এখনো আম্পানের লোনাজলে ডুবা কয়রার হাজারো বাড়ি, বিপর্যস্ত জীবন

ইমদাদুল হক, পাইকগাছা (খুলনা)
 | প্রকাশিত : ১৯ জুন ২০২০, ১১:৩৪

গ্রা্মের পর গ্রাম জুড়ে লোনাপানিতে ডুবে আছে বাড়িঘর। উঠানে বুক সমান পানি। এমনি এক গ্রামের ইসরাফিল হোসেন সরদার সংসার নিয়ে কয়রার গোবরা বাজারের দোকানঘরে উঠেছেন। দোকানের মেঝেতে পাতা চৌকিটাও পানিতে ডুবে আছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় এটি। ভাটায় মেঝের পানি কিছুটা নেমে গেলে তার ওপরে বসবাস তাদের।

ইসরাফিলের স্ত্রী আকলিমা বেগম চৌকির ওপর পাতানো চুলায় দিনে-রাতে একবার রান্না করতে পারেন। ভাটার সময়। চৌকির ওপরে রান্না, খাওয়া ও ঘুমানো। রাতে স্ত্রী আকলিমা ছেলেমেয়ে নিয়ে চৌকির ওপরে ঘুমান। ডুবন্ত ঘরের পাশে ডিঙ্গি নৌকায় ঘুমান ইসরাফিল।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবের পর গত এক মাস ধরে কয়রার গোবরা, হরিণটানা, হাজতখালীসহ প্রায় অর্ধশত গ্রামের চিত্র এমনই। আম্পানে বাঁধ ভেঙে লোনাপানিতে সব সয়লাব হয়ে যাওয়ায় ইসরাফিলদের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গোবরা গ্রামের ইট বিছানো রাস্তা জোয়ারের সময় কোথাও থাকে হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি। রাস্তার দুই ধারের ঘরবাড়িগুলো পানিতে ডুবে আছে। বাড়িতে যাতায়াতের পথে বাঁশের সাঁকো। ঘরে ঘরে সাঁকো এখন চলাচলের পথ। ঘরের ভিতর মাঁচা তৈরি করে কোনো রকমে তার ওপরে বসবাস। গ্রামের রাস্তার দুই ধারে থইথই পানি। ডুবে আছে ঘরবাড়ি, মৎস্য ঘের, ফসলের ক্ষেত।

গোবরা ঘাটাখালী ভাঙা বাঁধের পাশে দিনমজুর গণি সরদারের বাড়ি। তার স্ত্রী মাকছুদা পানিতে কাজ করছেন। ঘরের মেঝে পানিতে ডুবু ডুবু। তিনি বলেন, ‘সারা দিন এই লোনাপানির মধ্যে থাকি। যাওয়ার তো জায়গা নেই। ঘরের মধ্যে পানি। ফসলের ক্ষেত, চলার পথ সবকিছু ডুবে আছে। টয়লেট, পানির কলটাও ডুবে গেছে। গ্রামের অনেক কল নষ্ট হয়েছে গেছে। ভাটার সময় দুরের কল থেকে পানি আনতে হয় লোনাপানি সাঁতরে।’

নাজুক বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে। অনেককে খোলা আকাশের নিচে বাঁধের ওপর ঘুমাতে হয়। টয়লেট ডুবে থাকায় অপেক্ষা করতে হয় ভাটার সময় কখন পানি কমে যাবে। পানি কমলে টয়লেটে যাওয়া।

গোসল করতে হয় লোনাপানিতে। কখনো কলের পানিতে। গোবরা গ্রামের নব্বই-ঊর্ধ্ব বৃদ্ধ ইমান আলী (৯৫) বলেন, ‘জীবনে কত ঘূর্ণিঝড় দেখলাম, কিন্তু এমন ঝড় দেখিনি। লোনাপানিতে সব তলিয়ে গেছে। পানি নামছে না আর। এই লোনাপানিতে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছে সবাই।’

হাজতখালীর ভাঙা বাঁধের পাশে ছোট বাচ্চাদের লোনাপানি থেকে বাঁচাতে ড্রামের ভেতরে পানি দিয়ে গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপকূলের জীবনযাপনে তৈরি হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা।

কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হাজতখালী গ্রামের সবার সংসার এখন হাজতখালীর বেড়িবাঁধের ওপরে। বাঁধের ওপর আর কোনো জায়গা নেই। যে যেখানে পেরেছে খুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস করছে। বাঁধের হাজতখালী স্লুইজ গেট থেকে কাশিরহাটখোলা পর্যন্ত অংশটুকু ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। এই আধা কিলোমিটার বাঁধে কয়েক শ পরিবার ঘর বেঁধেছে। খাবার পানি, টয়লেট, রান্নার জায়গা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সবকিছু মিলেমিলে একাকার। খাদ্য ও খাবার পানি সংকটে ভুগছে মানুষ।

কয়রার বেঁড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলা পরিষদও তলানো। লোনাপানি ঢোকায় এলাকার মিঠাপানির আধার নষ্ট হয়েছে। অকেজো হয়েছে উপজেলার ৯০০ নলকূপ। তাছাড়া ব্যক্তিগত আরও ৩০০ নলকূপ নষ্ট হয়েছে। ফলে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের জলোচ্ছ্বাসের পর পানি দ্রুত নেমে গিয়েছিল। ২০০৯ সালে আইলার জলোচ্ছ্বাসের পানিও নামতে বেশি সময় নেয়নি। ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ফণি ও বুলবুলের আঘাতে তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু গত ২০ মে আম্ফানের তাণ্ডবে বাঁধ, ঘরবাড়ি, রাস্তা, ফসলের ক্ষেত সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

উপজেলার কয়রা সদর, উত্তর বেদকাঁশী, দক্ষিণ বেদকাঁশী ও মহারাজপুর ইউনিয়নের ৫২টি গ্রামে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অন্য তিনটি ইউনিয়নেরও আংশিক এলাকায় পানি সংকট রয়েছে।

খুলনা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে কয়রা সদরে দুটি ভ্রাম্যমাণ প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। প্রশাসনের লোকজন সদর থেকে বিশুদ্ধ পানি নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে দিচ্ছে। তাছাড়া চলতি বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ২৩৮টি তিন হাজার লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন পানির ট্যাংকি দুর্গত এলাকায় বিতরণ করা হচ্ছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু জানান, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সেবা দিতে সরকারি সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত আছে। খাওয়ার পানি পেতে কাউকে যাতে কষ্ট করতে না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণালয়ে যোগাযোগ করেছেন তিনি।

সংসদ সদস্য আরও জানান, লোনাপানি থেকে মুক্ত হলে ক্ষতিগ্রস্ত ৩২টি গ্রামে গভীর নলকূপ, পুকুর খনন, পানির প্লান্ট নির্মাণ এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য পানির ট্যাংকি সরবরাহ করা হবে।

এক মাস ধরে লোনাপানিতে ভাসছে কয়রা। থইথই লোনাপানির সঙ্গে যুদ্ধ করে করে করে হয়রান কয়রা বাঁধভাঙা এলাকার মানুষ। জনজীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। দুর্গত এলাকার মানুষের কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। প্লাবিত লোনাপানি কবে শুকাবে সে অপেক্ষায় হাজারো নারী-পুরুষ-শিশু।

(ঢাকাটাইমস/১৯জুন/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :