মৈত্রী দিবস: নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের ৫০ বছর

শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
 | প্রকাশিত : ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১৭

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভিত রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিকভাবে এই দুই দেশের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সরকার যে সহায়তা করেছিল তা বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না।

স্বাধীনতার সময় থেকে দুটি দেশ যে ঐক্যের ভিত্তিতে নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ‘দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তা’ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। বোদ্ধারা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের চুক্তি যথার্থ ছিল বলে মতামত ব্যক্ত করেন।

স্বাধীনতার সময় থেকে দুটি দেশ যে ঐক্যের ভিত্তিতে নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। এই বছরের মার্চ মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। ঐ সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ৬ ডিসেম্বরকে মৈত্রী দিবস হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর ৬ ডিসেম্বর দুই দেশে সাড়ম্বরে মৈত্রী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তার বিবেচনায় বাংলাদেশ-ভারত দুটি দেশ পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে, এটাই বাস্তবতা। এ সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের জন্যও। দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক অগ্রগতি আছে অনেক, পাশাপাশি ব্যর্থতা বা ভুল–বোঝাবুঝি যে নেই তা নয়। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনকালে বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য সূচিত হয় দীর্ঘকাল ধরে অমীমাংসিত থাকা গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে।

মাঝে কিছুটা সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক সম্পর্ক বিরাজমান থাকলেও ২০০৮-এর শেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফেরার মধ্য দিয়ে আবারও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়নের একটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ২০০৮ থেকে ২০২১ টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় আছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন তিনি সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং জনপ্রিয় বিশ্বনেত্রী।

গত ১৩ বছরে দুটি দেশের সম্পর্ক একটি বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছেছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধান এসেছে গত ১৩ বছরে। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের পাঁচটি সর্ববৃহৎ রপ্তানিকৃত দেশের তালিকায় রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণও ক্রমবর্ধমান। বার্ষিক ভিত্তিতে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ভারতের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩.১৬ বিলিয়ন ইউ এস ডলার। অর্থাৎ এই সময়কালে বহির্বিশ্বে ভারতীয় রপ্তানির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। এই পরিসংখ্যান থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার সেটি হল দুই দেশের বানিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারত উপমহাদেশের দুটি রাষ্ট্র হবার কারণে দুই দেশের সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে বিধায় আবহমানকাল থেকেই উভয় দেশ সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। দুই দেশেই ক্রিকেট খেলা সমানভাবে জনপ্রিয়। বিভিন্ন টুনামেন্ট, সিরিজ খেলায় দুই দেশের অংশগ্রহণ সম্পর্ককে আরো মজবুত করেছে।

দুই দেশের সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য ভারত সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য যে বৃত্তি চালু করেছে সেটি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলেছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল কালচারাল রিলেশনস এর আওতায় বৃত্তির সাথে সাথে আরো বেশ কয়েকটি সেক্টরে ভারত সরকার বৃত্তি চালু করেছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল মৈত্রী বৃত্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য বৃত্তি এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু চেয়ার বৃত্তি।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১৬ লাখ পর্যটক ভারত সফরে যান। এছাড়াও অনেকে চিকিৎসা সেবা নিতেও ভারতে যান। ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা প্রদান করা হলে উভয় দেশ যেমন লাভবান হবে, একই সাথে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে যেমনটি আমরা ইউরোপে দেখতে পাই। আঞ্চলিক আন্তঃদেশীয় সড়ক যোগাযোগ চালু করার বিষয়টি উভয় দেশের সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। এই যোগাযোগ শুরু হলে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্প্রসারণের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হবে। এটি চালু হলে শুধু ভারত নয়, আমাদের আশেপাশের দেশগুলোর সাথেও বাংলাদেশের বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে ধারণা করা হয়।

এখানে অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পদ্মার পানি বণ্টন চুক্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধান এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা। তবে দুটি দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হলেও বেশ কয়েকটি বিষয়ে এখন পর্যন্ত ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং সীমান্তে হত্যা। তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে করা সম্ভব হচ্ছে না। এই মর্মে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিবৃতি প্রদান করলেও আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত দুই দেশের সম্পর্ককে উন্নত করতে হলে ভারত সরকারের উচিত যে কোন প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে এই চুক্তি সম্পন্ন করা। এই চুক্তি হলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনগণকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

অন্যদিকে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য দুটি দেশের উচ্চ পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও সময়ের ব্যবধানে মাঝে মাঝে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড দুটি দেশের সম্পর্ককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে বিধায় এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা উচিত।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এতটা মজবুত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে যে পৃথিবীর অনেক দেশ এই সম্পর্ককে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন মোড়ল রাষ্ট্র চেষ্টাও করছে এই সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাবার জন্য। উভয় দেশের সরকার প্রধানদের উচিত এই বিষয়টিতে সচেতন থাকা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চেয়েও জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কটা অনেক মজবুত ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং, যে সমস্ত বিষয়ে এখনও ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি সে বিষয়গুলোতে ঐক্যমতে পৌঁছানোর মাধ্যমে এই সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ই হতে পারে এবারের মৈত্রী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :