মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

মো. মুজাহিদুল ইসলাম নাঈম, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ০১ মে ২০২৪, ১০:২৩| আপডেট : ০১ মে ২০২৪, ১০:২৯
অ- অ+

মহান মে দিবস। শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক এ দিনটি বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের সম্মানে ১ মে সাধারণ ছুটি। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ এই মে দিবস পালন করে। কিন্তু যাদের নিয়ে এই দিবস, তাদের বেশির ভাগই ‘মে দিবস’ কী, কী কারণে দিনটিকে ‘মে দিবস’ বলা হয়- তা জানে না। তারা শুধু জানে, একদিন কাজ না করলে পরের দিন পরিবারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে। তাই জীবন-জীবিকার তাগিদে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয় তাদের।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজারের মধ্যবর্তী স্থানের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বালু ও কয়লার ব্যবসা। এখানে লোড-আনলোডের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে শতশত নারী ও পুরুষ শ্রমিক।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তুরাগ নদীর তীরে এসে ভিড়িছে বালুভর্তি বাল্কহেড। তীব্র গরম ও খরার মধ্যে বাল্কহেড থেকে বালু আনলোড করছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা। কেউ টুকরিতে বালু ভরছেন, আবার কেউ বালুভর্তি টুকরি মাথায় করে নিয়ে ঘাটের ওপরে নির্ধারিত স্থানে স্তূপ করে রাখছেন।

কাজের ফাঁকে কথা হয় এই শ্রমিকদের সঙ্গে। আলাপচারিতায় বেরিয়ে আসে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী।

মো. রাজিব হোসেন মাধ্যমিক পাস করে গার্মেন্টসে চাকরি শুরু করেন। করোনা মহামারির কারণে চাকরি হারান তিনি। তারপর শুরু করেন কয়লা ও বালু শ্রমিকের কাজ।

রাজিব বলেন, “এই রোদ আর গরমের মধ্যে কাজ করতে কারোরই ভালো লাগে না। যার যার টাকার প্রয়োজনে কাজ করছি। আমি গার্মেন্টসে চাকরি করতাম। করোনার সময় আমার চাকরি চলে যায়। তারপর থেকে এসে এই কাজ করছি। একদিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পাই। এখানে কাজ করে যা পাই তা দিয়ে আমি কোনো রকমে চলতে পারি। বাড়িতে বাবা-মা থাকে। তাদেরকে টাকা দিতে পারি না।”

মে দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজিব বলেন, “আমাদের দিবস বলে কিছু নাই। এই দিনেও আমরা কাজ করি। আমরা কাজ না করলে মালিকদের কিছু বলার থাকে না। কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না। কাজ করলে খাবারের ব্যবস্থা হবে আর কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে।”

পারুল নামে এক নারী শ্রমিক বলেন, “শ্রমিক দিবস আবার কী? হেইডা জাইনেই বা আমাগো কী হবি? একদিন কাম না হররি পরের দিন না খাইয়ে থাহা লাগবি। আমাগো কোনো দিবস নাই। প্রতিদিনই আমাগো কাম হরা লাগে।”

শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার এক ফাঁকে ছবি তুলছিলেন এই প্রতিবেদক। ছবি তোলা দেখে পাশ থেকে এক শ্রমিক এগিয়ে এসে বলেন, “ভাই ছবি তুলে কী হবি কন? কত সাংবাদিক তো আইসে ছবি তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু কোনো সাহায্য তো এই পর্যন্ত আমরা পালাম না। আমাগো মজুরিও তো বাড়ে না।”

তিনি বলেন, “করোনার সময় না খাইয়ে থাকতি হইছে আমাগো। কেউ একটা দিনের জন্যও কোনো খোঁজ নেয় নাই। আমাগো স্বার্থ কেউ দেখে না ভাই। সরকার যদি আমাগো কথা একটু ভাবতো তাইলে আমারা পরিবার নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারতাম।”

গাবতলীর বালু ও কয়লার ঘাটে টানা ১৬ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, “আগের মতো এখন আর তেমন ইনকাম নেই। মেশিন আসাতে লেবারের কাজ কুমে গেছে। এখন একদিনে ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো, কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়।”

শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা পাব, না করলে পাব না। তাই করাই লাগে। আমাগো কোনো ছুটির দিন বলে কিছু নাই।”

মেশিন আসায় ইনকাম কমেছে জানিয়ে বালু ও কয়লা শ্রমিক মো. হান্নান বলেন, “চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগের মতো ইনকাম নেই এখন। আগে ভালোই হতো, এখন আর হয় না। আগে এতো মেশিন ছিল না। সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।”

তিনি আরও বলেন, “আগে মেশিনও ছিল না, শ্রমিকও কম ছিল। তাই শ্রমিকদের চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন মেশিনের পাশাপাশি শ্রমিকও বেশি। তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।”

শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাদেরকে টালি গুনে মজুরি দেওয়া হয়। আট টুকরি বালু টানলে দেওয়া হয় ২০ টাকা আর ছয় টুকরি কয়লা টানলে দেওয়া হয় ২০ টাকা। যে যত বেশি কাজ করতে পারবে, সে ততবেশি টাকা আয় করতে পারবে।

আবির নামে এক শ্রমিক বলেন, “আমাদের টালি গুনে টাকা দেয়। ৮ টুকরি বালুতে ২০ টাকা পাই আর কোনো কোনো সময় কয়লায় ৬ ঝুড়িতে ২০ টাকা পাই। সারাদিন বালু-কয়লা টেনে যে কয়টা টালি যোগাড় করতে পারি, কাজ শেষে সেই টালি গুনে টাকা বুঝে নেই “

এই শ্রমিক আরও বলেন, “আমাদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন নেই। যার শরীরে যতক্ষণ কুলায় কাজ করে। মন না চাইলে করে না।”

তিনি বলেন, “কেউ কেউ অনেক পরিশ্রম করে। তারা সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন কাজ করে। আবার অনেকে হাফ বেলা কাজ করে।”

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “আমাদের কর্মসংস্থান নেই। হাজার হাজার মানুষ বেকার। তার মধ্যে আবার মেশিনের ব্যবহার বাড়ায় শ্রমিকের কাজ কমেছে। অল্প বিছু শ্রমিক যারা কাজ করছে, তাদের মজুরিও কম। জীবন বাঁচানোর জন্য যেকোনো মজুরিতে তারা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “এই শ্রমিকদের জন্য দরকার একটা জাতীয় নুন্যতম মজুরি। যে কোনো ধরনের শ্রমিক হলেই তাদের জন্য নির্ধারিত একটা মজুরি নির্ধারণ করে দিতে হবে। এ জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি করেছি একটা জাতীয় মজুরি কমিশন গঠন করে দেয়ার, যাতে কোনো শ্রমিকদের মালিকপক্ষ এর কম বেতন দিতে না পারে।”

(ঢাকাটাইমস/০১মে/এমআই/এফএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
লিটারে ১ টাকা কমল সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম
নারী সংস্কার কমিশন মানি না, বাধ্য করলে আন্দোলন: জামায়াত আমির
এবার চিন্ময়ের জামিন স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার, শুনানি রবিবার
গুলশানে নসরুল হামিদের ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রোক
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা