জুয়ায় মোবাইল হারিয়ে এক যুগ লাপাত্তা! তারপর যেভাবে ধরল পিবিআই

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ২৪ মে ২০২২, ১৮:৩২| আপডেট : ২৪ মে ২০২২, ১৮:৪২
অ- অ+

জুয়ার নেশা তার। এই সর্বনাশা বাজির খেলায় মোবাইল ফোন হারানোর পর আত্মগোপন। তারপর লাপাত্তা থেকে কেটে যায় সুমনের এক যুগ। এর মধ্যে আবার এক নারীকে বিয়ে করে সংসারও করেছেন। লাপাত্তা হওয়া থেকে সুমনের খোঁজ মেলা পর্যন্ত নাটকীয় ঘটনাবলীর রহস্য উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন—পিবিআই।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের কার্যালয়ে মঙ্গলবার সকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সুমনের বিষয়ে ব্রিফ করেন।

পিবিআই বলছে, ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সকালে সুমন বাসা থেকে তার কর্মস্থল ডায়মন্ড প্যাকেজিং গার্মেন্টসে যাওয়ার পথে মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকায় রাস্তার মোড়ে ৩ তাসের জুয়া খেলায় ১০০ টাকা বাজি ধরে হেরে যায়। টাকা দিতে না পারায় তার মোবাইলফোন জুয়াড়িরা রেখে দেয়। ভয়ে আত্মেগোপনে চলে যান সুমন।

এসপি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সুমন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আর বাসায় না ফেরা এবং ফোন করে না পাওয়ায় বাবা মোজাফ্ফর ছেলের নিখোঁজের বিষয়ে ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়রী (জিডি) করেন। যা পল্লবী থানার জিডি নং-৩৬২।

‘পরে সুমনের বাবা মোজাফ্ফর জানতে পারে আসামী সুলায়মান হোসেন, শাওন পারভেজ, রুবেল, সোহাগ ও মানিক মিলে তার ছেলে সুমনকে অপহরণ করেছে। এরপর ওই বছর ২৯ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করে। যা পল্লবী থানার মামলা নং-৯০।

মামলা হাত বদল

পল্লবী থানায় মামলা হওয়ার পরে থানা পুলিশ ভুক্তভোগীকে উদ্ধার ও আসামিদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ তদন্তভার গ্রহণ করে। তারা ভুক্তভোগীর ব্যবহৃত মোবাইলফোনটি উদ্ধার করাসহ মামলার এজাহারনামীয় আসামীদের গ্রেপ্তার করে। পরে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করেন। কিন্তু কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি ডিবি।

পরে ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার পায় সিআইডি। সিআইডি ভুক্তভোগীকে উদ্ধারের চেষ্টায় সারাদেশে বেতারবার্তা পাঠায়। তবে সিআইডিও ভুক্তভোগীকে উদ্ধারসহ মামলার কোনো কিনারা করে উঠতে পারেনি।

এক বছর পরে এজাহারনামীয় আসামীদের বিরুদ্ধে অপহণের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২০১৩ সালে ১ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দেয় সিআইডি। চার্জশিটের বিরুদ্ধে সুমনের পিতার নারাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ফের মামলাটি তদন্তের জন্য ডিবিতে পাঠায়।

এবারও ডিবির কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদলে পায় তারা ভুক্তভোগীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি আসামী সুলায়মান এডিসি ক্যাম্পের কাঁচা বাজারের জুয়ার বোর্ড থেকে ক্রয় করেন। ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৯ সালে ২৬ এপ্রিল আদালতে মামলার চার্জসিট জমা দেন। এবারও বাদীর নারাজীর প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটির তদন্তের জন্য পিবিআইতে পাঠায়।

পিবিআই হাল ছেড়ে দিয়ে আবার ধরে

পিবিআই ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টম্বর মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। তদন্তের একপযার্য়ে পিবিআই জানতে পারে, সুমন নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পর সন্ধ্যায় একটি ফোনকল আসে। কিন্তু অবস্থান জানতে চাইলে কোনো উত্তর না দিয়েই ফোনের সংযোগটি বিচ্ছিন করে দেন। এরপর থেকে ওই মোবাইল নম্বরটি বন্ধ ছিল।

ওই ফোন কলের সূত্র ধরে পিবিআই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনিটারী ইন্সপেক্টর আব্দুল হাইকে শনাক্ত করেন। তাকে ওই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি জানান, মোবাইল সিমটি তার নামে থাকলেও তিনি ব্যবহার করতেন না। তার দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে সালাউদ্দিনকে দিয়ে তিনি ওই মোবাইল সিমের মাধ্যমে শাহবাগ থানার সামনে ফ্লেক্সিলোডের দোকান করাতেন। পরে ভাগ্নে সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অনেক অপরিচিত লোকজন ২ টাকা মিনিটে কথা বলতো। তবে কে কল করেছিল তা তিনি শনাক্ত করতে পারেননি। এক প্রকার হতাশ হয়ে পিবিআই চলতি বছরের ৯ মার্চ এই বলে মামলার চার্জসিট দালিখ করেন যে, তদন্তকালে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনায় উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণের অভাবে ভুক্তভোগীর অবস্থান শনাক্তসহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে ভবিষ্যতে ভুক্তভোগী উদ্ধার সংক্রান্তে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করা হবে বলে আদালতকে জানানো হয়।

কিন্তু অল্প দিনেই পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমের কাছে ওই ভুক্তভোগীর সম্পর্কে তথ্য এলে চলতি মাসের ২৩ মে আদালতে মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করার আবেদন করা হয়।

আদালতের নির্দেশে আবার মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের একটি বিশেষ টিম তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় লাপাত্তা সুমনকে সনাক্ত করে। পরে সোমবার সন্ধ্যা রাজধানীর কদমতলী থানার মদিনাবাগ এলাকা থেকে উদ্ধার করে।

সুমনের জীবনের নাটকীয়তা

সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই জানতে পারে, সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার পর সুমন পরিবারের হাল ধরতে ডায়মন্ড প্যাকেজিং নামের একটি কারখানায় হেলপার হিসাবে কাজ নেন।

ঘটনার দিন মিরপুর—১১ নম্বর বাজার এলাকার চার রাস্তার মোড়ে ৩ তাসের জুয়া খেলায় ১০০ টাকা বাজি ধরে হেরে যায়। তার কাছে টাকা না থাকায় মোবাইলফোন নিয়ে নেয় জুয়াড়িরা।

মোবাইলফোন হারিয়ে বাবার কাছে কি জবাব দেবেন বুঝতে না পেরে কাজে না গিয়ে সুমন চলে যান গুলিস্তানে। সেখানে ঘোরাঘুরি করে রাত পার করে পরের দিন আশ্র্রয় নেন বায়তুল মোকাররম মসজিদে।

সেখান থেকে এক লোক তাকে শাহবাগের ফুল মার্কেটে নিয়ে নাস্তা খাওয়ায়। পরবতীর্তে টিপু নামে এক লোক তাকে শাহবাগ এলাকার একটি হোটেলে শুধু থাকা ও খাওয়ার শর্তে কাজ দেয়। ওই হোটেলের বাবুর্চি হারুনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় এবং তার সঙ্গে সুমন ভোলার লালমোহনের মঙ্গল শিকদার এলাকায় একাধিকবার আসা যাওয়া করেন।

এরপর শাহবাগ এলাকায় বিভিন্ন চটপটির দোকানে কাজ, পপকর্ণ বিক্রি, বাসের হেলপার, রুমা এ্যকুরিয়াম, পপুলার এ্যকুরিয়ামসহ বেশ কয়েক জায়গায় কাজ করে। এরইমধ্যে নান্নু ওস্তাদ নামে এক ড্রাইভারের সঙ্গে তার পরিচয় হওয়ার পর তার সঙ্গে হেলপারি শুরু করে।

নান্নুর সঙ্গে ইউসেফ টেকনিক্যাল স্কুল ও বারডেম হাসপাতালের যাত্রী আনা নেওয়া করতে গিয়ে ইউসেফ স্কুলের একটি মেয়ের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক হয়ে যায় সুমনের। সেই সুবাদে তাদের বাসায় যাওয়া আসার একপযার্য়ে মেয়েটির মায়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সুমন।

পরে ওই নারীকে তার স্বামী ডিভোর্স দিলে সুমন লালবাগ কাজী অফিসে তাকে বিয়ে করেন। এরমধ্যে তাদের একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। উদ্ধার করার আগ পর্যন্ত স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রায়েরবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে সুমন বসবাস করে আসছিল বলে জানিয়েছে পিবিআই।

(ঢাকাটাইমস/২৪মে/এএইচ/ডিএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩
বেনাপোল কাস্টমসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতি আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য খালাস বন্ধ
কাশিয়ানীতে ছিনতাই হওয়া তেলবাহী ট্রাক উদ্ধার
প্রধান উপদেষ্টার চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা