাদা করে দুই টুকরো করা হলো। যদিও অমিত শাহ বলেছেন, পরিস্থিতি শান্ত হলেই কাশ্মীরকে আবার রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হবে। রাজ্যের মর্যাদা না হয় পাবে, কিন্তু বিশেষ মর্যাদার প্রতীক ৩৭০ ধারা আর ৩৫-ক ধারা তো বাদ। এখন কাশ্মীরে ভারতের যে কোনো প্রদেশের লোকজন স্থায়ীভাবে জমি কিনতে পারবে। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের কারণে ভালো-খারাপের মিশ্রণে দুই রকম অভিজ্ঞতারই মুখোমুখি হতে হবে কাশ্মীরিদের।

ভালো দিকটা হলো-কাশ্মীরে এখন ভারতের অন্য এলাকার বিনিয়োগকারীরা জমি কিনে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি আসলে দরিদ্র কাশ্মীরিদের অবস্থার উন্নতি হবে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে অনেক ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে।

কাশ্মীরিদের মেডিকেল শিক্ষা নিতে বাংলাদেশে আসার মূল কারণ একটাই, তারা মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে আসবে কিন্তু ভারতের অন্য প্রান্তে যেতে তাদের তীব্র অনীহা। ভারতের সব প্রান্তের লোকজনের সাথে আরও বেশি করে চললে কাশ্মীরিদের মন-মানসিকতা আরও উদার হবে, পাকিস্তান প্রীতি কমবে। ধীরে ধীরে ভারতীয় হয়ে উঠার চেষ্টা করবে কাশ্মীরিরা।

খারাপ দিক হলো, ভারতীয় পুঁজিপতি আর হিন্দুত্ববাদীরা কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে জনমিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলবে। না জানি কোনো একদিন মুসলমানরাই কাশ্মীরে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। অনেকটা বাংলাদেশের সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান মডেল। পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের ঢুকিয়ে তিনি পাহাড়িদেরকেই সংখ্যালঘু বানিয়ে ফেলার কাজটি শুরু করেছিলেন। ভারতের প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকলে আত্মঘাতী হামলা আরও বাড়বে। পাকিস্তান এখন আরও জোরেশোরে মদদ দেওয়ার কাজ করবে।

সময়ই বলে দেবে-কি হবে? তবে তাড়াতাড়ি কাশ্মীর উপত্যকায় যে শান্তি ফিরবে না-এটা মোটামোটি নিশ্চিত।

লেখক: পরিচালক, ইংলিশ অ্যাডভেঞ্চার

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কার্যালয়ের সামনে দুই ককটেল বিস্ফোরণ
৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১৬৯০ জন
এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও যোদ্ধাদের স্মরণে ‘বিআরপি’র মশাল মিছিল
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা