৭১ সালে ৯ মাস ঢাকায় থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি

মাহফুজা খানম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৫০ | প্রকাশিত : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:০৫

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যে ৬ দফা দাবি পেশ করেছিলেন তা আমি এবং সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মানুষের কাছে বিশেষভাবে ছাত্রসমাজের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কাজ করেছিলাম। এরপর ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান হয়। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং সত্তরের নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী সংকটে যারা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে সংগ্রাম করেছেন তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।

১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে একদিনে প্রায় দশ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। অথচ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এই দুর্যোগকবলিত অঞ্চলের মানুষের জন্য কিছুই করেনি। ফলে জনসাধারণের মাঝে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল সেটাকেও আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। এরপর সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যখন বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন, সেই ভাষণের মধ্যদিয়েই স্বাধীনতার ডাক এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের রেশ অনুভব করি।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস পুরোটাই ঢাকার রাজপথ আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল ছিল। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, শ্রমিকসংগঠন, শিক্ষকসংগঠন থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ রাজপথে মিছিল-মিটিং করছিল। আমিও তখন পাঁচ মাসের ছোট্ট শিশুর মা হওয়া সত্ত্বেও পুরো মাস মিছিল-মিটিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছি। সেসময় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছিল আমাদের তীর্থস্থানের মতো। সেখানে একটি হাত মাইকে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মধ্যদিয়ে দিনের কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটত। এমনকি আমার মাতৃত্বকে অস্বীকার করেই যেন আমি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমরা তখন থাকতাম পুরানা পল্টনে, পঁচিশে মার্চ কালো রাতে হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর ২৬ তারিখ থেকে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ২৮ তারিখে সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলে আমার বাবার বাড়ি স্বামীবাগে যাই। এ সময় পথের ধারে প্রচুর লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম।

ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম শীর্ষ নেত্রী হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের করণীয় সম্পর্কে এসময় কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদের সাথে আমি পরামর্শ করি। তবে কোলে শিশু থাকায় দলীয় নেতৃবৃন্দ আমাকে ঢাকায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তাই যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাস ঢাকায় অবস্থান করে শহীদুল্লাহ কায়সার ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ অন্যদের সাথে কাপড়, ওষুধপত্র, অর্থ এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম।

আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতাম। ঢাকায় অবস্থিত বাংলা-ইউএস গ্রন্থাগার এবং সেসময় মতিঝিলে অবস্থিত টেলিভিশন টাওয়ারসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এছাড়া আগরতলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী নেতাদের নীতি-কৌশল ও নির্দেশাবলী অনুসারে লিফলেট-পোস্টার তৈরি করে ঢাকায় সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করেছি।

আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলাম, তাই সেখানে থাকা সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রের সাহায্যে আমরা লিফলেট ছাপাতাম। আমরা ঘরে ঢুকে যখন কাজ করতাম তখন বাইরে থেকে পিওনকে বলতাম দরজায় তালা লাগিয়ে রাখার জন্য এবং লিফলেট ছাপানোর কাজের জন্য আমরা রসায়ন বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করতাম।

তখনো একইভাবে ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে আমরা সেসব উপকরণ সংগ্রহ করতাম। সেসময় সারা দেশের মানুষই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের সামর্থ্য ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। যেমন আমাদের এসব কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জনশক্তি আমাদের সহযোগিতা করেছিল।

অনুলিখন: দিতি আহমেদ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :