প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের অপহরণকাণ্ড: ১৬ দিনেও গ্রেপ্তার হননি আলোচিত লুৎফুল হাবীব

তাওহিদুল ইসলাম, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ০২ মে ২০২৪, ১৮:২৫ | প্রকাশিত : ০২ মে ২০২৪, ১৮:০৭

নাটোরের সিংড়া উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন ও তার স্বজনদের গত ১৫ এপ্রিল জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। এই অপহরণের অভিযোগ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক ও সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লুৎফুল হাবীব রুবেলের বিরুদ্ধে। ঘটনার ১৬-১৭ দিন পার হয়ে গেলেও অধরাই রয়ে গেছেন লুৎফুল। এখন পর্যন্ত অপহরণকাণ্ডে তার বিচার বলতে নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, এটুকুই। এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

এ ঘটনায় গত ১৬ এপ্রিল দেলোয়ার হোসেনের মেঝো ভাই মো. মজিবর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলায় আসামি অজ্ঞাতনামা হলেও গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেই জবানবন্দির প্রেক্ষাপটে আসামি গ্রেপ্তার হয়। এছাড়া আরেকটা বিষয় হলো, এই অপহরণের ঘটনায় যে বা যারা সুবিধাভোগী তারাই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে। এটা আইন বলে দেবে।’

এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত সুমন নাটোরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রওশন আলমের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি জেলা নির্বাচন কার্যালয় ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণ ও মারধর করার কথা স্বীকার করেছেন। দেলোয়ার হোসেনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী লুৎফুল হাবীবের পক্ষ নিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন সুমন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান।

কিন্তু মামলা করার ১৬-১৭ দিন পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রী পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীবকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লুৎফুলকে ধরতেও অভিযান চলছে। তবে তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজনের মধ্যে দুজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। লুৎফুলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দেলোয়ার হোসেনের বড় ভাই এমদাদুল হক বলেছেন, নির্বাচন অফিসের সামনে থেকে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যায় লুৎফুল হাবীব রুবেলের সন্ত্রাসী বাহিনীর মোহন ও তার লোকজন। সেখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করে তাকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়।

সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে মারধর ও অপহরণের কাজে ব্যবহৃত কালো রঙের হায়েস মাইক্রোবাসটি জব্দ করেছে পুলিশ। পরে ওই মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালিয়ে অভিযুক্ত প্রার্থী লুৎফুল হাবীবের প্রচারপত্রসহ নানা সরঞ্জাম ও অস্ত্র পাওয়া যায়। গত ২০ এপ্রিল সন্ধ্যায় সিংড়ার শেরকোল ইউনিয়নের দুর্গম চকপুর গ্রামের আতাউর রহমানের বাড়ি থেকে মাইক্রোবাসটি জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আতাউর রহমানকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মাইক্রোবাস জব্দ ও একজনকে গ্রেপ্তারের পর গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এসব তথ্য জানান নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, জব্দ করা মাইক্রোবাসের (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৬-৫৩৯৫) ভেতর প্রার্থী লুৎফুল হাবীবের নির্বাচনি প্রচারপত্র ও পোস্টার পাওয়া গেছে। এছাড়া ওই প্রার্থীর প্রাইভেটকারের চালক সুজন সাহার ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির কাগজপত্রও পাওয়া গেছে। এছাড়া মাইক্রোবাসটি তল্লাশি করে দুটি চায়না চাপাতি, একটি টিপ চাকু, একটি বর্মিজ কাটার, দুটি রামদা, দুটি স্টিলের পাইপ, দুটি স্ট্যাম্প ও একটি দেশি চাপাতি জব্দ করা হয়েছে।

পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আমরা পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছি। তাকেও (লুৎফুল হাবীব) ধরতে অভিযান চলমান আছে। লুৎফুল এলাকাতে নেই।’

নাটোর থানার ওসি মো. মিজানুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুজনের ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে এবং দুটি গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।’

আদলাতে জবানবন্দিতে লুৎফুল হাবীবের সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছেন আসামিরা। এক্ষেত্রে হাবীবের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘মামলার তদন্ত তো শেষ হয়ে যায়নি, ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের প্রত্যেকটা কাজ আইনগতভাবেই আগানো হচ্ছে। পুলিশি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

লুৎফুল হাবীব প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক হওয়ায় পুলিশের কাজে কোনো বাধা আছে কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘না, আমাদের কাজে এখানে কোনো বাধা নেই।’

সিংড়া উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. আনিসুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এ ঘটনা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের সামনে ঘটেছে। এটা ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে। এতে মামলা হয়েছে। কিছু আসামি ধরা হয়েছে, কিছু ধরতে প্রক্রিয়া চলছে।’

এদিকে মামলা করার সময় আসামিদের নাম উল্লেখ না করার বিষয়ে বাদী মো. মজিবর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমরা কাউকে দেখতে পারিনি বলে মামলায় অজ্ঞাত আসামি করেছি। ঘটনার সময় আমি ছিলাম সিংড়াতে। আর অপহরণ করা হয়েছে নাটোর থেকে। এ জন্য অজ্ঞাত আসামিদের নামে মামলা করতে হয়েছে। তবে এতটুকু নিশ্চিত ছিলাম যে আমাদের সঙ্গে কারো ব্যক্তিগত শক্রতা নেই, যা হয়েছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই।’

মজিবর রহমান বলেন, ‘এখন সবকিছু দিনের আলোর মতো ফুটে উঠেছে। আমরা এই ঘটনার সঠিক বিচার চাই। দোষীরা শাস্তি পাক এটাই আমি আশা করি।’

এদিকে অভিযোগ আছে, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে শ্যালককে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী করতে নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ও নাটোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলক। নিজের শ্যালক উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুল হাবীব রুবেলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে আনতে বাকি প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশও দেন তিনি।

এছাড়া নির্বাচনি মাঠে চার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হওয়া নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক রুবেল। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে গত ২৯ মার্চ তার ঢাকার বাসায় সমঝোতা বৈঠক হয়। সেখানে ছিলেন জাহেদুল ইসলাম ভোলাসহ সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস, আরিফুল ইসলাম, মাওলানা রুহুল আমিন ও পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীব রুবেল। সেখানে লুৎফুল হাবীবকে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন পলক। তবে পলকের সেই নির্দেশনা না মেনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন দেলোয়ার হোসেন।

এরপর গত ১৫ এপ্রিল উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য দেলোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন ব্যাংকে জামানতের টাকা জমা দেওয়ার জন্য বের হন। এ সময় তারা জরুরি প্রয়োজনে নাটোর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সামনে গেলে সেখান থেকে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত আলাউদ্দিন মুন্সিকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে দেলোয়ার হোসেন নির্বাচন অফিস থেকে নেমে এলে তাকেও একটি মাইক্রোবাসে করে তুলে নেয়। এ সময় তারা দেলোয়ারকে গাড়ির ভিতর মারধর করেন। পরে বিকালে সিংড়া উপজেলার কলম ইউনিয়নের পারসাঐল গ্রামে দেলোয়ার হোসেনের বাড়ির সামনে তাকে ফেলে দিয়ে চলে যায়।

এ ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়- মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় ও নিজস্ব লোক উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এমনকি তারা কারও পক্ষে কাজও করতে পারবেন না বলে নির্দেশ দিয়েছে দলটি। এরপর জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশে তার শ্যালক প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।

(ঢাকাটাইমস/০২মে/টিআই/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :