ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে সোনালী ব্যাংকের চমক

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবায় বেসরকারি ব্যাংকের আধিপত্যের মধ্যেও চমক দেখিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। করোনাকালীন প্রান্তিক মানুষের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছানোর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বেশিরভাগ অগ্রগতি এসেছে বিশেষ করে গত দুই বছরে। এর মধ্যে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বিকাশ অ্যাপের সঙ্গে লেনদেন, ব্লেইজ অ্যাপের মাধ্যমে পাঁচ সেকেন্ডে টাকা জমা করাসহ বেশ কিছু উদ্ভাবনী সেবা দিচ্ছে ব্যাংকটি। আর এমন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ব্যাংক গ্রাহকরা এমন সেবা পেয়ে দারুণ খুশি। সোনালী ব্যাংকের নীরবে বদলে যাওয়ার নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছে ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী টিম।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক লেনদেনের অ্যাপ পেপালের জুম সেবা নিয়ে আসে সোনালী ব্যাংক। তবে বর্তমানে ব্লেইজের মাধ্যমেই বেশি জোর দিচ্ছে ব্যাংকটি।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধান অতিথি হিসেবে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে ব্লেইজের সেবা উদ্বোধন করেন। জয় পেপাল জুম সেবাও উদ্বোধন করেছিলেন।
বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের এক হাজার ২২৭টি শাখায় প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে, ফলে গ্রাহকরা তাৎক্ষণিক লেনদেন করতে পারছেন। পাশাপাশি সোনালী ই-সেবা অ্যাপের মাধ্যমে সরকারি ফি জমা দেওয়া যায় নিমেষেই, যা একসময় কল্পনাতীত ছিল।
সোনালী ব্যাংকের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বেশির ভাগ রূপান্তর ঘটেছে গত দুই বছরে। প্রযুক্তি উন্নয়নে পাঁচ শতাধিক কর্মী কাজ করছেন। পাশাপাশি সোনালী ইনটেলেক্ট নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি হিসেবে। সেখান থেকেই কোর ব্যাংকিং সেবাসহ সব ডিজিটাল সেবার গবেষণা ও উন্নয়ন করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় সোনালী ব্যাংকের প্রযুক্তিগত রূপান্তরকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক ড. শাহ মোহাম্মদ আহসান হাবীব। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের প্রযুক্তিতে অনগ্রসরতার যে ধারা ছিল, সোনালী ব্যাংক সেখানে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় টেক অ্যাডাপ্টেশনের বিকল্প নেই। সোনালী ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ভালো বিনিয়োগ এবং গবেষণা করছে।
প্রযুক্তি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সেবার মান ধরে রাখার পরামর্শ দেন আর্থিক খাতের এই গবেষক।
২০১৯ সালের আগস্টে যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা চালু করার উদ্যোগ নেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান। তাঁর উদ্ভাবনী উদ্যোগের ফলে করোনার দুই বছরে প্রযুক্তি বাস্তবায়নে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে সোনালী ব্যাংকে।
প্রতিষ্ঠানটি ফিনটেক বাস্তবায়নে পাঁচ বছরের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল তার প্রায় ৮০ শতাংশই দুই বছরে সম্পন্ন করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে সোনালী ইনটেলেক্ট নামে অংশীদারি প্রতিষ্ঠানটি অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছে।
সোনালী ইনটেলেক্টের সফটওয়্যার ব্যবহার করে সোনালী ব্যাংকসহ আরেকটি সরকারি ব্যাংক রূপালী ব্যাংকও ভালো ফল পেয়েছে। গত বছরের (২০২১) বার্ষিক হিসাব সম্পাদন প্রক্রিয়া মাত্র আট ঘণ্টায় সম্পন্ন করেছে সোনালী ব্যাংক, যা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘বিকাশ থেকে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। আমার অ্যাকাউন্ট থেকে বিকাশে যাবে। এই লিংকগুলো আমরা করে ফেলছি। চালুও হয়েছে। কার্যকর আছে। প্রসেস হ্যাজ বিন স্টার্টেড এবং এটা অ্যাকর্ডিংলি কাজ করছে।
আন্তর্জাতিক অনলাইন পেমেন্ট সংস্থা পেপালের ‘ইনওয়ার্ড সার্ভিস’ জুমের মাধ্যমে বিদেশ থেকে খুব সহজে ও কম সময়ে দেশে টাকা পাঠানো যায়। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে দেশে টাকা চলে আসে।
সাধারণত প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে চাইলে জমা দেওয়ার অন্তত ৭২ ঘণ্টা পর বাংলাদেশে টাকা জমা হয়। কিন্তু পেপাল জুম সেবা থেকে টাকা পাঠাতে এক সেকেন্ডের মতো সময় লাগে।
জুম পেপাল প্রসঙ্গে আতাউর রহমান বলেন, ‘রেমিট্যান্স দ্রুত সময়ের মধ্যে আনতে অ্যাপভিত্তিক সেবা সাহায্য করছে। জুম সার্ভিসটা ওইভাবে আলোকিত হয়নি। এটা টেকনোলজি তো, প্রতিদিনই চেঞ্জ হচ্ছে। আমরা এখন ব্লেইজকে ( বিএলএজেডই) প্রাধান্য দিচ্ছি।
ব্লেইজের প্রতি গ্রাহকের আকর্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন শুরু করি, তখন যে হারে রেসপন্স পেয়েছি, এখন এটা প্রায় ১৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যেটা হয়েছে, ইউরোপ থেকে কিন্তু রেমিট্যান্স হয় কম। বেশির ভাগ রেমিট্যান্স হয় সৌদি আরব থেকে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স আহরণে ব্লেইজের সেবা উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে সোনালী ব্যাংকের নির্বাহী প্রধান বলেন, ‘আগামী মাসের (মার্চের) মধ্যেই আমাদের যারা কাউন্টার পার্ট আছে, তাদের সঙ্গে অংশীদারির সিদ্ধান্তে গেলে রেমিট্যান্সটা কিছু বাড়বে।
অ্যাপভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠান, যেমন স্ক্রিল, ট্রাংলো, ট্যাপট্যাপ ব্যবহারকারী প্রবাসীরা অ্যাপে লগইন বাংলাদেশের গ্রাহকসংশ্লিষ্ট তথ্য পূরণ করে সেন্ড বাটনে চাপলেই সঙ্গে সঙ্গে প্রণোদনাসহ সোনালী ব্যাংকে চলে আসবে।
সোনালী ব্যাংকে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট খুলবে পাঁচ মিনিটেই!
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের নতুন হিসাব খুলতে এখন আর কাউন্টারে গিয়ে ফরম পূরণ করতে হয় না। তথ্য দেওয়া কিংবা যাচাই সব কিছুই হচ্ছে পাঁচ মিনিটে, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে।
সোনালী ই-সেবার মাধ্যমে ঘরে বসেই সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। করোনাভাইরাস থেকে গ্রাহকদের সুরক্ষা দিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান। পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে।
ই-কেওয়াইসি (ইলেকট্রনিক নো ইওর কাস্টমার) প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান নতুন গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করা হয় মুহূর্তেই জাতীয় পরিচয়পত্রের সংযোগ ব্যবহার করে। এই সেবা ব্যাংকের খরচ ও গ্রাহকপ্রতি সময়Ñদুটিই কমিয়ে দিয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে সোনালী ব্যাংকের নির্বাহী প্রধান বলেন, আমার অ্যাকাউন্ট খুলতে পাঁচ মিনিট লেগেছে, এক্সপার্ট হলে দুই মিনিটেও সম্ভব। অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য গ্রাহকদের সশরীরে ব্যাংকের কোনো শাখায় যাওয়ার দরকার নেই।
দেশের সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ই-কেওয়াইসি চালুর জন্য সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
একটি আদর্শ ডিজিটাল ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২০ সালের মার্চ মাসে সোনালী ই-সেবা অ্যাপস চালু করা হয়। এই অ্যাপস চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৯৯ হাজার ৩৩টি হিসাব খোলা হয়েছে।
গত বছরের মার্চে চালু হওয়া সোনালী ই-ওয়ালেটের মোট হিসাবসংখ্যা ছাড়িয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৮১টি। সোনালী ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে গড়ে প্রতিদিন ছয় হাজার লেনদেন হচ্ছে।
সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আতাউর রহমান বলেন, আমরা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স কিভাবে মেইনটেইন করতে হয়, কিভাবে মেইনটেইন করা যায়, এই কভিডকালে আমরা সেটা শিখলাম। সোনালী ব্যাংকে (অবকাঠামো অনুযায়ী গ্রাহকসংখ্যার বিচারে) সেটা কোনোভাবেই সম্ভব না। বিকজ অব লাখ লাখ মানুষ যায়, ছোট ব্রাঞ্চ, কারো ইলেকট্রিক বিল দিতে হয়, কারো বয়স্ক ভাতা নিতে হয়। বয়স্করা একজনও আসেন না।
নিজস্ব সক্ষমতায় ই-সেবার উন্নয়ন হয়েছে বলে জানান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব কর্মীরা দিন-রাত কাজ করে তৈরি করেছেন সিম্পলি দুই থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে। আমার পাঁচ মিনিট লাগছে অ্যাকাউন্ট খুলতে।
সোনালী ব্যাংকে ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি সেবা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. শাহ মোহাম্মদ আহসান হাবীব বলেন, বিশ্বের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ই-কেওয়াইসিতে জোর দিচ্ছে। সোনালী ব্যাংকে এই সেবার অন্তর্ভুক্তি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রতি মানুষের ধারণা পাল্টাতে সাহায্য করবে।
(ঢাকাটাইমস/৫মার্চ/এআর)

মন্তব্য করুন