৭ মার্চের ভাষণ এবং একজন আমজাদ আলী

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৬ মার্চ ২০২২, ২২:৫৪| আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২২, ১১:১৮
অ- অ+

যুগ-যুগ ধরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক এই ভাষণে ছিল মুক্তিকামী বাঙালির কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা। লাখো জনতার সামনে দেয়া অলিখিত এই ভাষণ এখন ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ।

সেই ভাষণটি ক্যামেরায় ধারণ এবং পরবর্তীতে নিজের জীবনবাজি রেখে যারা সংরক্ষণ করেছিলেন, তাদের একজন সাভার পৌর এলাকার বাসিন্দা আমজাদ আলী খন্দকার। যিনি সেসময় চলচ্চিত্র বিভাগে ক্যামেরা সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এবার মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক।

কিন্তু এই ভাষণ রেকর্ড ও সংরক্ষণ মোটেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি এর পেছনে ছিলেন তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টেলিভিশনের কয়েকজন অকুতোভয় কর্মী। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করেন ফিল্ম ডিভিশনের আটজন নেতৃত্ব দেন ওই বিভাগের প্রধান মুহিবুর রহমান খান, যিনি অভিনেতা আবুল খায়ের নামে বেশি পরিচিত।

২৫মার্চের পর থেকে বিভিন্ন অফিস-আদালতে দায়িত্ব নিতে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদাররা। তখন ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ফিল্মগুলো সরিয়ে ফেলতে ফিল্ম ডিভিশনের প্রধান দায়িত্ব দেন ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকারকে। তিনি ভাষণ রেকর্ডিং দলেরও সদস্য ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের ৫০তম বার্ষিকীতে এসে ঢাকাটাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই ভাষণের ভিডিও ধারণ এবং সংরক্ষণ করতে গিয়ে জীবনবাজির গল্প শুনিয়েছেন আমজাদ আলী।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমরা রেসকোর্স ময়দানে যখন যাই, দেখতে পাই ভোর থেকেই লোকজন এসে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেছে। এর মধ্যেই আমরা গিয়ে ক্যামেরা বসালাম। ভাষণ রেকর্ড করার দায়িত্বে ছিলাম আমি ও মবিন সাহেব। রউফ সাহেব এবং তৌহিদ ঘুরে ঘুরে শট নেয়।

তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ফিল্ম ডেভেলপ করে নিয়ে আসব, সে ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। সেটা করতে যেতে হত এফডিসি ল্যাবে। বঙ্গবন্ধুর নাম দেখলে এটা নষ্ট করে ফেলবে, সেজন্য আমরা কৌশল করে ‘সাইক্লোন’ চিহ্ন দিয়ে এফডিসি থেকে ডেভেলপ করে নিয়ে আসলাম, যাতে অন্যরা মনে করে, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট ফিল্ম এগুলো।

২৫মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলার পরদিন থেকে বিভিন্ন অফিস-আদালতে দায়িত্ব নিতে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদাররা। চলচ্চিত্র বিভাগের মুক্তিকামী কর্মীরা ধারণা করলেন, পাকিস্তানি সেনারা যদি হানা দেয়, তাহলে এসব ধ্বংস করে দেবে। সে কারণে কীভাবে এগুলো সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে সরানো যায় সেই পরিকল্পনা করলেন বিভাগের প্রধান মহিবুর রহমান।

আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, তখন তিনি আমাকে বললেন, আমজাদ তোমাকে একটা দায়িত্ব দেব। আমি বলছি, কী দায়িত্ব স্যার? তিনি বললেন, তোমাকে এই মুহূর্তে ফিল্মগুলো নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। এরপর তিনি আমাকে একটি ট্রাঙ্ক কিনে আনার জন্য টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি মাপের ট্রাঙ্ক কিনে আনি।

তিনি বলেন, ট্রাঙ্ক আনার পর মহিবুর রহমান নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের উপর করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও বঙ্গবন্ধুর আরও ছবি ফিল্ম ঢুকিয়ে দেন সেই ট্রাঙ্কের ভেতর।

এরপর আমি স্যারকে বললাম, স্যার, আমি একটু আমার বাবার সাথে দেখা করে আসি?

তিনি বললেন, যাও। আমার বাবা বিজি প্রেসে চাকরি করতেন। আমি বাবাকে বললাম, আমি দুই দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। চিন্তা কইরেন না।

সেখান থেকে সোজা অফিসে যাওয়ার পর খায়ের সাহেব আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেল। আমাকে নিয়ে রুমের ভেতর গিয়ে রেকর্ড নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় দিলেন এবং আমার হাত ধরে বললেন, আমজাদ, আল্লাহ হাফেজ। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তিনি জানতেন যদি ধরা পড়ে, তাহলে আর বাঁচবে না।

সচিবালয় থেকে বের হতে হবে, কিন্তু বাইরে বিভিন্ন স্থানে তখন পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক পাহারা ও টহল। সচিবালয়ে ঢোকার ফটক ‘সেকেন্ড গেইট’ দিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করা হয়। ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। বেবি ট্যাক্সিতে করে বড় আকারের ট্রাঙ্ক নিয়ে রওনা হন আমজাদ। সংকেত পেয়ে ফটক খুলে দেন ফরিদ।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল সচিবালয়ের টিনশেড থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে এসে দেখি, আর্মির জিপ। মেশিন গান নিয়ে জনতার দিকে তাক করে বসে আছে। ওইখান দিয়ে আমার বেবি সোজা চলে আসল। ‘কী আছে?’ বললেই তো আমি শেষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশ ধরে চাঁনখারপুল থেকে চকবাজার হয়ে সোয়ারিঘাটে পৌঁছে আমজাদের বেবি ট্যাক্সি। এর পরের ধাপ নৌকা পারাপারের।

সোয়ারিঘাটে যাওয়ার পর কুলিরা দৌড়ে এলো। বলল, ‘স্যার কী এটা?’ আমি বললাম, তাড়াতাড়ি উঠাও। নৌকায় উঠাল। নৌকায় করে জিনজিরায় গেলাম।

নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেওয়ার পর আমজাদ দেখেন, শয়ে শয়ে লোক বাসের অপেক্ষায়। যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে।

দেখি, একটা বাস ছাড়ছে। বাসের পেছনে জোরে একটা থাপ্পড় মারলাম। থাপ্পড় দেওয়ার পরে ড্রাইভারটা পেছনের দিকে তাকাল।... বাসের উপরে উঠিয়ে দিলাম।

ভেতরে জায়গা না পেয়ে ট্রাঙ্কের সঙ্গে বাসের ছাদে চড়ে বসেন আমজাদ। পৌঁছান নবাবগঞ্জের বক্সনগরে। কিন্তু বক্সনগর থেকে তার গন্তব্য হাটাপথ কিংবা ঘোড়া।

আমজাদ বলেন, ঘোড়ার পিঠে উঠায় দিয়ে ঘোড়াওয়ালা একদিকে ধরল, আমি একদিকে। চার-পাঁচ কিলোমিটার হবে, বা এর বেশি হবে রাস্তা। আমরা হেঁটে চলে গেলাম। জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে। ওইখানে গিয়ে তাদের বাড়িতে ওটা রাখলাম।

ওই সময়ে মহিবুর রহমানও পৌঁছে যান সেই এলাকায়। কিন্তু দারোগা বাড়ির অবস্থান থানার কাছাকাছি হওয়ায় সেখান থেকে ট্রাঙ্কটি সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা।

তখন ওখান থেকে চর কুসাই নামে একটা গ্রাম আছে। ওইখানে দুজনের বাড়ি আছে, হাজি দানেশ ও উমেদ খাঁ- দুই ভাই। ওই বাড়িতে উমেদ খাঁর ধানের গোলার ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয় ট্রাঙ্কটি।

ধানের গোলায় মাসখানেক রাখার মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান। বিজয়ের পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো। সাদাকালো ওই ভিডিও ভাষণ ২০১৬ সালে রঙিন সংস্করণে রূপান্তরিত করা হয়।

এই ভাষণটি সংরক্ষণে অসীম সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে একুশে পদক লাভ করেন তিনি, তবে এখনও মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চরমভাবে ভেঙে পড়েন এই সাহসী সৈনিক। চাকরি বাঁচাতে ফিল্ম ডিভিশন থেকে যান বাংলাদেশ টেলিভিশনে দীর্ঘ কর্মজীবনে সেখানেও রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর।

(ঢাকাটাইমস/৬মার্চ/এলএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মির্জাপুরে ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার
রাজবাড়ীর কালুখালী বাজারে আগুন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি টাকা
কোরবানির পশুর হাট সড়কে বসানো যাবে না
ট্রাম্পের যে কৌশলে থেমে যায় পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা